Thank you for trying Sticky AMP!!

ভারতে নির্বাচনের ফলাফল ও প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ

নরেন্দ্র মোদি

ভারতসহ বিশ্বের অধিকাংশ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষককে হতবাক করে নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি পুনরায় নির্বাচিত হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তা–ই নয়, গত নির্বাচনের তুলনায় আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরেছেন মোদি ও তাঁর দল বিজেপি। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অভূতপূর্ব উত্থান। ওই রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে ২০১৪ সালে মাত্র ২টি আসনে বিজেপি জয়ী হয়েছিল। মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় পশ্চিমবঙ্গের মতো ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচিত রাজ্যে বিজেপি ১৮টি আসন দখল করে নেয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলেও যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে জয়ী হয়েছে বিজেপি। মোদির সরকার দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসছে—এমন ধারণা অনেকেই করেছিলেন। কিন্তু এতটা শক্তিশালী হয়ে ফিরবে, তা ছিল সবারই ধারণার বাইরে।

মোদি সরকার গত অধ্যায়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভালো করতে পারেনি। বিগত ১০ বছর ইউপিএ এবং এনডিএ—এই দুই সরকারই প্রচার করে আসছে যে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের মতো। কিন্তু এ ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে নতুন গবেষণায় বলা হয়েছে যে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণের পদ্ধতিতেই ভুল ছিল। প্রকৃত প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়াম। অবশ্য সরকার এ গবেষণার ফলাফল মানতে নারাজ। এখন ভারতে এই পরিসংখ্যান নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক চলছে। সুব্রামানিয়াম অবশ্যই তাঁর গবেষণার প্রক্রিয়া এবং গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি বেশ আস্থার সঙ্গেই তুলে ধরেছেন।

বিজেপির প্রথমবারে অর্থনীতির অবস্থা যে ভালো ছিল না, তা বিজেপিও ভালোভাবে জানত, যদিও গ্রামে টয়লেট, কিছু ক্যাশ এবং সস্তায় জ্বালানি হিসেবে এলএনজি প্রদান গ্রামের সাধারণ মানুষের উপকারে এলেও ডিমোনিটাইজেশন ছোট ব্যবসায়ীদের উপকার করেনি। বেকারত্বও কমেনি। তথাপি নির্বাচনে এমন বিজয়ের কারণ খুঁজতে বসেন ভারতের বিশ্লেষক ও নির্বাচন বিশ্লেষকেরা। এমনকি মোদির বিরুদ্ধে সরকারি এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রভাবিত করার অভিযোগ ছিল।

নির্বাচন–প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ সময় নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্ক লেগেই ছিল, যার জের এখনো রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখনো ইভিএম এবং নির্বাচন কমিশন নিয়ে যথেষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করে আসছেন। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। ২০২১ সালের নির্বাচনে এ রাজ্যে ২৫০টি আসনের টার্গেট ঘোষণা করেছে বিজেপি। ওই রাজ্যের অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, আগামী বছর আসতে আসতে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার অবনতি হলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রাজ্য সরকারকে বিপদে ফেলতে পারে, এমনকি রাষ্ট্রপতির শাসন কায়েম হতে পারে।

বিজেপি তথা এই ধরনের সফলতার পেছনে ধর্মীয় উন্মাদনা, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং পাকিস্তানকে সামরিকভাবে পরাস্ত করার ধারণা তো রয়েছেই। তা ছাড়া রয়েছে মোদির নিজস্ব ভাবমূর্তি। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত দুর্নীতির অভিযোগ নেই। তিনি নিজেকে কখনোই ধর্মনিরপেক্ষতার ধারক বলে জাহির করেননি। তিনি যে একজন ধর্মপ্রাণ খাঁটি হিন্দু, তার প্রমাণ তিনি প্রচারণার সাহায্যে উপস্থাপন করতে পেরেছেন। নির্বাচনের শেষ ধাপে তিনি প্রায় দুই দিন কাটিয়েছেন বদরিনাথের গুহায়, যা সরাসরি অনেক চ্যানেল দেখিয়েছে নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করে।

এবারের নির্বাচনে যেভাবে অর্থ ব্যয় হয়েছে, সেটা যে এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর যথেষ্ট প্রভাব রেখেছে, তাতে গবেষকদের মনে সন্দেহ নেই। ভারতের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক এবং সমাজসেবক অরুন্ধতী রায় নিউজ রিপাবলিক নামের পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এই নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার কবর রচিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, এবার বিজেপির কাছে যে অর্থ ছিল, তা আগের তুলনায় ২০ শতাংশ বেড়েছিল এবং তাঁর মতে এর বেশির ভাগ খরচ হয়েছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে বিজেপির অনুকূলে রাখতে। তিনি বলেন, এবার যেভাবে বিনা প্রতিবন্ধকতায় অর্থের খেলা চলেছে, তা হয়তো আগামী দিনে আরও ৫০ শতাংশ বাড়বে। কারণ, ভারতের নির্বাচন কমিশনের আইনে দলীয় খরচের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই।

অরুন্ধতী রায়সহ অনেক বিশ্লেষক অনেকটা শঙ্কা প্রকাশ করে যা বলেছেন, তা ভবিষ্যতে ভারতীয় রাজনীতিতে অন্যতম নিয়ামক হতে পারে। তিনি বলেছেন, এবার যেভাবে সামরিক বাহিনীকে বিজেপি নির্বাচনের প্রচারের হাতিয়ার বানিয়েছিল, তাতে সমাজে একধরনের সামরিকায়নের প্রভাব পড়ছে। এর সামান্য প্রভাব ভারতের ক্রিকেট টিমের উইকেটকিপার মহেন্দ্র সিং ধোনির গ্লাভসে সামরিক বাহিনীর কমান্ডো বাহিনীর স্মারকচিহ্ন থাকা নিয়ে আইসিসি ও বিসিসিআইয়ের চিঠি-চালাচালি। এবারের নির্বাচনে ভারত-পাকিস্তান বিরোধে ভারতীয় বাহিনীর কথিত দুঃসাহসী অভিযানের প্রেক্ষাপট তৈরি করে যেভাবে প্রচার করা হয়েছে, তা অতীতে করা হয়নি।

বিজেপি যে এই নির্বাচনের জন্য দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে পেয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যান্য দল অর্থ সংগ্রহ করলেও এত খরচ করার সামর্থ্য রাখেনি। ভারতের সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ (সিএমএস) তাদের ‘স্টাডি অব পোল এক্সপেন্ডিচার: দ্য ২০১৯ ইলেকশনস’ প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, এই নির্বাচন ছিল এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ব্যয়বহুল নির্বাচন। হয়তো এখন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক বিশ্বে এত ব্যয়বহুল নির্বাচন হয়নি। এই সংস্থার মতে, এবার ভারতীয় মুদ্রায় খরচ হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ হাজার কোটি রুপি, যার মধ্যে বিজেপি একাই প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। এভাবে সীমাহীন খরচ চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনে ১ ট্রিলিয়ন রুপি খরচ হতে পারে। এ ধরনের খরচের সঙ্গে যে দুর্নীতি প্রসার পায়, তা প্রমাণিত। এই গবেষণার যে দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে, তা হচ্ছে ভোট কেনার ক্রমবর্ধমান প্রবণতা। বলা হয়েছে যে ১২ থেকে ১৫ হাজার কোটি রুপি সরাসরি ভোটারদের ঘুষ দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।

নির্বাচন ক্রমেই ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে, তাতে সন্দেহ নেই। ভারতে এই ক্রমবর্ধিত অর্থের ব্যবহারের অন্যতম কারণ, প্রার্থীর ব্যক্তিগত পর্যায়ে খরচের সীমা নির্ধারণ করা থাকলেও দলীয় পর্যায়ে এ ধরনের খরচের সীমা নেই; যদিও উভয় ক্ষেত্রেই আইন অনুযায়ী নির্বাচনোত্তর খরচের হিসাব নির্বাচন কমিশনকে দাখিল করতে হয়। ভারতের নির্বাচন কমিশন ব্যক্তি পর্যায়ে নির্বাচনী খরচ পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের দ্বারা গঠিত ‘মনিটরিং টিম’ নিয়োগ করে, তথাপি এ ধরনের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত কঠিন। কালোটাকার অনুদান বন্ধ করতে ‘নির্বাচনী বন্ড’ চালু করা হয়েছে। তবে সেখানেও সমস্যা হলো কে কোন পার্টিকে কত অনুদান দিয়েছে, তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে শুধু বিজেপিই নয়, অন্যান্য দলও তাদের সাধ্যের বাইরে খরচ করেছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। কংগ্রেস প্রায় ২৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে বলে প্রকাশ। তবে এ ধরনের অর্থ সংগ্রহ এবং ব্যয় সরকারি দলেরই বেশি হয়। কারণ, এখানে সমতল ভূমি তৈরি করা স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব নয়।

আমাদের নির্বাচনগুলোতে ক্রমেই অর্থের খরচ ও ব্যবহার প্রতিনিয়তই বাড়ছে। যদিও আমাদের আইনে, বিশেষ করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় এবং প্রার্থীর খরচের সীমা বেঁধে দেওয়া হলেও এর বহুগুণ অর্থ ব্যয় করা হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রায় প্রতিটি দলই মোটা অঙ্কের বিনিময়ে মনোনয়ন বিক্রি করে থাকে, যা মনোনয়ন-বাণিজ্য হিসেবে বহুল আলোচিত। ভারতে প্রার্থীর পর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা থাকলেও আমাদের আইনে নেই। এর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি বহুবার তুলে ধরেছি। এমনকি ২০১১ সালে নির্বাচন কমিশন থেকে আইনে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে কোনো নির্বাচন কমিশন এসব উদ্যোগ নেয়নি।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হবে, এ অঞ্চলে নির্বাচন এখন বৈধ আর অবৈধ অর্থের খেলা। এখান থেকেই দুর্নীতির শুরু। অবৈধ ও অতিরিক্ত অর্থের খেলা বন্ধ করতে হলে একদিকে যেমন নির্বাচন কমিশনের আইনের পরিবর্তন ও কঠিন প্রয়োগের প্রয়োজন, অন্যদিকে এ অবৈধ ব্যয় কীভাবে কমানো যায়, সেদিকে ভাবতে হবে।

বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ২০১১ সালে নির্বাচনের ব্যবস্থাপনা, দলীয় ও প্রার্থীর খরচ সম্পূর্ণভাবে সরকারি তহবিল থেকে কমিশনের নিয়ন্ত্রণে (পাবলিক ফান্ডিং) ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেছিল, তা-ও আর এগোয়নি। এ ব্যবস্থা এ অঞ্চলে ভুটানসহ বিশ্বের বহু দেশে রয়েছে। ভারতেও পাবলিক ফান্ডিং নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে। আমাদেরও এ নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। অন্যথায় আমাদের সংসদে শুধু বড় বড় ব্যবসায়ী বা অবৈধ টাকার মালিকেরাই সদস্য হিসেবে থাকবেন, যোগ্য ও নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদের জায়গা হবে না।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে অনারারি ফেলো এসআইপিজিএনএসইউ

hhintlbd@yahoo.com