Thank you for trying Sticky AMP!!

ভোটের জয় অবধারিত

চেম্বারে বসে লিখছি আর পাশের রাস্তায় নৌকার মিছিলের স্লোগান শুনছি। সকাল থেকে তিন-চারবার নৌকার মিছিল গেছে। গত কয়েক দিনে ধানের শীষের কোনো স্লোগান কানে আসেনি। হাতপাখার পক্ষে একটা মিছিল থেকে স্লোগান কানে এসেছিল দুই-তিন দিন আগে। বলা বাহুল্য, ভোটের পোস্টারেও কোনো বৈচিত্র্য নেই। শুধু নৌকার পোস্টারই চোখে পড়েছে, আর কারও ছবি দেখার সৌভাগ্য হয়নি।

দুই দিন আগে চুল কাটাতে সেলুনে গিয়েছিলাম। বহু বছর ধরে একই সেলুনে চুল কাটাই, তাই তারা বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছে। চুল কাটার সেলুনের কর্মীদের জন্য জুতসই বাংলা শব্দ এখনো চালু হয়নি। ইংরেজিতে ‘বার্বার’, নব্বইয়ের দশক থেকে যে শব্দটি ইংল্যান্ডে চালু হয়েছে সেটা ‘হেয়ার স্টাইলিস্ট’। বাংলার পুরোনো শব্দটাই ব্যবহার করছি—ক্ষৌরকার। ক্ষৌরকার চুল কাটতে কাটতে বলেছিলেন, ‘স্যার, জানেন তো, আমরা বহু বছর ধরে আয়োডিনযুক্ত লবণ খাই। এমনকি বস্তার লবণেও পর্যাপ্ত আয়োডিন থাকে।’ চট করে মন্তব্যের মর্মার্থ ঠাওর করতে পারিনি। অধমের চেহারায় হয়তো একটা বোকা বোকা ভাব ফুটে উঠেছিল। বুঝতে পেরে ক্ষৌরকার ব্যাখ্যা দিলেন, ‘দেশে এখন কেউ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নাই। আগে লবণে আয়োডিন থাকত না। এখন সব লবণেই আছে।’ তাঁর কথার ইঙ্গিতটা স্পষ্ট হলো। মিছিল-পোস্টারে খুব বেশি কিছু যায়-আসে না।

২.

মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাড়া আমাদের ৪৮ বছরের ইতিহাসে গত তিনটি মাস ছিল সবচেয়ে বেশি ঘটনাবহুল। এই তিন মাসে অনেক বড় বড় এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য বিগত প্রায় ৫০ বছরে আমাদের বড় সব রাজনৈতিক ঘটনাগুলো ছিল অপ্রত্যাশিত। ১৯৭০-এর অনেকটা এই সময়ের মতো সময়ে, অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষে নির্বাচনে নৌকার বিশাল ও অপ্রত্যাশিত জয়ের পর কেউ যদি বলত, এক বছরের মাথায় এই দেশ বিশাল একটা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়ে যাবে, তাহলে সেটা হতো খুবই অপ্রত্যাশিত। কিন্তু সেই অপ্রত্যাশিতটাই কয়েক মাসের মধ্যে হয়ে পড়েছিল অবধারিত। প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল। বিজয় এসেছিল।

১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ বিরোধীদের প্রার্থী ড. কামাল হোসেনকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পরের সপ্তাহে কেউ যদি বলত যে ছয় মাসের মধ্যেই এই নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে বন্দুকের নল উঁচিয়ে অপসারণ করতে বাধ্য করা হবে, তবে সেটা হতো সাংঘাতিকভাবে অপ্রত্যাশিত। আবারও সেই অপ্রত্যাশিতটাই ঘটল ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ। বন্দুকের নলের হুমকি দিয়ে ক্ষমতায় এলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

আমাদের রাজনীতিতে অপ্রত্যাশিত ঘটনার ফিরিস্তি দীর্ঘায়িত না করে শুধু আরেকটি কেচ্ছা দিয়ে শেষ করব। সম্মিলিত গণ-আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯০-এর ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে স্বৈরাচারী এরশাদের পদত্যাগের পর সেই ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে কেউ যদি বলত যে এই এরশাদ আরও প্রায় ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি নিয়ে অনবরত এবং ক্রমাগতভাবে ভেলকিবাজি করবেন, তাহলে সেটাও হতো খুবই অপ্রত্যাশিত। আবারও সেই অপ্রত্যাশিতটাই সত্য। এই ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে এসেও এরশাদের ভেলকিবাজি চলছে জোরেশোরে।

৩.

এই নির্বাচন নিয়েও গত তিন মাসে অনেকগুলো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেছে এবং অনেক হিসাব-নিকাশ সম্পূর্ণ বিফলে গেছে। ফলে ৩০ ডিসেম্বর নিয়ে যঁারা আগেভাগেই কিছু নির্দিষ্ট হিসাব করে রেখেছেন তা না–ও মিলতে পারে।

কমবেশি মাস তিনেক আগেও, অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরের শুরুতে কেউ যদি বলত যে সব কয়টি আসন থেকে জোরেশোরে নির্বাচন করবে ধানের শীষ, তাহলে সেটা সম্ভবত হতো অপ্রত্যাশিত চিন্তা। সেই সময়েই কেউ যদি আরও বলত, ধানের শীষ নিয়ে শুধু নির্বাচনই হবে না, অধিকন্তু ধানের শীষের বাইরের অনেকেই ধানের শীষে প্রধান ও শীর্ষ নেতৃত্বে চলে আসবেন এবং খালেদা জিয়া ছাড়াই নির্বাচনী মাঠে সব খেলা হবে, তাহলে সেটাও হতো অপ্রত্যাশিত। তিন মাস আগে এই গোছের অপ্রত্যাশিত অনেক কিছুই এখন স্বাভাবিক হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন পারেনি, পুলিশও পারেনি। কিন্তু আদালত গোটা বিশেক আসনে ধানের শীষকে থাকতে দেননি, আইনের একটা ভুল ব্যাখ্যার বশবর্তী হয়ে পরবর্তী সময়ে ভুল ব্যাখ্যাটা শোধরালেও এই ২০টি আসনে ধানের শীষ নেই। তবে আছে বাকি সব কটিতেও। সকালে আশঙ্কা ছিল, আদালতের বলিষ্ঠ ভূমিকায় আরও ২৫টি আসন থেকেও ধানের শীষ খারিজ না হয়ে যায়। দুপুরে জানলাম, এই ২৫টি রক্ষা পেয়েছে।

২০১৭ আর ২০১৮ সালের প্রায় পুরোটা সময় এক গান যে কতবার বেজেছে তার হিসাব আমরা কেউই রাখিনি। নো সংলাপ, নো সংলাপ গানটা। অনেক বড় বড় গায়ক বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন সুরে বলে বেড়িয়েছিলেন, বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা বা সংলাপের প্রশ্নই আসে না। নো সংলাপই ছিল প্রত্যাশিত। হঠাৎ সবকিছু বদলে গেল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায়। নভেম্বরের কমবেশি ১০ দিন ধরে অনেক দলের সঙ্গে সরকারি দলের সংলাপ-ডায়ালগ সবই হয়েছিল। নো সংলাপের দেশে সংলাপটাই ছিল গণতন্ত্রের অপ্রত্যাশিত সাফল্য।

অক্টোবরের প্রথমে কেউই নিশ্চয়ই ভাবতে পারেনি যে ডিসেম্বরের শেষে ১২ হাজার প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন দলের মনোনয়ন ফরম ক্রয় করবেন। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর—এত অল্প সময়ে এত বড় পরিবর্তন যে হতে পারে, সেটার প্রত্যাশা নিশ্চয়ই কেউ করেনি। বহুদিন ধরেই নিয়োগ-বাণিজ্যের বহু খবর পত্রপত্রিকায় পড়েছি। কিন্তু এই দেশে হঠাৎ করে এত বিশাল মনোনয়ন-বাণিজ্যের যে গুজব রটবে, সেটাও নিশ্চয়ই অক্টোবর মাসে কেউই স্বপ্নেও ভাবেনি।

নির্বাচন কমিশনের কাছে বিশেষ কোনো প্রত্যাশা ছিল না। যে দুই-চার আনা ছিল, সেই প্রত্যাশাও পূরণ হয়নি বললেও ভুল হয়তো হবে না। নির্বাচন কমিশন যে বলিষ্ঠ কোনো পদক্ষেপ নেবে না, সেটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবে অপ্রত্যাশিত ছিল পুলিশের ভূমিকা। অক্টোবরে ধারণা ছিল, পুলিশ হয়তো কোথাও কোথাও একটু পক্ষপাতিত্ব করবে কিন্তু গত এক মাসে পুলিশ যে ভীমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, সেটা ছিল সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। নিকট ভবিষ্যতে আমাদের করের টাকার পরিবর্তে বেশির ভাগ পুলিশের বেতন-ভাতাদি যদি সরকারি দলের ফান্ড থেকে আসে, তাহলে আমরা সবাই উপকৃত হব। যার যেই ভূমিকা তার জন্য প্রাপ্য স্বীকৃতি তো তাকে দিতেই হবে।

৪.

এই অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক ঘটনার দেশে ৩০ ডিসেম্বরও অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে অবাক হওয়ার থাকবে না। পোস্টার-প্রচারণাবিহীন নির্বাচনে পুলিশের হামলা-মামলায় পালিয়ে বেড়ানো প্রার্থী ও কর্মীদের সঙ্গে সঙ্গে এই দেশের সাড়ে ১০ কোটি ভোটারের প্রায় সবাই ভোটকেন্দ্রে হাজির হবেন, ভোট দেবেন এবং তাঁরাই যে এই দেশের মালিক, সেটা আবারও প্রমাণ করবেন। ন্যায়সংগত মালিককে যতই হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি, জোর-জুলুমই করেন না কেন, সে ফিরে এসে তার মালিকানা প্রতিষ্ঠা করবেই। মালিক মাঝেমধ্যে একটু দমে যেতে পারে, আড়ালে-আবডালে চলে যেতে পারে কিন্তু সেটা ক্ষণিকের। যার মালিকানা সংবিধানসিদ্ধ এবং ন্যায়সংগত, সে সেই মালিকানা রক্ষার লড়াইয়ে কখনো হেরে যাবে না।

আমাদের রাজনীতিটা হলো হিসাব-নিকাশ না মেলার রাজনীতি। ৩০ ডিসেম্বরে আগের সব ছক, হিসাব, প্ল্যান এ, প্ল্যান বি ইত্যাদি সবকিছুই বাতিল হয়ে যাবে। কারণ, এই দেশের নাগরিকেরা ভোট দেবেন, সব বাধাবিপত্তি, ভয়ভীতি উড়িয়ে দিয়ে।

ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক