Thank you for trying Sticky AMP!!

ভুটানেও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়!

ভুটানে ধীরে ধীরে একটা গণতান্ত্রিক আবহ তৈরি হচ্ছে।

বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য সংবাদটা হয়তো দীর্ঘশ্বাসের জন্ম দেবে। পরপর তৃতীয় মেয়াদে গত শুক্রবার ভুটানে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নির্বাচন হয়ে গেল শান্তিপূর্ণভাবে এবং জালিয়াতির কোনো অভিযোগ ছাড়াই।

২০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনের একটি বড় দিক ছিল বিজয়ী প্রার্থীদের সংখ্যাগরিষ্ঠই এবার নতুন মুখ। বিগত পার্লামেন্টে যাঁরা সদস্য ছিলেন, তাঁদের ১২ জন এবারও নির্বাচনে প্রার্থী হলেও মাত্র পাঁচজন নির্বাচিত হন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন হেরেছেন অনেক ভোটের ব্যবধানে, যা ভোটারদের পছন্দের বৈচিত্র্যের ইঙ্গিত দেয়।

ভোটের হারও এবার বেড়েছে। গতবার (২০১৩ সালে) ছিল যা ৪৫ শতাংশ, এবার তা অন্তত ৯ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ নবীন গণতন্ত্রের প্রতি ভুটানবাসী আগ্রহ দেখাচ্ছে বলেই মনে হয়। এ বছরেরই শেষার্ধে দেশটিতে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি, তথা পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষেরও নির্বাচন হবে।

রাজতন্ত্রের মাঝেই বিকাশমান ভুটানি ধাঁচের গণতন্ত্রে উচ্চকক্ষের ভূমিকা হলো, সেটা নিম্নকক্ষের কার্যক্রমকে স্বাধীন পর্যালোচনার অধিকার রাখে। তবে দেশের বাজেট প্রশ্নটি নিম্নকক্ষেই ফয়সালা হয়।

উল্লেখ্য, ভুটানি পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের বাড়তি ক্ষমতার কারণেই গত বছর ভারতকে বিশেষ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়েছিল। ভারতীয় স্বার্থে প্রণীত বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-ভুটান-নেপাল যানবাহন চলাচল (বিবিআইএন চুক্তি নামে পরিচিত) চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশ নিজেদের পার্লামেন্টে আলোচনা-পর্যালোচনা ছাড়াই অনুমোদন দিলেও ভুটানের জনপ্রতিনিধিরা তা বাতিল করে দিয়ে দিল্লির নীতিনির্ধারকদের মাঝে সে সময় দারুণ এক বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিলেন।

ভুটানের ন্যাশনাল কাউন্সিলের সর্বশেষ এই নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রের দৃশ্যও বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো দেশের সঙ্গে একদম মেলে না। অনেকটা ইউরোপের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের আদলে উৎসবমুখর সহিংসতামুক্ত পরিবেশে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। বুথগুলোতে ব্যবহৃত হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন। ফলে ৮৬৬টি ভোটকেন্দ্রের প্রায় ৪ লাখ ৩২ হাজার ভোটারের এই নির্বাচনে পরদিনই পূর্ণাঙ্গ ফলাফল ঘোষণা করে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশিরা হয়তো বলবেন, ভুটানের এই ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল’ অরাজনৈতিক ধাঁচের। এতে প্রত্যেক প্রার্থীকে স্বতন্ত্রভাবেই জনপ্রতিনিধি হওয়ার লড়াই চালাতে হয়। এই অভিমত অবশ্য সত্য। ভুটানের উচ্চকক্ষে জনপ্রতিনিধিরা কেউ রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন না, সেই সুযোগ নেই। যাঁর যাঁর স্বতন্ত্র যোগ্যতায় তাঁরা নির্বাচন করেন।

তবে প্রায় এক মাসজুড়ে নির্বাচনী প্রচারকালে দেখা গেছে, ভুটানে ধীরে ধীরে একটা গণতান্ত্রিক আবহ তৈরি হচ্ছে। নির্বাচনে পোস্টাল ভোটেরও বিধান ছিল এবং মোট ভোটের ১৪ শতাংশ ছিল পোস্টাল ভোট, যা প্রদত্ত ভোটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। এও মতামত প্রকাশের এক উন্নত ব্যবস্থার স্মারক ছিল।

তবে দেশটির নিম্নকক্ষেÿদলীয় ভিত্তিতেই ভোট হয় এবং উচ্চকক্ষের সদস্যরা পদে থেকেই পরবর্তী মেয়াদের জন্য লড়তে পারলেও নিম্নকক্ষেÿপ্রার্থীদের পদত্যাগ করেই নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। আগামী ৯ মে বর্তমান উচ্চকক্ষের মেয়াদ শেষ হবে। আর আগামী আগস্টের পর যেকোনো সময় নিম্নকক্ষের পরবর্তী দফা ভোট অনুষ্ঠিত হবে। ধারণা করা হচ্ছে, সেটা অক্টোবরে হবে। নিম্নকক্ষে আসনসংখ্যা হলো ৪৭। এ মুহূর্তে ভুটানে নির্বাচন কমিশনে রেজিস্ট্রিকৃত রাজনৈতিক দল রয়েছে পাঁচটি। এসব দলের মধ্যেই প্রাথমিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। নিম্নকক্ষের সর্বশেষ নির্বাচনে পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে পেয়েছিল ‘ভুটান পিস অ্যান্ড প্রোসপারিটি পার্টি’কে হারিয়ে। নিম্নকক্ষের নির্বাচন হয় দুই রাউন্ডে। প্রথম রাউন্ডের নির্বাচনে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান পাওয়া দল দুটিকে চূড়ান্ত রাউন্ডে প্রার্থী তালিকাসহ লড়তে দেওয়া হয়।

অন্যদিকে, উচ্চকক্ষের নিয়ম হলো, ২৫ সদস্যের উচ্চকক্ষে ২০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন। এই ২০ জন হবেন দেশটির ২০টি জেলার প্রতিনিধি। এভাবে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হওয়া ২০ জনের সঙ্গে ৫ জন সদস্য যুক্ত হবেন রাজার প্রতিনিধি হিসেবে। আপাতত ভুটান গণতন্ত্রের পথে এভাবেই এগোচ্ছে।

তবে এবারের নির্বাচনে বিজয়ী ২০ জনের মধ্যে দুজন নারীও রয়েছেন, যা গত দফায় ছিল না। এটি ভুটানের মতো দেশে খুব সহজ ব্যাপার নয়। একজন নারী প্রার্থী সোনাম পেলজাম তাঁর আসনে ১২ জন পুরুষ প্রার্থীকে পরাজিত করে জিতেছেন। এমনকি ভোট দানের বেলাতেও নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো—প্রায় ৫২ শতাংশ নারী ভোটার ভোট দিয়েছেন। এর মধ্যে যাঁরা বুথে এসে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে পুরুষদের চেয়ে নারী ভোটারই ছিলেন বেশি।

অন্যদিকে, ২০১৩ সালের নির্বাচনে যেখানে প্রার্থীসংখ্যা ছিল ৬৭, এবার তা প্রায় দ্বিগুণ, অর্থাৎ ১২৭ জন হয়েছে। অর্থাৎ আসন প্রতি প্রার্থীসংখ্যা ছিল প্রায় ৫।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, ভুটানের এই গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় বিশেষ প্রভাব রয়েছে নেপালের। নেপালে পুনঃপুন গণতান্ত্রিক অগ্রগতি পার্শ্ববর্তী ভুটানে শাসক দ্রুকপাদের ওপর রাজনৈতিক সংস্কারের প্রচণ্ড চাপ তৈরি করে। তবে চলতি নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা কেবল এই অর্থে ত্রুটিপূর্ণ যে তাতে দেশটির দক্ষিণের নেপালি ভাষাভাষী লোহটসাম্পাদের অংশগ্রহণ একেবারেই কম। পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী দ্রুকপাদরা। দার্জিলিং ও নেপালে বিভিন্ন সময় জন-আন্দোলনকালে ‘বৃহত্তর নেপাল’ শব্দগুচ্ছ উচ্চারিত হওয়ায় এবং সিকিমের ভারতভুক্তিতে নেপালিদের সমর্থন ভুটানের শাসক এলিটদের জাতীয়তাবাদী অংশের মাঝে ভুটানের নেপালিদের সন্দেহের চোখে দেখার প্রবণতা তৈরি করেছে। যার ফলে দেশটিতে নেপালিদের জন্য ক্ষতিকর কিছু আইনকানুন তৈরি হয় এবং সেই আইনকে ভিত্তি করে ১৯৮৮ সালের শুমারিতে দেশের নেপালি ভাষাভাষীদের প্রায় অর্ধেকের নাগরিকত্ব বাতিল করে তাদের অবৈধ অভিবাসী ঘোষণা করে দেওয়া হয়। এমনকি পরে এদের দেশছাড়াও করা হয়। এরূপ নেপালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠই এখন নেপালে শরণার্থী জীবন যাপন করছে।

জাতিগত এই বৈষম্য ছাড়াও ভুটানে গণতন্ত্রের বিকাশের আর কিছু বাস্তব সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন ২০১৩ সালে নিম্নকক্ষের সর্বশেষ ভোটের সময় বড় নির্বাচনী ইস্যু ছিল ভারত কর্তৃক ভুটানে সরবরাহকৃত গ্যাস ও কেরোসিনে হঠাৎ করে ভর্তুকি তুলে দেওয়ার প্রসঙ্গ। চীনের সঙ্গে ভুটানের ক্রমবর্ধমান সুসম্পর্কের কারণে ভারত তখন ওই শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিল বলে অনেক ভুটানবাসীর ধারণা। ফলে ওই নির্বাচনে ভোটাররা ভারত সমর্থক হিসেবে পরিচিত পিপলস পার্টিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ভোট দিয়েছিল। যদিও ভারতীয় পদক্ষেপের আগে দলটির অবস্থা ভোটের বাজারে ভালো ছিল না।

তবে এবার ন্যাশনাল কাউন্সিলের সর্বশেষ ভোটের সামগ্রিক ফলাফল দেখে মনে হয়েছে ভুটানবাসী হতাশ নয় এবং পরিস্থিতিতে পরিবর্তনের লক্ষ্যে হাল ছাড়ছে না তারা। যদিও সেই পরিবর্তনের ঢেউ কতটা বিস্তৃত হবে, তা দেশটির সার্বভৌমত্ব আরও সবল করার লক্ষ্যও সম্প্রসারিত হবে কি না, সেটা দেখার জন্য আরও বহুদিন হয়তো অপেক্ষা করতে হবে।

সংবিধান অনুযায়ী, ন্যাশনাল কাউন্সিলই দেশটির ‘সার্বভৌমত্ব’, ‘জাতীয় স্বার্থ’ এবং ‘নিরাপত্তা’ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে পরামর্শ দেওয়ার অধিকারী। আপাত ন্যাশনাল কাউন্সিল এসব বিষয় পর্যালোচনা করবে কি না, তা অনিশ্চিত হলেও এটা নিশ্চিত যে দেশটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্য দেশগুলোর কাছে এখন থেকে বাড়তি রাজনৈতিক মর্যাদা আশা করতেই পারে। অন্তত বাংলাদেশিদের কাছে—যাঁরা হামেশাই ভুটানকে একটা খারাপ উপমা হিসেবে উচ্চারণ করে নিজেদের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের আত্মশ্লাঘা বোধ করতেন অতীতে।

[নির্বাচনবিষয়ক তথ্য সহায়তা নেওয়া হয়েছে ভুটানের ‘কুয়েনসেল’ এবং ভারতের ‘দ্য অয়্যার’ থেকে]

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক।