ভালো বা মন্দে, থাকুন দেশের সঙ্গে
শুনেছি, একবার সম্রাট আকবর নাকি তাঁর সভাসদদের প্রশ্ন করেছিলেন, তাঁর রাজ্যে কোন পেশার মানুষ সবচেয়ে বেশি। সবাই বিভিন্ন পেশার নাম বললেও বীরবল যথারীতি ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘গোস্তাকি মাফ জাহাঁপনা। আমাদের দেশে আসলে ডাক্তারের সংখ্যা অনেক বেশি, এমনকি রোগীর চেয়েও বেশি।’ এতে সভাসদরা নাকি ব্যাপকভাবে আমোদিত হয়েছিলেন, কেউবা হাসাহাসি করেছিলেন, আবার কেউ গালমন্দও করেছিলেন। বীরবলও ছাড়ার পাত্র নন। ঘটনার সাত দিনের মাথায় কপট অসুখের অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি নাকি তাঁর মতামত প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন। বীরবল কম্বল মুড়ি দিয়ে রাজসভায় প্রবেশ করে কাতর কণ্ঠে জ্বরের কথা জানিয়েছিলেন। অমনি সভাসদদের প্রত্যেকেই বীরবলকে জ্বর উপশমের নানা পরামর্শ কিংবা পথ্য দিয়ে নিজেদের অজান্তেই প্রমাণ করেছিলেন বীরবলের মতামতের যথার্থতা। বিচক্ষণ সম্রাট আরেকবার প্রমাণ পেয়েছিলেন বীরবলের ক্ষুরধার বুদ্ধির। সম্প্রতি বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হওয়ার পর আমার কেবলই মনে পড়ছে এই কৌতুক। তবে আজ যদি সম্রাট আকবর আর বীরবল বেঁচে থাকতেন আর যদি বীরবলকে যদি একটু ভিন্নভাবে প্রশ্ন করা হতো, বাংলাদেশের জনগণ সবচেয়ে ভালো বোঝে কোন বিষয়টি, তবে তিনি নিশ্চিতভাবেই উত্তর দিতেন, ‘ক্রিকেট’। তবে এটি প্রমাণ করতে বীরবলকে হয়তো কোনো অভিনয়ের আশ্রয় নিতে হতো না। এটি প্রমাণ করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ওয়ালই তাঁর জন্য যথেষ্ট হতো। কারণ, ফেসবুকের ওয়াল বলছে, বাংলাদেশের সবাই আজ ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ।
সম্প্রতি শুরু হয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। বাঙালি বরাবরই খেলাধুলা ভালোবাসে। এককালে বাংলাদেশে তুমুলভাবে জনপ্রিয় ছিল ফুটবল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের স্থান করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে বেড়েছে আমাদের উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। ক্রিকেট আমাদের ভালোবাসা, আবেগ আর উৎকণ্ঠার নাম; সন্দেহ নেই। অন্যদিকে, ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয় ব্যবহারের বদৌলতে এখন আমাদের আবেগ আর অনুভূতি প্রকাশের দ্বার অবারিত। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা আর নিজের মতামত প্রকাশের ব্যাকুলতা—এই দুইয়ের চাপ সামলাতে তাই হিমশিম খাচ্ছে ফেসবুকের ওয়াল। যদিও বিষয়টি নতুন কিছু নয়, তারপরও এবারের বিশ্বকাপ ক্রিকেট শুরু হওয়ার পর যেন অতীতের সব সীমা অতিক্রম করেছে আমাদের এই প্রবণতা। ক্রিকেটের প্রতি আবেগ আর ভালোবাসা প্রকাশের আতিশয্যে আমরা অনেকেই কাণ্ডজ্ঞানশূন্য হয়ে ক্রিকেটারদের প্রতি আপত্তিকর ও অসম্মানজনক নানা ধরনের পোস্ট দিচ্ছি। ফেসবুকের ওয়ালে চোখ রাখলে মনে হচ্ছে, ব্যবহারকারী অনেকেই হয়তো ক্রিকেট মাঠের বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কিংবা বড় মাপের ক্রিকেটবোদ্ধা। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন খেলার মাঠে ব্যস্ত, তখন আমরা ফেসবুকে মত্ত থাকছি স্ট্যাটাস, লাইক আর কমেন্টসের ফুলঝুরিতে। শোভন–অশোভনের মাত্রাজ্ঞান ভুলে মিনিটে মিনিটে পোস্ট দিচ্ছি নানা মন্তব্য। খেলোয়াড়েরা তো বটেই, আমাদের কমেন্টস থেকে রেহাই পাচ্ছেন না নির্বাচকমণ্ডলী, কোচ, এমনকি ফিজিও। ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করছি ক্রিকেটারদের স্ত্রী, প্রেমিকা, পরিবার–পরিজনদের। ছিঁড়েখুঁড়ে বের করে আনছি ক্রিকেটারদের অতীত, তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন, আদর্শ কিংবা রাজনৈতিক পরিচয়। দেশের ভাবমূর্তি বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করা এই অদম্য খেলোয়াড়দের কী নির্দ্বিধায় গালিগালাজ করছি আমরা!
মনে রাখা প্রয়োজন, যিনি ক্রিকেট ভালোবাসেন, তিনি কখনোই একজন ক্রিকেটারকে অপমানজনক মন্তব্য করতে পারেন না। তাই যাঁরা ক্রিকেটারদের গালি দিচ্ছেন, তাঁরা আদৌ ক্রিকেটকে ভালোবাসেন তো! ভালোবাসার বস্তু কিংবা মানুষকে কখনো অসম্মান করা যায় কি! একজন ক্রিকেটারই ভালো বোঝেন খেলা চলাকালে মাঠের বাস্তব পরিস্থিতি। কিছু ভুলত্রুটি থাকতেই পারে। এর জন্য প্রয়োজন গঠনমূলক সমালোচনা। আমরা যারা দীর্ঘদিন বিভিন্ন পেশায় সম্পৃক্ত আছি, আমরা কি ভুল করি না! আমরা কজন আমাদের সেই ভুলগুলোর দিকে ফিরে তাকাই, আত্মসমালোচনা করি, নিজেকে শুধরে নিই? অথচ সস্তা সমালোচনা করে আমরা অপমানিত করছি আমাদের জাতীয় খেলোয়াড়দের, ভেঙে দিচ্ছি তাঁদের আত্মবিশ্বাস, মৃত্যু ঘটাচ্ছি দেশের সম্ভাবনার। এতে আমরা নিজেরাও কি অপমানিত হচ্ছি না?
এই তো কদিন আগে ঘুরে এলাম ভারতবর্ষ থেকে। শিলং, দার্জিলিং কিংবা সিকিমের পথে পথে কথা হয়েছে সেখানকার স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে। তাঁরা সবাই জানেন বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে ক্রিকেটে। তাঁরা অনেকেই ভক্ত তামিম, সাকিব কিংবা মাশরাফির। বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের প্রশংসা শোনার অনুভূতি সত্যিই স্বর্গীয়। যাঁরা এভাবে বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করাচ্ছেন, আমরা কেন আস্থা রাখতে পারছি না তাঁদের ওপর? একটি কিংবা দুটি ম্যাচের পারফরম্যান্সে কেন আমরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি; হারিয়ে ফেলছি মাত্রাজ্ঞান? লক্ষ রাখতে হবে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই অগ্রযাত্রা যেন আমাদের কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্যে ব্যাহত না হয়। দেশের ভাবমূর্তি যাঁরা বিশ্বদরবারে তুলে ধরছেন, আমরা যেন তাঁদের অসম্মানিত না করি, তাঁদের আত্মবিশ্বাস আমরা যেন ভেঙে না দিই। ক্রিকেটাররা জানেন, আন্তর্জাতিক ম্যাচে তাঁরা যখন খেলেন, তখন তাঁরা শুধু ১১ জন খেলেন না; বরং খেলেন বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ। তাঁরা আরও জানেন, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের চোখ তাঁদের অনুসরণ করছে। এই উপলব্ধির চাপ কিন্তু কম নয়। আসুন, আমরা তাঁদের এই অনুভূতিকে শ্রদ্ধা জানাই, তাঁদের পাশে থাকি, বিশ্বাস রাখি তাঁদের সামর্থ্যের ওপর আর সহযোগিতা করি তাঁদের এগিয়ে যেতে। কারণ, তাঁরা জিতে গেলে জিতে যায় বাংলাদেশ।
নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
purba_du@yahoo.com
আরও পড়ুন
-
মানুষের হাত-পা কেটে নিজেই ‘অস্ত্রোপচার’ করতেন মিল্টন সমাদ্দার: ডিবি
-
শুক্রবার ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়নি, ভুল করে ফেসবুকে পোস্ট হয়েছিল: মন্ত্রণালয়
-
ইজারার পুরো টাকা না দিয়েই গাবতলী পশুর হাট দখল, হাসিল আদায় ডিপজলের
-
মানব পাচার মামলায় চার দিনের রিমান্ডে মিল্টন সমাদ্দার
-
শিক্ষার্থী বিক্ষোভে বাম–ডান দুই দিক দিয়েই বিপদে বাইডেন