Thank you for trying Sticky AMP!!

ভোটার না থাক ভোট তো আছে!

সকাল ১০ টায় দারুত তামীল মাদ্রাসা কেন্দ্র ফাঁকা। সিক্কাটুলি, ১ ফেব্রুয়ারি। ছবি: দীপু মালাকার

‘ভুট দিয়া কী কাম। কেডা পাশ করতাছে, কেডা ফেল করতাছে আফনেও জানেন, আমিও জানি। এই কারণে পাবলিক আসে নাই।’

সবুজবাগের বৌদ্ধমন্দির এলাকার কমলাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ভোট কেন্দ্রের সামনে দাঁড়ানো মাঝবয়সী এক বাদামওয়ালা বলছিলেন। তাঁকে বললাম, ‘তাহলে এই যে ভোটকেন্দ্রের সামনে তিরিশ চল্লিশ জন লোক, এরা কারা?’ তিনি বললেন, ‘বেবাকের গলায় দেহেন দড়ি বান্ধা। অ্যারা ভুটার না, ভলেন্টিয়ার।’ দেখলাম, কথা সত্য। প্রায় সবার গলায়ই ঝুলছে প্রার্থীদের কর্মীদের কার্ড। তাঁরা জটলা পাকিয়ে আছেন।

বেশ দূরে রাস্তার ওপর ছোট টেবিল পেতে নৌকার মেয়রপ্রার্থীর কর্মীরা ভোটারদের ভোটার স্লিপ দিচ্ছেন। সেখানে মোট তিনজনকে জাতীয় পরিচয়পত্র হাতে স্লিপ নিতে দেখা গেল।

তাঁদের একজনকে বললাম, ‘ভোট কেমন দেখছেন ভাই?’ এর চেয়ে আহাম্মকি প্রশ্ন তিনি জীবনে শোনেননি—এই রকমের একটা চাউনি দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘খারাপ কী? আমার কাছে তো ভালোই মনে হচ্ছে।’ বললাম, ‘না, মানে, লোকজন নাই, ভোট দিতে উৎসাহ পাচ্ছেন?’ ভদ্রলোক মৃদু হাসলেন। বললেন, ‘লোকজন নাই বলেই তো ভোট দিতে আসছি। ফাঁকা মাঠে শান্তিমতো ভোট দিয়ে চলে যাব। ভিড় থাকলে তো আসতাম না।’

জটলা পাকিয়ে থাকা স্বেচ্ছাসেবকদের একজনের কাছে গিয়ে বললাম, ‘ভাই, ভোট নিয়ে এক মিনিট কথা বলা যাবে?’ তিনি বললেন, ‘বলেন।’

বললাম, ‘ভোটার তো একেবারেই নাই। এর কারণ কী?’ তিনি বললেন, ‘মাত্র তো সাড়ে দশটা বাজে। একটার মধ্যে লোক চলে আসবে।’ বললাম, ‘আপনাদের বিপক্ষের কাউকে দেখি না যে।’ তিনি বললেন, ‘না আসলে কি আমরা জোর করে ধরে আনব?’ খুবই যুক্তিসংগত কথা। কেউ না এলে তাঁকে ধরে আনার কোনো বিধান নেই।

মালিবাগ, খিলগাঁও, সিদ্ধেশ্বরী এলাকাতেও একই দৃশ্য চোখে পড়ল। সেখানেও ভোটার নেই। ভলান্টিয়ার আছে। অতি অদ্ভুত ঘটনা হলো, ভোটকেন্দ্রের আশপাশে কোথাও কোনো নারীকেই দেখলাম না। নারীদের এই একচেটিয়া ভোট বিমুখতায় হতাশ হতে হলো।

যে রিকশায় চড়ে বিভিন্ন কেন্দ্রে যাচ্ছিলাম, সেই রিকশার চালক বললেন, ‘ভোটার আসে নাই, ভালো হইছে। ভোটের চাইতে মানুষের জীবনের দাম বেশি। ভোটার আসলে মারামারি লাগত। মাথা ফাডাফাডি লাগত। পরিবেশ নিরিবিলি আছে, এইডাই শান্তি।’

রিকশা কারওয়ান বাজারের দিকে যাচ্ছিল। দেখলাম রাস্তাঘাটে আসলেই শান্তির পরিবেশ। কোনো বাস-ট্রাক নাই। হর্ন নাই। রিকশা-অটোরিকশায় বা মিনি ট্রাকে ‘উচ্চৈঃশ্রবা’ লাউডস্পিকারে নির্বাচনী সংগীত নাই। শুঁটকি খোলায় রোদে টাঙানো চিকন দড়িতে ঝুলতে থাকা সারি সারি শুঁটকি মাছ যেভাবে মৃদু বাতাসে বোটকা গন্ধ ছাড়তে ছাড়তে দোল খায়, অবিকল সেইভাবে মহল্লার অলিতে গলিতে দুই ফুট পর পর টাঙানো সুতলিতে হাজার হাজার ল্যামিনেটেড পোস্টার দুলছে। প্রেমেন্দ্র মিত্রের নীলকণ্ঠ কবিতার সেই হাওয়াই দ্বীপের ‘নোনা হাওয়ার দমকে দমকে যেমন নারকেল বনের দোলা’।

ধানমন্ডির মল্লিক প্রিপারেটরি স্কুলকেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগের এজেন্ট ও কর্মীরা। সেখানে বিএনপির এজেন্ট বা কর্মী দেখা যায়নি। ছবি: সুহাদা আফরিন

দুদিন আগে ‘প্রার্থীরা নিজের কেন্দ্রের অলিতে-গলিতে হাত জোড় করে গোবদা মুখে পাঁচন খাওয়ার মতো মুখ করে ভোট প্রার্থনা করে একেকটা রাউন্ড দিয়ে’ এসেছেন। প্রার্থীদের বিনয়াবনত সেই জোড় করতল দেখে ভোটারের নিশ্চয়ই তখন মনে পড়েছে, তার নিজের একটি ভোট আছে। ভোটার জানে, তার ভোট দেওয়া-না দেওয়ার ওপর প্রার্থীদের হারজিত নির্ধারিত হয়। তারপরও তারা ভোট দিতে কেন আসেনি তা এক বিস্ময়।

প্রাচীনকালে ভোটে জেতা যাবে কিনা তা নিয়ে ভোট গণনার সময় পর্যন্ত প্রার্থীদের চিন্তা থাকত। এখন সেই চিন্তা নেই। এখন মূল টেনশন নমিনেশন পাওয়া নিয়ে, ইলেকশন নিয়ে নয়।

রিকশাচালক ভাই বললেন, ‘পাবলিক ভোট দিক তা প্রার্থীরা তো চায়-ই না, মনে কয় উপরওয়ালাও চায় না।’ তাঁর কথায় চমকে গেলাম। আরে! এই কথা তো জে লেনোর। অনেক বছর আগে এই মহান মার্কিন কৌতুকশিল্পী বলেছিলেন—‘আমরা ভোট দিই—এটি যদি ঈশ্বর সত্যিই চাইতেন, তাহলে তিনি প্রার্থীও দিতেন’।

সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক