Thank you for trying Sticky AMP!!

মধ্যপ্রাচ্যে কি শেষ খেলার শুরু

একের পর এক ঘটনার অবতারণা হচ্ছে আরব ও আফগানিস্তান ঘিরে। আফগানিস্তানে তালেবানদের নিয়ে রীতিমতো টানাহেঁচড়া চলছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শান্তি আলোচনাকে মৃত ঘোষণার পরই তালেবানরা মস্কো সফর করেছে। তালেবানরা আফগানিস্তানে ধারাবাহিকভাবে হামলাও করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে ড্রোন হামলা হয়েছে। এরই ফাঁকে ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়ার শীর্ষ নেতারা সিরিয়া বিষয়ে আলোচনায় মিলিত হয়েছেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে, সিরিয়া ও আফগান–যুদ্ধ শেষের দিকে। সবাই হাঁফ ছেড়েছিলেন আফগানিস্তান ও সিরিয়ার যুদ্ধের অবসান হতে যাচ্ছে বলে। কিন্তু এখানেই কি শেষ হবে পশ্চিমাদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার?

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ইয়েমেন, সিরিয়া বা আফগানিস্তান ছিল যুদ্ধের মহড়া কেবল। আসল যুদ্ধ এখনো শুরুই হয়নি। আবহ তৈরি করা হয়েছে মাত্র। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ও অগণতান্ত্রিক শাসকদের জয়জয়কার, যার মূল কারণ হচ্ছে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ইসরায়েলের দখলদারি টিকিয়ে রাখা। ইসরায়েলের নতুন নতুন ভূমি দখল নির্বিঘ্ন করা। আরবের কোনো রাষ্ট্রই যেন ইসরায়েলের পথে বাধা ও হুমকি হয়ে দাঁড়াতে না পারে, তা দেখা। আরবে অস্থিতিশীলতা, বিভাজন ও ক্ষমতালোভী অগণতান্ত্রিক শাসকেরাই ইসরায়েলের মনোবাঞ্ছা পূরণের একমাত্র ভরসা।

এর জন্য নতুন একটি যুদ্ধক্ষেত্র ইসরায়েল ও তার মিত্ররা তৈরি করতে চাইছে। সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে হামলার মাধ্যমে সেই যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ইরানকে নির্ধারণ করে ফেলেছে ইসরায়েল ও তার মিত্ররা। অভিযোগের তির ইরানের দিকেই তাক করেছে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি ও ইসরায়েল। ইরানও স্বাভাবিকভাবেই অস্বীকার করেছে। বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, ইরান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একমত হতে পারছে না ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের দাবিকে একবাক্যেই ইউরোপীয়রা এবার মেনে নিচ্ছে না। এর আগে হরমুজ প্রণালিতে এক জাহাজে ইরানি হামলার বিষয়ে একমত হতে পারেনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশ—বিশেষ করে জার্মানি। ইরাক বা আফগানিস্তানে হামলার সময় ইউরোপ যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করেছে, ইরানের বিষয়ে সেভাবে সবাইকে পাশে পাচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র।

হুতিরা হামলার দায় স্বীকার করলেও যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি ও ইসরায়েল অভিযোগ করছে, ইরানই হামলা করেছে। ইরানবিরোধীদের দাবি, এত সূক্ষ্মভাবে হামলা করা হুতিদের পক্ষে সম্ভব না। মোদ্দাকথা, হামলায় ইরানের হাত থাকতে পারে, আবার নাও থাকতে পারে। ইরান জড়িত থাকুক আর না থাকুক, এখানে ইরানকে কেন্দ্র করেই নতুন এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিতে সবাই সচেষ্ট। তেলক্ষেত্রকে হামলায় জড়ানোর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সবাইকে ইরানের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা। এর জন্য সৌদি তেলক্ষেত্রে হামলা এক মোক্ষম পন্থা। সৌদি তেলক্ষেত্রে হামলার পরপরই বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বেড়েছে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০০৮ সালের পর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এটা দাম বাড়ার সর্বোচ্চ রেকর্ড। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ইরানবিরোধী মনোভাব সৃষ্টিতে কার্যকর হতে পারে। যেমনটা ইরাকের বিরুদ্ধে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র মজুতের অভিযোগ করা হয়েছিল। এরপর গোটা ইরাককে কারবালায় পরিণত করা হয়েছিল।

সাদ্দাম হোসেনকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে একই সঙ্গে জিহাদি জঙ্গিদেরও ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই কায়দায় আরব–বসন্তের নামে সিরিয়া ঢুকেছে আইএস। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আইএসকে সামরিক, আর্থিক ও কৌশলগত সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ এখন আর ভিত্তিহীন না। সিরিয়া থেকে হাজার হাজার আইএস যোদ্ধা কোথায় মিলিয়ে গেল? এরা এখন কার আশ্রয়ে আছে; এর কোনো সঠিক উত্তর নেই। সবাই তো আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। কিন্তু আইএসের খলিফা বোগদাদির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না কেন?

আরবে এসব যুদ্ধ যুদ্ধ খেলার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে ইসরায়েলের বিপক্ষ শক্তিকে দুর্বল করে ফেলা। নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। তাই সৌদিতে হামলার পর ইসরায়েল ইরান হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে উসকে দিচ্ছে। অধ্যাপক নরম্যান এ বেইলির মতো জায়নবাদীরা মনে করেন, এখনই ইরানকে হামলা করে মিশিয়ে দেওয়া দরকার। ‘এশিয়ান টাইমস’–এ অধ্যাপক নরম্যান সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছেন, সৌদি তেলক্ষেত্রে হামলা আরবে শেষ খেলার শুরু হতে পারে। তিনি স্বভাবতই বোঝানোর চেষ্টা করেছন, ইরান বোধ করি ইরাক বা সিরিয়ার মতোই ধুলায় মিশে যাবে। সৌদিতে হামলার পর ইসরায়েলের বুদ্ধিজীবীরা খুবই উচ্চকিত। তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, ওবামা প্রশাসনের মতো বোকামি করা ঠিক হবে না।

কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু সম্ভব? ইরান সিরিয়া বা ইরাকের থেকে অধিক সামরিক শক্তির অধিকারী। আরব অঞ্চলের বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে ইরানের সখ্য রয়েছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস ও ইয়েমেনের হুতিরা ইরানের মিত্র। তাই ইরাক হামলায় ওয়াকওভারের যে সুবিধা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ইরানের ক্ষেত্রে তা না–ও হতে পারে। সিরিয়াতেও যুক্তরাষ্ট্র ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারেনি। এদিকে রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরান একযোগে খেলায় যোগ দিয়েছে। তাই কথা নেই, বার্তা নেই হুট করেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আইএসকে পরাজিত ঘোষণা করে পিটটান দিয়েছেন। কে হারল, কাকে হারানো হলো, তার সুস্পষ্ট কোনো হিসাব নেই। ট্রাম্প নিজেকেই নিজে বিজয়ী ঘোষণা করেছেন অনেকটা। কিন্তু বাশার আল–আসাদ ঠিকই ক্ষমতায় বহাল। কার্যত সিরিয়ার যুদ্ধ কোনো ফলই আনতে পারেনি। যেটা হয়েছে, ইউরোপকে লাখ লাখ উদ্বাস্তুর দায়ভার বহন করতে হচ্ছে। বরং ইরানে হামলা হলে আরবে সর্বব্যাপী এক লড়াইয়ের সূচনা হতে পারে। আর আগেই বলেছি, ইউরোপের সমর্থন এ ক্ষেত্রে না–ও পেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।

এসব বিষয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তেলক্ষেত্রে হামলা–পরবর্তী আচরণে সৌদি, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের জোট আরও স্পষ্ট হয়েছে। তারা একই সুরে কথা বলছে। ইসরায়েল মনে করে, অর্থ থাকলেও যুদ্ধ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো নেতৃত্ব সৌদি আরবে নেই। সৌদি আরবকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলেরই নিরাপত্তা দিতে হবে। প্রকৃত বাস্তবতা হচ্ছে, নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলে ইসরায়েলবিরোধী শক্তিকে সমূলে বিনাশ করা। এদের সমূলে বিনাশ করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রর বৈশ্বিক আধিপত্যই না আবার শেষ হয়ে যায়। তাই ইরান হামলার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ততটা আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না ইসরায়েলের মতো।

অধ্যাপক নরম্যান ঠিকই বলেছেন, আরবে শেষ খেলার শুরু হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের পতনের শুরু হতে পারে। আর তা হলে ইসরায়েল নিজেই নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়বে। নতুন এক বৈশ্বিক শক্তিশালী অক্ষের সূচনা হতে পারে সম্ভাব্য ইরান হামলা থেকে। ইরান যদি কোনোভাবে ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করতে পারে, তবে তা অন্যদেরও তা অনুপ্রাণিত করতে পারে। তাই ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে ইরানের থেকে ইসরায়েলের ঝুঁকিই বেশি।

মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন