Thank you for trying Sticky AMP!!

মতিউরের রক্তে ছিল শাশ্বত মুক্তির গান

গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ছাত্র–জনতা মতিউরকে হাসপাতালে নিয়ে যায়

২৪ জানুয়ারি ঢাকা পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। দোকানপাট সবকিছু বন্ধ। ছাত্রদের ডাকে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী রাজপথে নেমে আসেন। কারখানা থেকে শ্রমিকেরা মিছিলে আসেন, দোকান বন্ধ রেখে দোকানদারেরা মিছিলে আসেন। রিকশাচালক, বেবিট্যাক্সির চালকেরাও আসেন। সকালে ইপিআরটিসির দু-একটা বাস চলছিল। ছাত্ররা পিকেটিং করে তা–ও বন্ধ করে দেন। গোটা শহরে পুলিশের টহল গাড়ি ছাড়া আর কোনো যানবাহন ছিল না। সব মিছিলের গন্তব্য সচিবালয়। সেটাই তখন ক্ষমতা-কেন্দ্র ভাবা হতো। আন্দোলনকারীরা একপর্যায়ে গেট ভাঙার চেষ্টা করেন। আবার কেউ গোল্লা পাকানো চট কেরোসিনে ডুবিয়ে আগুন লাগিয়ে সচিবালয়ের ভেতরে ছুড়ে মারেন। পুলিশ-ইপিআর তাঁদের রুখতে চেষ্টা করে। কিন্তু সচিবালয়ের চারপাশে হাজার হাজার মানুষ। তাদের সঙ্গে গুটিকয়েক ইপিআর-পুলিশ কীভাবে পারবে। প্রথমে দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হয়। ধাওয়া–পাল্টাধাওয়া চলে। পরে ইপিআর গুলি চালায়। প্রথমে সেখানে গুলিবিদ্ধ হয় রুস্তম নামের এক কিশোর। পরের গুলিটি এসে লাগে মতিউরের বুকে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজপথে ঢলে পড়েন। রক্তে তাঁর শার্ট ভেসে যায়। পুলিশ রুস্তমের লাশ ছিনিয়ে নিলেও মতিউরের লাশ নিতে পারেনি। আন্দোলনকারীরা তাঁর লাশ কাঁধে নিয়ে মিছিল বের করেন। প্রেসক্লাবের পাশ দিয়ে ফের পল্টনের দিকে রওনা হয় সেই মিছিল। যেন মিছিল নয়, শহরজুড়ে জনস্রোত। গৃহবধূরা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে মিছিলকারীদের ওপর পুষ্পবৃষ্টি ছড়ান। ইডেনের মেয়েরা মিছিলকারীদের পিপাসা মেটাতে পানি সরবরাহ করেন।

গুলি–টিয়ার গ্যাস কিছুই জীবনের কল্লোল থামাতে পারছে না। মিছিলকারীরা থেমে থেমে স্লোগান তুলছেন—

‘শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না

আইউব শাহি ধ্বংস হোক’...।

ততক্ষণে মতিউরের পরিচয় জানা গেছে। তাঁর শার্টের পকেটে এক টুকরো কাগজে ঠিকানার ওপরে দুটি বাক্য লেখা ছিল।

‘প্রত্যেক মানুষকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে।’ দ্বিতীয় বাক্য ‘কেউ চিরদিন থাকতে পারে না। আজ হোক কাল হোক একদিন যেতে হবে।’ ‘চির’ শব্দটি লিখে আবার কেটে দেওয়া হয়েছে।

মতিউর রহমান মল্লিক। নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণির ছাত্র।

বকশীবাজারে অবস্থিত নবকুমার ইনস্টিটিউট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই। যেকোনো অনুষ্ঠান বা কর্মসূচি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা
সেখানে গিয়ে বক্তৃতা করতেন। মতিউর সেসব বক্তৃতা শুনতে শুনতে নিজেকেও ছাত্রনেতা ভাবতে শুরু করেছিলেন। রাতে পড়াশোনা ও দিনে মিছিল করা তাঁর রুটিন হয়ে পড়েছিল। ২০ জানুয়ারি যেদিন পুলিশ গুলি করে আসাদকে হত্যা করে, সেদিনও মতিউর মিছিলে ছিলেন। কাছ থেকে আসাদকে দেখেছেন। এরপরই বাড়িতে গিয়ে নিজের বইপত্র গুছিয়ে রেখে বললেন, ‘এখন পড়াশোনা নয়। আগে আমাদের জয়ী হতে হবে। তারপর পড়াশোনা ও ক্লাস।’ সত্যি মতিউর জয়ী হয়েছেন। তিনি আর ক্লাসে যাননি। তিনি জীবন দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে জয় ছিনিয়ে আনতে হয়।

পল্টন ময়দান তখন কানায় কানায় পূর্ণ। চারদিক থেকে মিছিল আসছে তো আসছেই। ছাত্র-যুবক, নারী-পুরুষ–বৃদ্ধ সবাই মিছিলে শামিল হয়েছেন। ইতিমধ্যে ছাত্রনেতারা খবর পেলেন, সরকার কারফিউ জারি করবে। পল্টনে তখন শুধু মানুষ আর মানুষ। সমাবেশস্থলে উঁচু বাঁশের মাথায় বাঁধা একটি কালো পতাকা শোকের বার্তা জানান দিচ্ছে শহরবাসীকে। সমাবেশে আসা ছাত্র-জনতা তখন ক্ষোভে ফুঁসছে। এ অবস্থায় ছাত্রনেতারা সভা না করে গায়েবানা জানাজার আয়োজন করেন। সেদিনের সভায় প্রথমবারের মতো আসেন ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক ও ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল্লাহ। হুলিয়া থাকার কারণে তাঁরা এত দিন আড়ালে থেকে আন্দোলনের পক্ষে কাজ করছিলেন।

পল্টন থেকে মতিউরের লাশ নিয়ে বিশাল জনস্রোত ছুটে যায় ইকবাল হলের দিকে। ইকবাল হল তখন ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্র। সেখানে ছাত্রনেতারা মতিউরের রক্তমাখা লাশ ছুঁয়ে শপথ নেন। আইউবের পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থামবে না। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।

ছাত্রনেতারা যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তখনই মতিউরের বাবা আজাহার আলী মল্লিক এলেন। নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা তাঁকে খবর
দিয়েছিল, মতিউর আহত হয়ে হাসপাতালে। তিনি তড়িঘড়ি করে ব্যাংক কলোনি থেকে হাসপাতালের দিকে ছুটে গেলেন। সেখানে খবর পেলের মতিউরের মরদেহ ইকবাল হলে।

তাঁকে দেখে পুরো সমাবেশ শ্রদ্ধাবনত হলো। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও ডাকসুর সহসভাপতি তোফায়েল আহমেদ ঘোষণা দিলেন, এবার শহীদ মতিউরের বাবা কিছু বলবেন। সন্তানের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে বাবা।

দীর্ঘকায় ঋজু মানুষটি মতিউরের লাশের দিকে চোখ রাখলেন। এরপর সমাবেশের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমার এক মতিউর মারা গেছে, দুঃখ নেই। আমি লক্ষ মতিউরকে পেয়েছি।’

তাঁর কথায় মনে হলো সেখানে সমবেত সবাই মতিউর।

সঙ্গে সঙ্গে স্লোগান উঠল,

মতিউরের রক্ত বৃথা যেতে দেব না...।

আরেকবার সমবেত শ্রোতৃমণ্ডলী তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হলো।

কোনো শোক নয়, কান্না নয়। দৃঢ় উচ্চারণ। যেন সন্তানকে দেশের জন্য উৎসর্গ করতে পেরে গর্বিত বাবা।

উনসত্তরের আন্দোলনের অন্যতম নেতা তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন:

ওর (মতিউর) লাশ নিয়ে আমরা পল্টনে গেলাম। এ হত্যার খবর রটে গেল সারা নগরে। তখনই শুনতে পাচ্ছিলাম মোহন খান শহর নিয়ন্ত্রণের ভার ছেড়ে দেবেন। সেনাবাহিনীর চাপে এবং অচিরেই কারফিউ জারি হবে। আমরা পল্টন থেকে ইকবাল হলে চলে এলাম লাশ নিয়ে। কিন্তু ঢাকা শহর তখন হয়ে উঠেছে মিছিলের শহর। আমরা যখন ইকবাল হলে পৌঁছালাম, তখনই রেডিওতে ঘোষণা করা হলো ঢাকা শহরে কারফিউ বলবতের কথা। মতিউরের পকেটে এক টুকরা কাগজ পেয়েছিলাম। ওতে ওর নাম–ঠিকানা লেখা ছিল। কিন্তু ঠিকানা তো নিচে লেখা ঠিকানার ওখানে গোটা গোটা অক্ষরে যা লেখা ছিল, তা মনে হলে এখনো আমার সমস্ত লোমকূপে কী শিহরণ জাগে।

এরপরই সরকারি বেতারকেন্দ্র থেকে ঘোষণা আসে ঢাকা শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান আন্দোলনকারীদের গুণ্ডা-বদমাশ বলে গালাগাল করলেন। শহরে সেনাবাহিনী নামানো হলো। দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেওয়া হলো।

কিন্তু এসব হুমকি–ধমকি ছাত্রদের ঘরে ফেরাতে পারেনি। তারা পণ করেছে, আইউব-মোনায়েম শাহির পতন না ঘটিয়ে তারা ঘরে ফিরবে না।

কারফিউর মধ্যেই ছাত্রনেতারা মতিউরের লাশ নিয়ে তার আবাসস্থল ব্যাংক কলোনিতে গেলেন। সেখানে মতিউরের মায়ের সঙ্গে দেখা করলেন। মা আহাজারি করলেন না। কাঁদলেনও না। শুধু বললেন, ‘আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। তার আত্মত্যাগ যেন ব্যর্থ না হয়।’ ছাত্রনেতারা সন্তানহারা এই মায়ের মনোবল দেখে অবাক হয়েছিলেন।

এরপর কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই মতিউরের আরেক দফা জানাজা হলো। গোপীবাগের পঞ্চায়েত কমিটির কবরস্থানে মতিউরকে দাফন করা হলো।
সেই দাফন অনুষ্ঠানে অনেক মানুষ এসেছিল। সবাই তার বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। ছাত্রনেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তোফায়েল আহমেদ, সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, মাহফুজা খানম, শাজাহান সিরাজ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, সাদেক হোসেন খোকাসহ অনেকেই।

ওই দিন আরও কিছু ঘটনা ঘটে। ক্ষুব্ধ জনতা দৈনিক বাংলা ও মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন দেয়। ক্ষমতাসীন এক মুসলিম নেতার বাড়িতে হামলা করে। আরেক নেতার মালিকানাধীন হোটেল আরজুতে হানা দেয়। কোথাও সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই। সৃষ্টি হয় গণ-অভ্যুত্থান।

দৈনিক বাংলা ও মর্নিং নিউজ ছিল সরকারি পত্রিকা। প্রায় পুরো পত্রিকা আইউব ও মোনায়েম খানের খবরে ভরা থাকত। বিরোধী দলের খবর কম দিত। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও আন্দোলনের খবর দিত বাঁকাভাবে। মিছিলে আসা ছাত্র ও শ্রমিকেরা দৈনিক বাংলা ও মর্নিং নিউজ অফিস পুড়িয়ে দেন। ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা আগুন নেভাতে এলে তাঁরা বাধা দিলেন। এ সময় পুলিশের গুলিতে আরও একজন মারা যান।

২৪ জানুয়ারির হরতাল-খুনের খবর পরদিন সব পত্রিকায় ছাপা হয়। কিন্তু দৈনিক আজাদ ২৬ জানুয়ারি একটি ব্যতিক্রমী রিপোর্ট করে। যার শিরোনাম ছিল, ‘নয়া ইতিহাস লিখেছে ধর্মঘট: রক্তে রক্তে আঁকা প্রচ্ছদপট’। একটি ছবির নিচে পরিচিতি লেখা হয় কবিতায়:

‘মৃতের জানাজা মোরা কিছুতেই করিব না পাঠ

কবরেরও ঘুম ভাঙে জীবনের দাবি আজ এতই বিরাট।’

কবিতার পঙ্‌ক্তি দুটি সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্তের লেখা। সে সময়ে তিনি ছিলেন দৈনিক আজাদ–এর যুগ্ম বার্তা সম্পাদক। (শেষ)

(গতকালের লেখায় শামসুর রাহমানের কবিতার শিরোনাম ‘আসাদের শার্ট’–এর স্থলে আমাদের শার্ট ছাপা হয়েছে। এ জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।)

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com