Thank you for trying Sticky AMP!!

ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতা, টিকাপ্রাপ্তি ও টিকাদান

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ যে একটি বিপজ্জনক পর্যায়ে আছে, সে বিষয়ে সংশয়ের কোনো কারণ নেই। সরকারি হিসাবেই এখন সংক্রমণের মাত্রা দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশের মতো; মৃতের সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই আগের দিনের রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সরকারি এই হিসাব বিভিন্ন কারণেই অসম্পূর্ণ। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উপসর্গ নিয়ে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁরা এই হিসাবে গণ্য হচ্ছেন না। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় হাসপাতালগুলোর যা অবস্থা, তা থেকে অনুমান করা যায় যে অধিকাংশ রোগী আসলে চিকিৎসাই পাচ্ছেন না। ফলে আক্রান্ত অনেকেই আর হাসপাতালের দিকে পা বাড়াচ্ছেন না।

সংক্রমণের সরকারি হিসাবের বিবেচনায় মৃতের হার এখন ভারতের চেয়েও বেশি। এ ধরনের পরিস্থিতির আশঙ্কা ও আভাস জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আগে থেকেই দিচ্ছিলেন, সরকার এ বিষয়ে গা করেনি। বিশেষজ্ঞদের মতামতের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করার কোনো উদাহরণ নেই। অন্যথায় এই দফা ‘কঠোর বিধিনিষেধ’–এর আগে পণ্য বিক্রি করার মতো ‘ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ছাড়’ দেওয়ার কোনো কারণ ছিল না। এ ধরনের ‘ছাড়’ কোভিড-১৯-এর জন্য ‘বোনাস’-এ পরিণত হবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই তার কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।

এটা হচ্ছে বাংলাদেশে ভাইরাসের দ্বিতীয় (বা তৃতীয়) ঢেউ। ফলে এ রকম অনুমান করা যায় যে প্রথম ঢেউ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ ছিল। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের জুন-জুলাইয়ের ব্যবধান প্রায় ১৫ মাসের। ইতিমধ্যে দুই দফা বাজেট হয়েছে, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প হয়েছে, প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে, বিশ্বব্যাংক-এডিবি থেকে অর্থ সংগ্রহ হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও এখনো কেন আইসিইউর অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছেন, অক্সিজেন ব্যবস্থা ছাড়াই হাসপাতালগুলো করোনা মোকাবিলা করতে বাধ্য হচ্ছে, এই প্রশ্ন তোলাই যায়।

একেবারে গোড়ার কারণ আমাদের সবার জানা। কারণ, এসবের জন্য কেউ দায় নিতে বাধ্য নন, কারও কোনো রকম জবাবদিহি করতে হয় না। পৃথিবীর অন্যত্র কী হচ্ছে, সেটা বললেও যে কিছু লাভ হবে, তা নয়। গত দেড় বছরের ঘটনাপ্রবাহ থেকে মনে হয়, সরকার কেবল একটি শিক্ষা নিয়েছে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা দরকার আর মাঝেমধ্যে বিধিনিষেধ দেওয়া দরকার। সেই ‘লকডাউন’ বাস্তবে আছে কী না, এই ধরনের লকডাউন অনুসরণ সম্ভব কী না, তাতে কারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, কী ভাবে এই ধরনের ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করা যায়-এসব নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে করোনাভাইরাস অতিমারিতে পরিণত হওয়ার পর থেকে সারা পৃথিবী যেসব শিক্ষা নিয়েছে, তার অন্যতম দিকটি এসেছে এই বছরের মার্চের পর। ভাইরাসের এই ভয়াবহতা হ্রাস করার উপায় হচ্ছে কিছু প্রতিষেধক ব্যবস্থা নেওয়া, কিন্তু এ থেকে মুক্তির উপায় একটাই। প্রতিষেধকগুলো হচ্ছে মাস্ক পরা, যতটা সম্ভব সামাজিক দূরত্ব চর্চা করা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, অপ্রয়োজনীয় চলাচল থেকে বিরত থাকা। এর পাশাপাশি যত দূর সম্ভব এমন ব্যবস্থা নেওয়া যাতে মানুষ বিধিনিষেধের সময় নিজের ঘরে থাকতে পারেন, সেই লক্ষ্যে তাঁদের সাহায্য করা; যাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, রাষ্ট্রের কাজ হচ্ছে তাঁদের পাশে দাঁড়ানো।

এগুলো হচ্ছে ভাইরাসের সংক্রমণের উপায়কে দুর্বল করা। এগুলো করলে ভাইরাস চলে যাবে না, কিন্তু কম লোক আক্রান্ত হবেন। ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে একটাই—টিকা নেওয়া। টিকা আবিষ্কারের পর থেকে এটা আশঙ্কা করা হয়েছিল যে এই টিকা নিয়ে ভূরাজনীতির খেলা হবে, ধনী দেশগুলো আগে টিকা পাবে ইত্যাদি। সে জন্যই টিকা সংগ্রহ ও বিতরণের আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম কোভ্যাক্স প্রতিষ্ঠা করা হয়। এতে করে অবস্থার একেবারে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব না হলেও অন্তত ভয়াবহ পরিস্থিতির অনেকটাই এড়ানো গেছে। দরিদ্র ও মাঝারি আয়ের দেশগুলো সামান্য হলেও টিকা পাচ্ছে। যতটা দরকার ততটা পাচ্ছে, এমন নয়।

টিকাপ্রাপ্তির আরেকটি কারণ হচ্ছে ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কারণে বিভিন্ন দেশের টিকা তৈরিতে সাফল্য। চীন ও রাশিয়া কেবল নিজ দেশের নাগরিকের জন্যই নয়, দেশের বাইরে পাঠানোর জন্য টিকা তৈরি করেছে। মানবিক বিবেচনা, বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং ভূরাজনীতিতে নিজেদের প্রভাববলয় বৃদ্ধি—এই তিন উদ্দেশ্যে টিকা তৈরি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সারা পৃথিবীর শিক্ষা হচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য টিকার ব্যবস্থা করা এবং তাঁদের টিকা দেওয়া।

টিকা তৈরি ও এর প্রাপ্তির গোড়াতে বাংলাদেশের সরকার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের ওপরে এককভাবে নির্ভর করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সরকারের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের টিকাপ্রাপ্তির জন্য একটি বড় ধরনের বিপদের সূচনা করেছিল। ভারতে ভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণ ও মৃত্যুর কারণে পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে। ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় চীন আবারও এগিয়ে আসে। গত দুই মাসে বাংলাদেশ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উপহার হিসেবে, চীনের কাছ থেকে ক্রয়সূত্রে, কোভ্যাক্সের মাধ্যমে এবং জাপানসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে টিকা পেয়েছে; আরও টিকা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে। কিন্তু যতক্ষণ না টিকা মানুষকে দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এগুলোর কার্যকারিতা নেই।

করোনাকালের দুই বাজেটের কোনোটিতেই স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সাহায্যের বিষয়কে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখনকার পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।

ফলে এখন প্রথম কাজ হচ্ছে টিকা প্রদান কার্যক্রমকে গতিশীল করা, ব্যাপকভাবে টিকা দেওয়া এবং টিকা দেওয়ার ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা। প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে, দেশে টিকা দেওয়ার যে সক্ষমতা আছে, সেই তুলনায় টিকা দেওয়া হচ্ছে না। সরকারের হাতে এখন যে টিকা আছে, তার পরিমাণ ২৬ জুলাই পর্যন্ত সাড়ে চার লাখের মতো। ইতিমধ্যে ১ কোটি ২৬ লাখের বেশি মানুষ নিবন্ধন করেছেন এবং এ সংখ্যা অবশ্যই আরও বাড়বে। যে পরিমাণ টিকা আছে, তাতে দেশের সবাইকে এখনই টিকা দেওয়া সম্ভব না হলেও যত বেশি লোককে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে, বিপদের আশঙ্কা ততই কমবে। এখন সরকারের প্রথম কাজ হচ্ছে, এ বিষয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, আগামী বছরের শুরু নাগাদ দেশে ২১ কোটি টিকা আসবে। ২৬ জুলাই পর্যন্ত দেশের ২ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে, এটি ৬০-৭০ শতাংশে উন্নীত না করা পর্যন্ত পরিস্থিতি নিরাপদ বলে বিবেচনা করা যাবে না। টিকা দেওয়ার বর্তমান হার অব্যাহত রেখে এই পর্যায়ে উপনীত হওয়ার জন্য দীর্ঘ সময় লাগবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ইতিমধ্যে কী করা হবে। গত দেড় বছরে অভিজ্ঞতা হচ্ছে, সরকারের সব পদক্ষেপই অ্যাডহক ভিত্তিতে। বারবার বলা সত্ত্বেও অতিমারি মোকাবিলায় কোনো রকমের সমন্বিত ও পরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। অর্থনীতি সচল রাখার কথা বলে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো এভাবে অব্যাহত রেখে প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলা যে নিরর্থক, অর্থনীতিবিদেরা তা সুস্পষ্ট করেই বলেছেন (প্রথম আলো, ১৬ জুন ২০২১)। স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বলেছেন, ‘জীবন আগে, অর্থনীতি পরে’।

এ রকম পরিস্থিতিতে যা দরকার, তা হচ্ছে একটি জরুরি পরিকল্পনা। স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, দরিদ্র মানুষের জীবিকা এবং শিক্ষা—এই চার খাতকে সামনে রেখে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ চিহ্নিত করা এখন অবশ্যকরণীয় কাজ। এর কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা—কবে নাগাদ কত টিকা পাওয়া যাবে, কবে নাগাদ কীভাবে কতজনকে টিকা দেওয়া যাবে, সে বিষয়ে স্বচ্ছ পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার মেয়াদ ৯ মাস হবে না ৬ মাস হবে, সেটা নির্ধারিত হবে টিকা পাওয়া ও দেওয়ার ভিত্তিতে।

সরকারের কাছে সেই তথ্য আছে বলেই অনুমান করছি। কেননা স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, ২১ কোটি টিকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই জরুরি পরিকল্পনায় থাকবে টিকা দেওয়ার হার কোন পর্যায়ে এবং সংক্রমণের মাত্রা কোন পর্যায়ে গেলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এতে করে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবেন, তাঁদের নিজেদের স্বার্থেই এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য কাজ করা দরকার। এর পাশাপাশি সরকার হাসপাতালগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে কী ধরনের সাহায্য করতে সক্ষম এবং কী ধরনের সূচকের ভিত্তিতে এসব সাহায্য দেওয়া হবে, সেটা জানানো। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যেখানেই সম্ভব ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপন করা দরকার। বাংলাদেশের বিভিন্ন বাহিনীর সেই সামর্থ্য আছে, এর জন্য আলাদা বরাদ্দেরও দরকার হবে না।

করোনাকালের দুই বাজেটের কোনোটিতেই স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সাহায্যের বিষয়কে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এখনকার পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে সরকার নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বিষয়টি স্বীকার করতে চায়নি, অনিচ্ছায় হলেও এখন তা স্বীকার করছে। প্রচলিত কায়দায় করা বাজেট এবং দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে অবস্থার মোকাবিলা করলে কেবল যে সময়ই লাগবে তা নয়, প্রাণহানি বাড়বে; অর্থনীতিরও লাভ হবে না। জনস্বার্থ ও জনস্বাস্থ্য—কোনোটির দিকে গত দেড় বছরে নজর দেওয়া হয়নি। এখনো যদি নজর না দেওয়া হয়, তবে আর কবে দেওয়া হবে?

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট