Thank you for trying Sticky AMP!!

মানসম্মত শিক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে সবাইকে

প্রযুক্তি ও আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে, পৃথিবীর আরও অনেক কিছুর মতোই অগ্রগতি হয়েছে শিক্ষারও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে শিক্ষার ধরন এবং অনুষঙ্গ। পাঠদান পদ্ধতিতে পরিবর্তনের পাশাপাশি শিক্ষার নতুন নতুন ক্ষেত্রও তৈরি হয়েছে। নতুন উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারের সঙ্গে শিক্ষার মানের উন্নতি হয়েছে, ঘটেছে শিক্ষার প্রসার এবং বৈপ্লবিক সব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন। এর অনেক কিছুই এই দেশেও বাস্তবায়িত হয়েছে। তবে শিক্ষার সর্বজনীনতা যতটা ছড়িয়েছে, মানসম্মত শিক্ষার বিস্তার কিন্তু ততটা হয়নি। এমনকি কোথাও কোথাও প্রযুক্তির ব্যবহার শিক্ষাক্ষেত্রে অসততার নতুন পথও বাতলে দিয়েছে।


পরীক্ষা-পদ্ধতির কথা ধরা যাক। পরীক্ষার মাধ্যমেই মূল্যায়িত হয় যোগ্যতা এবং শিক্ষার কার্যকারিতা; প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব, নিজেকে আরও উঁচুতে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস। সেই প্রয়াস থেকেই মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করা ছাড়াও বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তির বৈপ্লবিক অগ্রগতির সুযোগ নিয়ে শিক্ষার্থীরাও উন্নততর অসাধু পন্থা উদ্ভাবন করছেন, যা নিমেষের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী।

পশ্চিমা বিশ্বে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম হলো ‘কোরা’। এখানে ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই নকলের উপায় উদ্ভাবনে তাঁদের প্রচেষ্টা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন। উদাহরণ হিসেবে অনেক আগে আসা ক্যালকুলেটরের কথাই ধরা যাক। ক্যালকুলেটরে বিজ্ঞান বা গণিতের সূত্র সংরক্ষণ করে রাখা যায়, ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো সাংকেতিক ভাষার মাধ্যমে অনেক কিছু লুকিয়েও রাখা যায়। পরে মোবাইল ফোন এবং সেই সঙ্গে ইন্টারনেটের অগ্রযাত্রার আগমনের সঙ্গে সঙ্গে এই পদ্ধতি আরও সহজ হয়ে গেল। কারণ, এতে নোট সংরক্ষণ করে নিয়ে আসা যায়, ছবি তুলে রাখা যায়। কালক্রমে এর সঙ্গে আরও যুক্ত হলো ইনফ্রারেড, ব্লুটুথ, আলট্রা-ভায়োলেট পেন, পিডিএ, স্মার্টফোন, স্মার্টওয়াচ ইত্যাদি। এই সুযোগে পরীক্ষায় অসাধু এবং অবৈধ পন্থারও বৈচিত্র্য বাড়ল। এসব পন্থা অবলম্বনের ফলে পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা গেলেও মননের বিকাশ ঘটছে না। উল্টো এসব মানসিক বিকাশে প্রভাব ফেলে এবং এতে তৈরি হয় অসাধু কাজকর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা।

শিক্ষাক্ষেত্রে নকল বা অসাধু পন্থা অবলম্বনের ব্যাপারটি নিয়ে দেশে-বিদেশে আগে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষার্থীদের মানসিকতা নিয়ে, তাঁদের সততা এবং সচেতনতা বিষয়ে, এমনকি তাঁদের মানসিক গঠন নিয়েও। এই ধরনের কার্যক্রমের জন্য একসময় শিক্ষার্থীদেরই একতরফাভাবে দায়ী করা হতো। উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ বা ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের পারস্পরিক সম্পর্ক বা বোঝাপড়ার বিষয়গুলো এখানে উঠে আসত খুব সামান্যই।

২০১২ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন একটি কোর্সে নকলের অপরাধে শতাধিক শিক্ষার্থী দোষী সাব্যস্ত হলেন, তখন নড়েচড়ে বসলেন বিশ্বব্যাপী শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেকেই। অসাধুতায় পিছিয়ে নেই যুক্তরাজ্যের শিক্ষার্থীরাও। যুক্তরাজ্যভিত্তিক দৈনিক গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, ২০১২ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অসাধু পন্থা অবলম্বনের হার বেড়েছে প্রায় ৪২ শতাংশ। ইউনিভার্সিটি অব সারে, নিউক্যাসেল ইউনিভার্সিটির মতো নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ২০১৬ সালে শতাধিক শিক্ষার্থী নকল করতে গিয়ে ধরা পড়েন, যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই সহায়তা নিচ্ছিলেন কোনো না কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের। বিশ্বায়নের এই যুগে প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী যখন হাতের মুঠোয়, আমাদের শিক্ষার্থীরাও এই পন্থায় অভ্যস্ত হতে লাগলেন।

আমাদের দেশের চাকরিতে নিয়োগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষাগুলোয় অসাধু পন্থা অবলম্বনের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। স্কুল-কলেজর সুনাম ছড়াতে পরীক্ষার হলেই শিক্ষক নামধারী কেউ কেউ ছাত্রদের উত্তর বলে দিচ্ছেন। প্রতিনিয়ত গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমগুলোয় আমরা দেখতে পাই প্রশ্নফাঁস, জালিয়াতি, ভুয়া পরীক্ষার্থী, স্বজনপ্রীতিসহ বিভিন্ন ধরনের খবর। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ সারা দেশেই তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নের ধরনের নিরপেক্ষতাও প্রশ্নবিদ্ধ। একই নিয়োগ বা ভর্তি পরীক্ষায় কয়েক ধরনের প্রশ্নপত্র ব্যবহারের নজিরও আমাদের দেশে আছে (উদাহরণ হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলা যেতে পারে)। এতে মেধার মূল্যায়নে যে বৈষম্য হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সময় এসেছে এই অসাধু পন্থা অবলম্বনের বিষয়গুলো বৈজ্ঞানিকভাবে খতিয়ে দেখার। এ ব্যাপারে আবেগপ্রবণ না হওয়ায় ভালো। কাউকে সরাসরি দায়ী করাও উচিত নয়। কারণ, এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সবাই এগিয়ে যেতে চায়। শাস্তির বিধান এবং হুমকি থাকা সত্ত্বেও কমছে না এই প্রবণতা, বরং ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রবলভাবে। তবে কি বিদ্যমান আইন যথেষ্ট নয়? নাকি এসবকে ‘কাগুজে বাঘ’ হিসেবে গণ্য করছেন সুযোগসন্ধানীরা?

পুরো বিশ্বের প্রেক্ষাপটেই ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করতে পারছেন কেবল সুবিধাভোগী এবং সচ্ছল শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। নিয়মিত পড়াশোনা বা মেধার জোরে তাঁদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার দৌড়ে টিকে থাকতে পারছেন না অসচ্ছল শিক্ষার্থীরা। যার দরুন প্রতিটি জায়গায় আধিপত্য তৈরি হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির এবং প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ছেন অনেক মেধাবী ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষার্থী। দেশ ও জাতির স্বার্থেই যথাযোগ্য মেধা যাচাই ও তা বিকাশের জন্য এই অবস্থার প্রতিকার অতি জরুরি।

কাজেই প্রয়োজন শিক্ষাক্ষেত্রে সর্বজনীন সাম্যাবস্থা। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করতেও প্রযুক্তির আশ্রয় নেওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে বিশেষজ্ঞদের। নকল প্রতিরোধ এবং নির্ণয়ে এরই মধ্যে প্রযুক্তিগত সমাধান হিসেবে তৈরি করা হয়েছে কিছু সফটওয়্যার, যেমন: ‘টার্নইটইন’, ‘প্রক্টোরট্র্যাক’ ইত্যাদি। এই সফটওয়্যারগুলো শিক্ষার্থীদের হুবহু একই উত্তর প্রদান চিহ্নিতকরণ এবং পরীক্ষার হলে তাঁদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে সহায়ক। এ ছাড়া ফিরিয়ে আনতে হবে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি শ্রদ্ধা, যেখানে পরিশীলিত আচার-আচরণ আর সততার সঙ্গে সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। এই দায়িত্ব যুগপৎভাবে পালন করতে হবে শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকেই। আমাদের দরকার এমন একটি পরিবেশ, যেখানে ফলাফলের চেয়ে অগ্রাধিকার পাবে মেধা এবং মানসিক বিকাশ। এ ছাড়া ‘অনার বোর্ড’ প্রচলনের মাধ্যমে শিষ্টাচারের উৎসাহ দেওয়া যেতে পারে।

আশার কথা, এসব চিন্তাভাবনা আমাদের দেশে শুরু হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ৯ থেকে ১১ নভেম্বর ঢাকার সাভারে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরাম ২০১৭’। চার বছর ধরে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর এই সম্মেলন আয়োজন করে আসছে ব্র্যাক। এবার পঞ্চম আসরের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়: মানসম্মত শিক্ষার প্রসার। গ্লোবাল সাউথের বিশেষজ্ঞরা এই সম্মেলনে আসবেন। অংশ নিচ্ছেন ফিলিপাইন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, নেপাল প্রভৃতি দেশের শিক্ষাবিদ এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। একটি সুন্দর পৃথিবী নির্মাণে অপরিহার্য হাতিয়ার হলো মানসম্মত শিক্ষার বিকাশ। সুষ্ঠু শিক্ষার প্রসার ও সর্বজনীন প্রবেশাধিকারের মাধ্যমেই দূর হবে বৈষম্য, আসবে উন্নয়ন। এই আয়োজনে সহযোগিতা করছে প্রথম আলো।

কে এ এম মোরশেদ: পরিচালক (অ্যাডভোকেসি), ব্র্যাক।
মুনির হাসান: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি