Thank you for trying Sticky AMP!!

ভালো থাকার কারিকুলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চালুর সময় কি এখনো হয়নি?

২০১৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এবিসি নিউজের সংবাদ শিরোনামে লেখা হয় ‘আমেরিকানরা জগতের সবচেয়ে অসুখী মানুষ’। উদাহরণ, সে দেশে বর্তমান সময়ের চিকিৎসকেরা যেসব বিষণ্নতারোধক ওষুধ সেবনের পরামর্শ দিচ্ছেন, তা ২০ বছর আগের তুলনায় ৪০০ গুণ বেশি। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে যে তিনটি কারণে অধ্যাপক লরি স্যানটোস সাইকোলজি অ্যান্ড দ্য গুড লাইফ নামক কোর্স পড়াচ্ছেন, তার দ্বিতীয় কারণ ছিল এই অসুখী জাতির কিছু মানুষকে সুখী হওয়ার কৌশল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ রকম একটি কোর্স চালুর প্রথম ও তৃতীয় কারণটিও তাঁর বয়ানে জেনে নেওয়া যাক। প্রথম কারণ: বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা সাম্প্রতিক কালে এমন সব তথ্য প্রকাশ করছে, যা নিজেদের জীবনকে সুখী করার জন্য ব্যক্তি মানুষ প্রয়োগ করতে পারে, এবং সবার অনুশীলনের মাধ্যমে আচরণকে সঠিক ও সুন্দর রাখার জন্য সরকারি নীতিমালাও সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। আর তৃতীয় কারণ, সুখী হওয়ার জন্য যে অন্তর্দৃষ্টি লাগে, তা অর্জন করার জন্য কোর্সটি করা প্রয়োজন।

তার মানে দাঁড়াচ্ছে, ইয়েলের ৩১৯ বছরের ইতিহাসে এই কোর্স সবচেয়ে জনপ্রিয় কোর্স হওয়ার কারণ, কেবল শিক্ষার্থীদের ভালো গ্রেড পাওয়ার ভাবনা নয়; বরং সুখী হওয়ার আকুলতা। ইয়েল একাই শুধু নয়, দ্য পেন স্টেট ইউনিভার্সিটি, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, দ্য ওহিও স্টেট ইউনিভার্সিটি, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি, ইন্ডিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ‘মাইন্ডফুলনেস’, ‘ওয়েলবিং’, নিজের শরীর-মন-পরিবারের প্রতি যত্নশীল হওয়া, আত্মিক প্রশান্তি লাভ ইত্যাদি বিষয়ে কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। এ কার্যক্রমগুলো যে হঠাৎ কোনো এক বিকেলে কফি পান করতে করতে এক ঘণ্টার একটি সেশনে অংশ নেওয়া, তা নয়। একাডেমিক পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত বিষয় হিসেবে ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত কোর্স হিসেবে তারা এ কার্যক্রম চালাচ্ছে।

সুতরাং আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাইন্ডফুলনেস বা ওয়েলবিং বা ভালো থাকার একাডেমিক কারিকুলাম চালু করেছে বলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এটি চালু করতে হবে, ব্যাপারটি সে রকম নয়; বরং বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্যই এ ধরনের কোর্স বা প্রোগ্রাম চালু করা প্রয়োজন আরও দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই। আত্মহনন বা বিষণ্নতা রোধের সর্বোচ্চ পরিমাণ ওষুধ বিক্রির রেকর্ড নয়, আমাদের রেকর্ড হোক আত্মপ্রত্যয়ী, মেধাবী, সাহসী, ইতিবাচক, সুখী, ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত সর্বোচ্চসংখ্যক তরুণের দেশ হিসেবে।

তারা সমাজের গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে হতাশা, লক্ষ্যহীনতা, বিষণ্নতা, আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধিতে শঙ্কিত। এগুলো যেন সমাজকে ভারসাম্যহীনতার দিকে নিয়ে যেতে না পারে সে জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন, তার অন্যতম কাজটি তারা করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তাদের মধ্যে জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তারা দিচ্ছে।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণ-তরুণীদের সাম্প্রতিক সময়ে আত্মহননের ধারাবাহিক সংবাদগুলো জানান দেয় যে আমাদের শিক্ষার্থীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মানসিকভাবে অসহায়, বিপর্যস্ত ও দিকনির্দেশনাহীন। বহুতল ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী জায়না হাবিবের পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার ঘটনাকে নানাবিধ লেন্সে দেখা ও বহুবিধ তত্ত্বের আলোকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। কিছুদিন আগে যেমনটি হয়েছিল একজন তারকার শ্বশুরের ‘লাইভে’ এসে আত্মহননের ঘটনায়। কেউ বলেছিলেন, এগুলো মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ, কারও মতে, একাকী-পরিজনবিচ্ছিন্ন জীবনযাপনই এর কারণ, কেউ বা মনে করেছিলেন, দীর্ঘদিন বিষণ্ন থাকার পরিণতি।

এ বিষয়গুলো আরও দুর্ভাবনা সঞ্চার করে, যখন পরিসংখ্যান আমাদের বলে যে ২০১৭ সালে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৯টি, ২০১৮ সালে সংখ্যাটি ছিল ১১, ২০১৯ সালের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, ২০২০ সালে তা ৭৯-তে দাঁড়ায়, এবং ২০২১ সালে তা একলাফে হয়ে যায় ১০১ (ঢাকা ট্রিবিউন, জানুয়ারি ২৯, ২০২২)। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর অপার শক্তির উৎস যে তারুণ্য, তা এহেন পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হওয়ার পরিণতি আমরা বুঝতে পারছি কি?

এ-জাতীয় একেকটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অনেক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, মত-অভিমত, আলোচনা-সমালোচনা করি আমরা। সমাজ আত্মহননের কারণ অনুসন্ধান করতেই পারে, প্রতিবাদও জানাতে পারে; কিন্তু এগুলোর কতটুকু সমস্যার সমাধানের সূত্র খুঁজতে সাহায্য করে, সেটি ভেবে দেখেছি কি? আলোচনা-পর্যালোচনার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিকভাবে ধারাবাহিক ও কার্যকর ব্যবস্থা কি নেওয়া উচিত নয়, যা বিষণ্নতার চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়া বা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে যাওয়া মানুষটিকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে? তাকে ‘মানসিকভাবে অসুস্থ’ ছাপ্পর না মেরে, তার ভেতরের অমিত শক্তি ও সম্ভাবনার যে খনি রয়েছে, সেটির সন্ধান পেতে সাহায্য করবে? নাকি আগে কার্যকারণ ‘অনুসন্ধান’, পরে ‘সমাধান’ নীতি নিয়ে বসে থেকে আত্মহননকারী ব্যক্তির তালিকা আমরা লম্বা হতে দেব?

মানবিক উন্নয়ন সূচকে টেকসই ক্রমোন্নতিসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে বলে আমরা জানতে পারি (২০১৯ সালে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেনের বক্তব্য থেকে নেওয়া)। অর্থনৈতিক সাফল্যের পাল্লায় দেখা যায়, ১৩টি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে (প্রথম আলো, ২৭ মার্চ ২০২১)। কিন্তু সাফল্য-সমৃদ্ধি ধরে রাখার দায়িত্ব নেবে যে দুটো হাত, সে হাতের মালিক যদি সুইসাইড নোট লেখার চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘোরে, কিংবা গাঁজা বা ইয়াবার প্যাকেটে বিষণ্নতা থেকে মুক্তি খোঁজে, অথবা ভার্চ্যুয়াল ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ডিভাইসে স্ক্রল করতে করতে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে; তাহলে আমরাও কি আমেরিকার মতো অসুখী জাতিতে পরিণত হওয়ার পথে হাঁটছি না? সময় থাকতে এসবের সমাধান নিয়ে কি তাহলে ভাবা দরকার নয়?

অনেক অর্থ ব্যয় কিংবা অনেক বিদেশি এক্সপার্টের গালভরা পরামর্শ অনুযায়ী নয়, আমাদের যা আছে, তা নিয়েই কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পারে শিক্ষার্থীদের জন্য বাস্তবসম্মত কারিকুলাম প্রণয়ন করতে। যা হবে প্রথাগত বিষয়ের বাইরে কিন্তু জীবনঘনিষ্ঠ, যা তাদের একই সঙ্গে ক্লাসে ১ম এবং জীবনে ১ম হওয়ার প্রেরণা জোগাবে। তাদের জীবনের লক্ষ্য ঠিক করতে, সে অনুযায়ী কাজ করতে, শরীর ও মনের প্রতি যত্নশীল হতে, ক্ষমা ও সমমর্মিতার মতো গুণ অর্জন করতে এবং সর্বোপরি ভালো মানুষ হতে সাহায্য করবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কাউন্সেলিং সেবার বন্দোবস্ত থাকলেও তা যে সব সময় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে না, তার প্রচুর উদাহরণের একটি হলো জায়নার আত্মহনন। জায়নার মতো শিক্ষার্থীরা কি তাদের আবেগ-কষ্ট-সমস্যা প্রকাশের জন্য প্রথাগত কাউন্সেলিংকে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য জায়গা মনে করেছিল? নাকি জায়গাটির কাঠামোগত দুর্বলতা ও প্রয়োজনীয় আন্তরিকতার অভাবের কারণে সেখানে যাওয়ার কথা তাদের মনেই আসেনি?

বাস্তবতা হচ্ছে, কাউন্সেলরের কাছে যেতে শিক্ষার্থীদের সংকোচের বিষয়টি খুব সহজাত। আর যদি বা যায়-ও, এবং সেখানে তাকে লেবেল মেরে দেওয়া হয় যে ‘তোমার মানসিক সমস্যা আছে’, সেটি হজম করা বেশ কষ্টকর। কথাটি সম্ভবত একজন পাগলকে বললেও সে কষ্ট পাবে, নয় তেড়ে আসবে। কাজেই বিচ্ছিন্নভাবে কেবল একক শিক্ষার্থীর জন্য কাউন্সেলিং নয়, সামগ্রিকভাবে সব শিক্ষার্থীকে ইতিবাচকভাবে সহায়তা দেওয়ার কথা ভাবা দরকার, যা হবে তাদের ভালো থাকার জন্য, নিজের ও পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য উপযোগী একাডেমিক কারিকুলাম। শুধু বিসিএস হওয়ার মাধ্যমে উপযুক্ত নাগরিক নয়, বাংলাদেশের দরকার শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও নৈতিকভাবে ফিট তরুণ প্রজন্ম। এটি বুঝতে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃপক্ষের আশা করি অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

Also Read: আত্মহত্যার ‘মহামারি’ ঠেকাতে কতটা প্রস্তুত আমরা

একজন মানুষ যখন বেঁচে থাকার কোনো কারণ খুঁজে পায় না, তখনই সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চায়। এর সঙ্গে তার পরিস্থিতি অনুযায়ী আরও কিছু উপ-কারণ থাকতে পারে। অথচ জীবনকে অর্থবহ করার জন্য নিজের ভেতরের অনন্য শক্তি অর্থাৎ ক্ষমা ও মমতাকে কাজে লাগানো কত সহজ, তা না জেনেই সে পৃথিবী থেকে চলে যায়।

সুতরাং আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মাইন্ডফুলনেস বা ওয়েলবিং বা ভালো থাকার একাডেমিক কারিকুলাম চালু করেছে বলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এটি চালু করতে হবে, ব্যাপারটি সে রকম নয়; বরং বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্যই এ ধরনের কোর্স বা প্রোগ্রাম চালু করা প্রয়োজন আরও দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই। আত্মহনন বা বিষণ্নতা রোধের সর্বোচ্চ পরিমাণ ওষুধ বিক্রির রেকর্ড নয়, আমাদের রেকর্ড হোক আত্মপ্রত্যয়ী, মেধাবী, সাহসী, ইতিবাচক, সুখী, ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত সর্বোচ্চসংখ্যক তরুণের দেশ হিসেবে।

  • ইশরাত জাকিয়া সুলতানা সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়