Thank you for trying Sticky AMP!!

ভয় ভয় এবং ভয়!

ঈদে বাড়ি যাওয়া উপলক্ষে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার দিন কয়েক আগে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন দামি স্বর্ণালংকার কাছাকাছি থাকা আত্মীয়স্বজনের কাছে রেখে যেতে। তাঁর পরামর্শ শুনে মনে প্রশ্ন জেগেছে, রাষ্ট্র ও সরকারের কাজটা আসলে কী? কেন আমাদের রাষ্ট্র ও সরকারের প্রয়োজন হয়?

১৮ বছর ইউরোপে থাকছি। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছি; সেও অনেক বছর হয়েছে। প্রায়ই ভাবি, এবার দেশে ফেরার সময় হয়েছে। এরপরই মনে প্রশ্ন জাগে, হাজার রকম ভয় নিয়ে বেঁচে থাকতে পারব তো? আবার মনে হয়, দেশের মানুষ তো দিব্যি বেঁচে আছে। এরপর মনে হয়, এসব মানুষ হয়তো এক জীবনে জানতেই পারবে না ভয়হীন জীবন আসলে কেমন। রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে কোনো ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া হয়তো নেই। বলছি না রাষ্ট্র আমাদের একটা চাকরি দিয়ে দেবে, যাতে আমরা নিরাপদে বেঁচে থাকতে পারি। বলছি না, রাষ্ট্র এসে আমাদের বাড়ি-গাড়ি বানিয়ে দেবে। কিন্তু সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তো রাষ্ট্র ও সরকারেরই। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক।

ধরুন আপনার মনে হলো ঢাকা শহর থেকে বের হয়ে পাশের কোনো জেলায় ঘুরতে যাবেন। শুধু এই ঘুরতে যাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যেই কতটা ‘ভয়’ লুকিয়ে আছে; সেটা আমি দেশে থাকতে সেই অর্থে কখনো বুঝতে পারিনি। কিন্তু দীর্ঘদিন ইউরোপে থাকার পর শেষবার যখন দেশে গেলাম, পরিবারের সবাই মিলে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাব—এরপরই হাজার রকম ‘ভয়’ এসে ভর করেছে!

পুরো বাসা ফাঁকা রেখে কীভাবে যাব! বাসা ফাঁকা রেখে কি যাওয়া সম্ভব! যদি চুরি-ডাকাতি হয়ে যায়! এ নিয়ে সবার মধ্যে একটা ‘ভয়’। আত্মীয়স্বজন সবাই বলছেন, বাসা একদম ফাঁকা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। কাউকে না কাউকে বাসায় রেখে যেতে হবে। কেন একটা রাষ্ট্রের নাগরিকের মধ্যে এ ভয় কাজ করবে—বাসা ফাঁকা রেখে গেলে চুরি-ডাকাতি হবে? ফাঁকা রেখে যাওয়া যাবে না। বলছি না অন্যান্য দেশে চুরি-ডাকাতি হয় না। অবশ্যই হয়। কিন্তু এর মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায়নি যে মানুষকে বেড়াতে যাওয়ার সময়ও ভয়ের সঙ্গে চিন্তা করতে হবে, বাসা ফাঁকা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না!

গাড়ি করে ঘুরতে বের হয়েছেন। মাঝরাস্তায় যে দুর্ঘটনায় পড়বেন না, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমার বাসার লোকজন বলাবলি করছিলেন, ব্যক্তিগত গাড়িতে করে যাওয়ার দরকার নেই। এর চেয়ে বাসে যাওয়া ভালো হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি দুর্ঘটনা হলে আর বাঁচার সম্ভাবনা নেই। বাস দুর্ঘটনা হলে অন্তত বাঁচার একটা ‘সুযোগ’ আছে। দেশের নাগরিকেরা বেড়াতে যাবে, সেখানেও তাদের চিন্তা করতে হচ্ছে দুর্ঘটনায় বেঘোরে মরতে হবে কি না! এমন না, অন্যান্য দেশে দুর্ঘটনা হয় না। কিন্তু মাত্রা নিশ্চয় এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেনি, যেখানে সর্বক্ষণ ভয়ে থাকতে হয়, দুর্ঘটনায় মরে যেতে হয় কি না! তা ছাড়া রাস্তা দিতে হাঁটার সময় বাস কিংবা যেকোনো গাড়ির ধাক্কায় মরতে হয় কি না, আজকাল এ নিয়েও বাবা-মায়েরা ভয়ে থাকেন।

বাসা ফাঁকা রাখা কিংবা ঘুরতে যাওয়ার কথা বাদই দিলাম। ধরুন নিজের বাসার ভেতরেই মনের আনন্দে থাকতে চাইছেন। সেটাও তো সম্ভব নয়। বাসার ভেতরে বসে আরামে খাবেন এবং ঘুমাবেন। সেখানেও হাজারটা ভয়! যা খাচ্ছেন, সেটায় ভেজাল আছে কি না! ভেজাল খাবার খেয়ে পেট খারাপ হবে কি না, তা নিয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে মানুষকে। কেমন খাবার কিনবেন, কোথা থেকে কিনবেন—এসব ভাবতে ভাবতেই গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। চারদিকে একটা ভয়—ভেজাল না তো! রাতে নিজের বাসায় ঘুমাচ্ছেন! হঠাৎ মাইকের শব্দে ঘুম ভেঙে যেতে পারে! আশপাশের কেউ নিজের ইচ্ছায় মনের আনন্দে মাইক বাজিয়ে প্রচার-প্রচারণা করছে। আপনার রাতের ঘুমের বারোটা বাজিয়ে তারা মনের আনন্দে মাইক বাজিয়ে যাচ্ছে!

শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, ছোটখাটো রোগ মানুষের মধ্যে লেগেই আছে। প্রতিবার দেশে গেলে যে বিষয়টা লক্ষ করছি, আমাদের নাখালপাড়ার প্রতিটা গলিতে মুদিদোকানের চেয়ে ফার্মেসির সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এ ফার্মেসির মালিকেরা নিশ্চয় দেশসেবা করার জন্য দোকান খুলে বসেননি। মানুষের ওষুধপথ্যের চাহিদা আছে বলেই হয়তো ব্যবসা খুলে বসেছেন। এ থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, মানুষের স্বাস্থ্যের অবস্থা কী।

শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, ছোটখাটো রোগ মানুষের মধ্যে লেগেই আছে। প্রতিবার দেশে গেলে যে বিষয়টা লক্ষ করছি, আমাদের নাখালপাড়ার প্রতিটা গলিতে মুদিদোকানের চেয়ে ফার্মেসির সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এ ফার্মেসির মালিকেরা নিশ্চয় দেশসেবা করার জন্য দোকান খুলে বসেননি। মানুষের ওষুধপথ্যের চাহিদা আছে বলেই হয়তো ব্যবসা খুলে বসেছেন। এ থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, মানুষের স্বাস্থ্যের অবস্থা কী। ধরুন আপনার শরীর খারাপ। চিকিৎসকের কাছে দেখাতে যেতে হবে? সেখানেও সমস্যা! কোন চিকিৎসকের কাছে যাব? সঠিক চিকিৎসা পাব তো? নাকি আবার দেশে বাইরে দৌড়াতে হবে ইত্যাদি। অর্থাৎ সব সময় একটা ভয় ও শঙ্কার মধ্যেই মানুষকে থাকতে হচ্ছে।

এসব নিয়ে প্রতিবাদ করতে যাবেন? তাতেও সমস্যা! পুলিশ এসে বিনা অপরাধে ধরে নিয়ে যাবে। কিংবা নানা ধরনের হয়রানি করবে। এই তো গতকাল রোববারই কলাবাগানে খেলার মাঠে স্থাপনা নির্মাণ করার সামান্য প্রতিবাদেই মা-ছেলেকে ধরে গিয়েছে। অর্থাৎ মনখুলে নিজের মত প্রকাশ করব, এতেও ভয়! কখন না জানি কী আবার হয়ে যায়!

Also Read: ডিএমপির পরামর্শই যথেষ্ট নয়

অথচ দেশে এসব মানুষ জানতেও পারবে না পৃথিবীর অপর প্রান্তের অনেক দেশের নাগরিকদের কখনো চিন্তা করতে হয় না বাসা ফাঁকা রেখে গেলে সমস্যা হবে কি না। রাস্তায় বের হয়ে দুর্ঘটনায় বেঘোরে মরতে হবে কি না কিংবা ভেজাল খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ভয়! বলছি না এসব সমস্যা অন্যান্য দেশে নেই। কিন্তু এর মাত্রা এতই কম যে মানুষকে এসব নিয়ে অন্তত প্রতিদিন ভয় পেতে হয় না। কারণ, তাদের রাষ্ট্র ও সরকার এ দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। রাষ্ট্র ও সরকার তাদের সেই নিরাপত্তা দেয়। তাই তারা সরকারের কাঁধে সেই দায়িত্ব দিয়ে নিরাপদে নিজদের জীবন যাপন করতে পারে।

আমরা কী করে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগোব? আমরা কী করে সৃজনশীল হব? আমরা কী করে ভালো কিছু সৃষ্টি করব? আমাদের তো দিনরাত ভয়ে থাকতে হয় এটা-ওটার জন্য। আমি নিজেই তো দেশে ফিরতে চাই। নিজের দেশকে ভালোবাসে না—এমন মানুষ নিশ্চয় খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে। কিন্তু যখনই মনে হয় বাসা ফাঁকা রেখে গেলে চুরি-ডাকাতির ভয় আছে; এমনকি পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত পরামর্শ দেবে, আশপাশের আত্মীয়স্বজনের বাসায় জিনিসপত্র রেখে যেতে, তখন তো আর দেশে ফিরতে ইচ্ছা করে না। আর যার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই, সে কী করবে? কেন আমাদের এই নিরাপত্তাটুকু দেওয়া যাবে না? কেন আমাদের রাস্তায় বের হলে ভয়ে থাকতে হবে দুর্ঘটনায় মরে যেতে হয় কি না? কেন রেস্তোরাঁয় বসে খাবার খেতে গেলে ভয়ে থাকতে হয় ভেজাল আছে কি না! পেট খারাপ হবে কি না!

রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া নেই। কিন্তু এসব সামগ্রিক বিষয় তো সরকারকেই দেখতে হবে। তা না হলে রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকা আসলে কোথায়? কেন আমাকে চিন্তা করতে হয় দেশে গেলে ভেজাল খাবার খেয়েই মরতে হয় কি না। দরকার নেই দেশে যাওয়ার। কেন আমাকে চিন্তা করতে হয়, ঢাকার রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কা খেয়েই হয়তো আমাকে মরতে হবে। কেন আমাকে চিন্তা করতে হচ্ছে মুক্তমত প্রকাশ করলে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাবে। নইলে গুম হতে হবে?

আমি দেশে ফিরতে চাই। আমার সুযোগ আছে বিদেশে থাকার, তাই হয়তো এসব ভেবে এখনো বিদেশেই পড়ে আছি। কিন্তু আমার মতো দেশের কোটি নাগরিক নিজ দেশে ভয়হীনভাবে বেঁচে থাকতে চায়। তাদের অনেকের হয়তো সুযোগ নেই বিদেশে গিয়ে ভয়হীনভাবে জীবন-যাপন করার অথবা অনেকে হয়তো বিদেশে গিয়ে থাকতে চান না। এই ভয়গুলো দূর করার দায়িত্ব তো রাষ্ট্র ও সরকারের। সেটা না করে কেন আপনারা উল্টো সেই ভয়গুলো বাড়িয়ে দিচ্ছেন?

  • ড. আমিনুল ইসলাম সিনিয়র লেকচারার, ক্রিয়েটিভিটি অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগ। এস্তনিয়ান এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ইউনিভার্সিটি।
    ই-মেইল: aminulislam1255@yahoo.com