Thank you for trying Sticky AMP!!

মনোযোগ দিয়ে শিশুদের কথা শুনুন

আমরা বেশির ভাগ সময় শিশুর সঙ্গে কথা বলি, কিন্তু শিশুর কথা শুনি না। শিশুর সঙ্গে কথা বলা ও শোনার মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য আছে। আমরা যখন বলি, তখন আদেশ-উপদেশ-নিষেধাজ্ঞার কথাই বেশি বলি। কিন্তু আমরা কতজন গুরুত্ব দিয়ে শিশুর কথা শুনি? আমাদের সন্তানেরা কি ভয় ও দ্বিধা ছাড়া সব কথা বলে? কতজন অভিভাবক সন্তানের ভালো ও মন্দ লাগার সব খবর রাখেন?

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া শিশু নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে, আমরা সন্তানের কাছে বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পারিনি। এই জন্য শিশুরা বিপদের কথা সবার আগে আমাদের বলে না।

কিছুদিন আগের ‘মাদ্রাসা অধ্যক্ষের ভয়ংকর রূপ, নিপীড়নের শিকার ১২ শিশু’ সংবাদ শিরোনামে জানা যায়, ৯ বছরের শিশুটি মাদ্রাসায় যেতে চাইত না। কেন চাইত না, মা বুঝতেন না। জোর করে মেয়েকে মাদ্রাসায় পাঠাতেন। শিশু বলেই মা হয়তো তার কথার গুরুত্ব দেননি। অথচ পরে এই শিশুই মাকে অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের কথা জানায়। সেই সূত্র ধরেই বেরিয়ে আসে অধ্যক্ষের পাঁচ বছর ধরে চলে আসা শিশু নিপীড়নের ইতিহাস। ঘটনাটি প্রকাশের ফলে হয়তো আরও অনেক শিশুকে রক্ষা করা গেল এই যাত্রায়। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এদের মধ্যে আর কেউই বিষয়টি মা-বাবাকে জানায়নি। একইভাবে নারায়ণগঞ্জে এক স্কুলশিক্ষকের দ্বারা ২০ শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনাটিও প্রমাণ করেছে, আমরা বড়রা শিশুদের মনের খবর রাখতে পারছি না। ওই শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে আপত্তিকর ছবি এবং ভিডিও চিত্র ধারণ করার মাধ্যমে শিশুদের ভয়ভীতি দেখিয়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছেন, অথচ তাদের মা-বাবারা কেউ জানতেও পারেননি। যদি তারা ঘটনার দিনই মা-বাবাকে বলতে পারত, তাহলে হয়তো এতজন শিশু একই ব্যক্তির দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হতো না। তার আগেই অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হতো।

আজকাল প্রায়ই পত্রিকার সংবাদ হয়ে আসে ছেলেশিশুর যৌন নির্যাতনের খবর, যার অনেকই ঘটতে দেখা যায় আবাসিক স্কুল ও মাদ্রাসায়। অভিভাবকেরা এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি এতটাই ভরসা করেন যে যেকোনো মূল্যে সন্তানকে ওখানে থাকতে বাধ্য করেন। এসব স্থানে শিশুরা কেমন থাকে, কী আচরণের শিকার হয়, তার কোনো খবর রাখার প্রয়োজন মনে করি না। সংবাদের শিরোনাম হলে আমাদের টনক নড়ে, তার আগে নয়।

শিশুরা মা-বাবাকে সব কথা কেন বলতে পারে না? এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু কিশোরীর কথা শোনার সুযোগ হয়েছিল। তারা বলেছে যে তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের কথা তারা মা কিংবা পরিবারের কারও সঙ্গে বলতে পারে না। কারণ, অভিভাবকেরা তাদের কথা বিশ্বাস তো করেন না, উল্টো বকাঝকা করেন। এমনকি ঘটনাটি তার সঙ্গেই কেন ঘটল, সেটি নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। বেশির ভাগ পরিবারের ধারণা, এসব বিষয়ে আগে থেকে আলোচনা করলে শিশুরা বিপথগামী হবে, বয়স হলে যা শেখার আপনা-আপনি শিখে যাবে। ফলে বয়ঃসন্ধিকালের সংবেদনশীল সময়ে ছেলেমেয়েরা তাদের শরীর ও মনের পরিবর্তন নিয়ে সাধারণত আলোচনা করতে পারে না। তাই ছেলেমেয়ে উভয়ই তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণগুলো কীভাবে কাকে বলা যায়, আদৌ বলা যায় কি না, সেটা নিয়ে একধরনের অস্পষ্টতা নিয়ে বড় হয়; মন খারাপ করে এবং অপরাধবোধে ভোগে। এ ক্ষেত্রে আমাদের নীরবতা যৌন নিপীড়ককে নিশ্চিন্ত করে যে ঘটনাটি কেউ জানবে না। এই পরিস্থিতি অপরাধীকে ভয়ের বার্তা দেওয়া তো দূরে থাক, বরং উৎসাহিত করে। দীর্ঘদিনের সমাজের এই অচলাবস্থা এ ধরনের অপরাধীর দৌরাত্ম্য বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিণতিতে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে শিশু ও তার পরিবারকে।

শিশুদের বেশির ভাগই যৌন নিপীড়নের শিকার হয় কাছের মানুষ দ্বারা, এমন কেউ, যাকে তারা চেনে। আত্মীয়, বন্ধু, শিক্ষক যে কেউ হতে পারেন নিপীড়ক। এর জন্য আমাদের উদাসীনতা কম দায়ী নয়। আমরা সন্তানের মনের খোঁজ রাখি না। তাই আসুন, সন্তানের নিরাপত্তার কথা ভেবে তাদের কথা শুনি, তার কথার মূল্যায়ন করি, তাকে আশ্বস্ত করি এবং তার সমস্যাকে অবজ্ঞা না করে সমাধানে পদক্ষেপ গ্রহণ করি। শিশু যেন তার সব স্বস্তি-অস্বস্তির কথা অসংকোচে বলতে পারে এমন পারিবারিক পরিবেশ তৈরি করি। তাহলে অন্তত কাছের মানুষের দ্বারা নিগ্রহের কথাটি সবার আগে আপনি জানবেন।

এসব বিষয়ে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন: শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ও বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তুলুন। তাহলে ভয়ে কিংবা লজ্জায় শিশুরা কোনো কিছু গোপন করবে না। প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় শিশুর সারা দিনের কাজ নিয়ে গল্প করুন। স্কুলের পরিবেশ, লেখাপড়া বিষয়ে তার পছন্দ-অপছন্দ শুনুন। এ সময় শিশুর চোখ, মুখের রেখা এবং অনুভূতিকে বোঝার চেষ্টা করুন। খুব ছোটবেলা থেকে ছেলেমেয়ে উভয়ের সঙ্গে যৌনতা বিষয়ে বয়সোপযোগী আলোচনা করুন। তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার পরিবেশ তৈরি করুন। কারণ, নিপীড়কেরা শিশুদের অজ্ঞতার সুযোগ নেয়। তার অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকুন, যাতে কোনো সমস্যায় সবার আগে সে আপনাকেই আশ্রয় মনে করে। সন্তানের কোনো অভিযোগ নাকচ করে না দিয়ে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করুন।

রাশেদা আক্তার ব্যবস্থাপক: সিভিল সোসাইটি অ্যান্ড পলিসি অ্যাডভোকেসি, চাইল্ড রাইটস গভর্ন্যান্স অ্যান্ড চাইল্ড প্রটেকশন, সেভ দ্য চিলড্রেন