Thank you for trying Sticky AMP!!

মহাধনী ও রাজনীতির ছত্রচ্ছায়া

সিঙ্গাপুরের সাংবাদিক জেমস ক্রেবট্রি ২০১১ থেকে ছয় বছর ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর মুম্বাই ব্যুরো চিফ ছিলেন। সাংবাদিকতার দায়িত্বের পাশাপাশি মহাধনীদের রাজত্ব (দ্য বিলিয়নিয়ার রাজ) নামে ভারত বিষয়ে ৪১৬ পৃষ্ঠার একটা বইও তিনি প্রকাশ করেছেন সম্প্রতি। সেখানে ক্রেবট্রি লিখেছেন, ২০০২ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের বিলিয়নিয়ার তালিকায় ভারত থেকে ঠাঁই পেয়েছিলেন মাত্র ৫ জন। ২০১৮ সালে সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ১১৯ জনে। ১৬ বছরে প্রায় ২৪ গুণ বৃদ্ধি! ভারতে মহাধনীদের এই জয়যাত্রায় আম্বানি পরিবার রয়েছে সর্বাগ্রে।

গত মাসে হুরুন-ইন্ডিয়া সপ্তমবারের মতো ভারতীয় ধনীদের যে তালিকা করেছে, তাতে দেখা গেল, দেশটিতে এক হাজার কোটি রুপি আছে কমপক্ষে ৮৩১ জনের। ১২ মাস আগের চেয়ে এই সংখ্যা ২১৪ জন বেশি। এই তালিকার প্রথম স্থানেও আছেন আম্বানি পরিবারের বড় ভাই মুকেশ। যাঁর সম্পদমূল্য আনুমানিক ৩ লাখ ৭১ হাজার কোটি রুপি। ২০১৭-এর চেয়ে মুকেশ আম্বানির সম্পদ বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। তাঁর ভাই অনিল আম্বানির সম্পদমূল্য ফোর্বস-এর হিসাবে ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার।

বিশ্বের দরিদ্র মানুষের ২০ শতাংশের বাস (প্রায় ১৮ কোটি) ভারতে। সেখানে আম্বানিদের রকেট গতিতে সম্পদ বৃদ্ধির গোপনবিদ্যা জানতে অনেকেরই ইচ্ছা হবে। তবে সেটা সহজ নয়। আম্বানিদের ‘রিলায়েন্স’ সাম্রাজ্যের সহযোগী ‘নেটওয়ার্ক ১৮’ নামের সংস্থার হাতেই রয়েছে প্রায় ৪৭টি টিভি চ্যানেল। আরও আছে অসংখ্য কিসিমের প্রচারমাধ্যম। অর্থাৎ ভারতে সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী পরিবারটির হাতেই রয়েছে প্রচারমাধ্যম জগতেরও বড় হিস্যা।

তারপরও আম্বানিদের দুর্নীতি নিয়ে ভারত সরব এখন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্স থেকে যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি বন্ধু অনিল আম্বানির কোম্পানির স্বার্থে অদলবদল করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। খোদ ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ ২১ সেপ্টেম্বর বলেছেন, বিমান ক্রয় চুক্তিকালে অনিল আম্বানির কোম্পানি ‘রিলায়েন্স ডিফেন্স’কে ফ্রান্সের কোম্পানির অংশীদার করতে মোদি অনুরোধ করেছিলেন এবং তা করা হয়েছে। এই বিবরণ প্রকাশমাত্র মোদি-অনিল জুটি নতুন করে ক্রনি ক্যাপিটালিজম বা ‘স্বজন-তোষক পুঁজিবাদ’-এর আকর্ষণীয় যুগলবন্দী হয়ে উঠেছেন।

দুই.

রাফালে বিমান সরবরাহ করবে ফ্রান্সের দাসসল্ট এভিয়েশন। সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা ভারতের রাষ্ট্রীয় কোম্পানি হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকসের। প্রাক্–চুক্তি আলাপে বিমানগুলোর যন্ত্রাংশের কিছু কাজ হিন্দুস্তান অ্যারোনটিকসকে দিয়ে তৈরি করার কথা। কিন্তু মোদি সেই সুযোগ করে দিয়েছেন তাঁর বন্ধু অনিল আম্বানির রিলায়েন্স ডিফেন্সকে। এই কোম্পানির জন্মই হয়েছে বিমান ক্রয়চুক্তি চূড়ান্ত করার ১২ দিন আগে। এটা বেশ সন্দেহজনক।

ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা ক্রয়চুক্তি এটা। ফ্রান্সের জন্য যা ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ইউরো—ভারতীয় রুপির অঙ্কে সেটাই ৫৮ হাজার কোটি। কংগ্রেস জাতীয় নির্বাচনের আগে মোক্ষম মুহূর্তে ইস্যুটি পেয়ে সর্বোচ্চ ঝড় তুলতে তত্পর। তারা এ বিষয়ে পার্লামেন্টারি তদন্ত দাবি করে প্রতিদিন মিছিল-মিটিং করছে।

ভারতীয় রাজনীতির অভ্যন্তরীণ এই উত্তেজনার ক্ষণে পাকিস্তানও সুযোগ নিতে তত্পর। দেশটির তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী রাফালে যুদ্ধবিমান ক্রয় কেলেঙ্কারিকে মোদির ‘পানামা-গেইট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। স্পষ্ট যে ইমরান খান সরকার মোদিকে তুলনা করছে দুর্নীতির দায়ে পানামা পেপারসে নাম আসা এবং তার পরিণতিতে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানো তাঁদের দেশের নওয়াজ শরিফের সঙ্গে। ২০১৬ সালে সম্পদ পাচারের অভিযোগে নওয়াজ প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানো ছাড়াও রাজনীতি থেকে আজীবনের জন্য বাদ পড়েছেন এবং ১০ বছরের কারাদণ্ডেও দণ্ডিত হন।

এ পর্যায়ে স্মরণযোগ্য, বাংলাদেশের শতাধিক ব্যক্তির নামও এসেছিল অর্থ পাচারের ইঙ্গিতবহ পানামা পেপারস দলিলপত্রে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত সুপরিচিত ব্যক্তিদের নামও ছিল তালিকায়। পিরোজপুর থেকে নির্বাচিত একজন সাংসদ একাধিকবার বিষয়টি তদন্তের দাবি তুলেছিলেন পার্লামেন্টে। দুদক এ বিষয়ে সর্বশেষ ২০১৮-এর জুনের মধ্যে তদন্ত সম্পন্নের আশ্বাসও দেয়। সেই আশ্বাসের বিস্তারিত আর জানা যায়নি। কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত প্রচারমাধ্যমে আসা ব্যাংক খাতের বড় অঙ্কের দুর্নীতিগুলোর বিচার-প্রক্রিয়া নিয়েও বিস্তারিত কিছু জানা যায় না আর। ২০১০-এ শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি শেষে ইব্রাহিম খালেদের তদন্তে যে ৬০ ব্যক্তির নাম এসেছিল, তঁারাও সিরিয়াস কোনো বিচার-প্রক্রিয়ার মুখে পড়েননি আজও। বরং সর্বশেষ জানা গেল, বিশ্বে অতি ধনী মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে বাংলাদেশে। চীন, ভারতও এই অগ্রগতিতে বাংলাদেশের পেছনে পড়ে আছে। ২০১২ থেকে পরবর্তী ৫ বছর প্রায় ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে এখানে অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে। লন্ডনের ‘ওয়েলথ এক্স’ এই প্রতিবেদন তৈরি করে। যদিও বিশ্বের কোনো সংস্থা এখনো বাংলাদেশের শীর্ষ ধনীদের কোনো তালিকা করেনি—তবে শিগগিরই যে তা হবে, সে লক্ষণ স্পষ্ট।

এ বছরের আগস্টে এবং গত বছরের প্রথম দিকে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের দুই শীর্ষ ধনীর সম্পদমূল্য প্রকাশ করেছিল। যাঁরা অবশ্যই বিলিয়নিয়ার ছিলেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ রকম শতকোটি ডলারের মালিক আরও তৈরি হওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে ওয়েলথ এক্সের উল্লিখিত প্রতিবেদনে। অথচ বিস্ময়ের দিক হলো, বাংলাদেশের ‘শীর্ষ করদাতা’ মাত্র ছয় কোটি টাকা কর দেন। ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ প্রথম আলো লিখেছিল, ‘করের অঙ্কের হিসাবে জর্দা ব্যবসায়ী কাউছ মিয়ার আয় ও সম্পদমূল্য এক শ কোটি টাকার কমই বলতে হবে।’

তিন.

বাংলাদেশে একজন ‘খুদে ধনী’র ‘শীর্ষ করদাতা’ হওয়া পরোক্ষে প্রমাণ করছে, দেশটির আম্বানিরা করের নজরদারি চমৎকারভাবে এড়াতে পারছেন। রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় এটা সম্ভব হয়। সুশাসন ও জবাবদিহি থাকলে হয়তো বাংলাদেশের শীর্ষ করদাতা কাউছ মিয়ার পরিবর্তে অন্য কেউ হতেন। সে রকম পরিস্থিতিতে হাজার হাজার কোটির ঋণখেলাপি কোম্পানির মালিকেরা দিব্যি রাজনীতিবিদদের আশপাশে ঘুরে বেড়াতে পারতেন না।

তবে আপাতত দক্ষিণ এশিয়ায় আম্বানিদেরই জয়জয়কার। যাঁরা রাজনীতিবিদদের পাশে পেয়ে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিপুল সম্পদের মালিক হচ্ছেন এবং রাজনীতি চরমভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছে।

যদিও বিলিয়নিয়ারদের মিডিয়াগুলো প্রতিনিয়ত এই অর্থনৈতিক মডেলের জাদুকরি ভাবমূর্তি তুলে ধরতে তৎপর, কিন্তু পরিস্থিতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অতি করুণ। দক্ষিণ এশিয়া এখনো বিশ্বের অন্যতম দারিদ্র্যকবলিত এলাকা। আম্বানিদের সংখ্যা বৃদ্ধি ধনী-গরিবের ব্যবধান অসহনীয় স্তরে নিয়ে গেছে। ঔপনিবেশিক শাসন মুক্তির ৭০ বছর পরও ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশজুড়ে প্রায় ২৫ কোটি মানুষ দরিদ্র। সুইজারল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে এই তিন দেশের যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে বলে ইঙ্গিত মেলে, তা উদ্ধার করে আনা গেলে এসব দেশ বহু বছর কর না বাড়িয়ে এবং বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের সহায়তা ছাড়াই বাজেট তৈরি করতে সক্ষম।

দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির এই চেনা-চক্রে প্রথম বড় ধাক্কা পাকিস্তানে নওয়াজের পতন। দুর্নীতিবিরোধী ভোটারদের এক দিনের সিদ্ধান্তে সংসদে নওয়াজের দলের আসন কমে গেছে ৮৪টি (১৬৬ থেকে ৮২)।

ভারতে বিজেপিও জিতেছিল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগের পর। ২০১৪ সালে কংগ্রেস জোটের আসন কমেছিল ১৬২টি। আর বিজেপি জোটের আসন বেড়েছিল ১৬৬টি। এখন আবার মোদির বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রবল অভিযোগে কংগ্রেস ফায়দা পাবে। হয়তো বাংলাদেশের সামনের নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণায় বিগত দিনের দুর্নীতির প্রসঙ্গগুলো তথ্য-উপাত্তসহ হাজির হবে।

কিন্তু দুর্নীতির তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরে এক দলকে ক্ষমতাচ্যুত করে আরেক দলকে মসনদে আসীন করাই সর্বোত্তম সমাধান নয়। দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের অস্বচ্ছ যে দুষ্টচক্র গড়ে উঠেছে, তাকে দুর্বল করতে পুনঃপুন জন-আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই। বড় বড় ক্রয়াদেশ এবং উন্নয়ন প্রকল্প ঘিরে জন–নজরদারি প্রয়োজন আজ। সেটা করা না গেলে পার্লামেন্ট যথারীতি বিলিয়নিয়ারদের সহযোগী সংস্থা হয়ে থাকবে মাত্র। এমনকি নির্বাচন ‘সুষ্ঠু’ হলেও।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক