Thank you for trying Sticky AMP!!

মানুষের জন্য তাঁর ছিল একবুক ভালোবাসা

আনিসুল হক

আজ ৩০ নভেম্বর, ঢাকা উত্তরের মেয়রআনিসুল হকের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ‘আনিসুল হকের ওপরে কিছু লিখুন না’—অনুরোধ জানিয়েছেন এক শুভানুধ্যায়ী। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আনিসুল হকের ‘ওপরে’ আমি লিখতে পারব না। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। জনপ্রিয় টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপস্থাপক হিসেবে তিনি যখন খ্যাতির তুঙ্গে, তখন আমি প্রবাসে। সুতরাং আনিসুল হকের কোনো স্মৃতিচারণা করা আমার আয়ত্তের বাইরে।

সবকিছু ভেবেচিন্তে আমার মনে হয়েছে যেআনিসুল হকের ‘ওপরে’ নয়, কিন্তু আনিসুল হককে ‘নিয়ে’ আমি হয়তো কিছু লিখতে পারি! এই যে জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর অনন্যসাধারণ অর্জনের কথা লোকমুখে ফেরে, এই যে তাঁর অকালপ্রয়াণে সারা দেশের মানুষ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল, এই যে পরম মমতা, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় তাঁকে শেষবিদায় জানিয়েছিল এক জনসমুদ্র, তার রহস্যটা কোথায়?

 জননেতা হয়েছেন; জনপ্রতিনিধি হিসেবে, জনপ্রশাসক হিসেবে কী ছিল তাঁর মধ্যে, যা অন্যদের মধ্যে নেই? কী শেখার আছে তাঁর কাছ থেকে বর্তমান প্রজন্মের এবং ভবিষ্যতেরও যাঁরা জননেতৃত্ব দিতে চান, জনসেবাকে জীবনের লক্ষ্য করতে চান এবং জনপ্রতিনিধি হতে চান? আমার মনে হয়েছে সেই আঙ্গিক ধরে আনিসুল হককে ‘নিয়ে’ কিছু হয়তো–বা আমি লিখতে পারি, যেখানে আনিসুল হক এক অনন্য আধার সেসব বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরার জন্য।

ঢাকা শহরের নগরপাল হিসেবে তাঁর অভাবনীয় কাজ দেখে, বিভিন্ন সময় তাঁর নানান উক্তি ও কথাবার্তা শুনে, ঢাকা শহর প্রশাসনের জন্য শহরের বিভিন্ন অংশে তাঁর পদচারণ দেখে জননেতা ও জনপ্রশাসক হিসেবে আনিসুল হকের কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং গুণ আমার চোখে ধরা
দিয়েছে। দেশে-বিদেশে নানান সফল ও জননন্দিত জননেতা ও জনপ্রশাসকের সঙ্গে পরিচয়ের ফলে আমার উপলব্ধি হয়েছে যে তাঁদের মাঝেও ওই সব অভিন্ন গুণ প্রত্যক্ষ করেছি, যাআনিসুল হকের মধ্যেও চিহ্নিত করতে পেরেছি।

প্রথমত, আমার সব সময় মনে হয়েছে যে মানুষের জন্য আনিসুল হকের ছিল একবুক ভালোবাসা। সবকিছু নির্বিশেষে সব মানুষকেই তিনি কাছে টেনে নিয়েছিলেন এবং সেই অর্থে প্রকৃত প্রস্তাবেই তিনি ছিলেন মানুষের নেতা। তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন মানুষের কল্যাণের প্রতি। তাই বারবার সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, সংশয়-সংকটে তিনি মানুষের কাছেই ছুটে গিয়েছিলেন। মানুষ তাঁকে দেখে আশ্বস্ত হয়েছে, ভরসা পেয়েছে, আস্থা ও বিশ্বাস হারায়নি।

দ্বিতীয়ত, আমরা জানি যে মানবসভ্যতার বিবর্তনে রাজনীতি একটি বিরাট শক্তি, যা মানুষের মঙ্গলের কাজে লাগানো যেতে পারে, আবার মানুষের ধ্বংসেও। বহু সময়ে রাজনীতি সুস্থ থাকেনি, গঠনমূলক ভিত্তির ওপরেও প্রতিষ্ঠিত হয়নি।আনিসুল হক কখনোই রাজনীতির অপশক্তির প্রতিনিধিত্ব করেননি। তিনি সুস্থ ও গঠনমূলক রাজনীতি করেছেন।

রাজনীতি মাত্রেই অসুস্থ—এমন একটা জনগ্রাহ্য বিশ্বাস আমাদের সমাজে বড়ই গভীর। আমার ধারণা,আনিসুল হক এই নেতিবাচক বিশ্বাসটিকে ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর নিজের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন এই সত্যটিকে যে রাজনীতি মাত্রেই অসুস্থ হওয়ার প্রয়োজন নেই, সুস্থ রাজনীতিই মানুষের ও সমাজের স্থায়ী কল্যাণ বয়ে আনতে পারে।

তৃতীয়ত, আনিসুল হক নির্ভীক ছিলেন কথনে, কর্মে। সত্য কথা বলতে পিছপা হননি, ছেড়ে কথা বলেননি কাউকে। দেশবাসী ও ঢাকাবাসী এটা বহুবার প্রত্যক্ষ করেছে। নিজে হয়তো বিশ্বাস করতেন, সত্য শুধু সুন্দর নয়, মঙ্গলময়ও বটে। তাঁর কর্মকাণ্ডের এই নির্ভীকতা বারবার উঠে এসেছে। নগরপাল হিসেবে এমন সব কাজ করেছেন, যা আগে কেউ করা তো দূরের কথা, করার সাহস পর্যন্ত কারও হয়নি; এমন সব কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করেছেন, যা সবাই অসাধ্য বলে মনে করেছে।

এর অনেক কিছুইআনিসুল হক করতে পেরেছেন, তা তিনি আনিসুল হক বলেই। দৃঢ়তা আর আত্মবিশ্বাসের জোরেই যে কারও সঙ্গে, যেকোনো বিষয়ে বিতর্কে মেতে তিনি তাঁর বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন, নিজস্ব মতামতের অনুসারী করতে পারতেন অন্যদেরও। বাংলাদেশ ছিল তাঁর অহংকার, ঢাকা ছিল তাঁর গর্ব। এ দুটোই হয়তো তাঁর দৃঢ়তা আর আত্মবিশ্বাসকে আরও জোরালো হতে সাহায্য করেছে।

চতুর্থত, অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন আনিসুল হক। তার প্রথম প্রমাণ আমরা পেয়েছি তাঁর টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার কালে। যাঁরা দেখেছেন, তাঁদের সবাই বলেছেন কী মনোমুগ্ধকর ছিল তাঁর উপস্থাপনা, শব্দশৈলী, বাচনভঙ্গি। হয়তো পরবর্তী সময়ের বাগ্মিতার হাতেখড়ি তাঁর ওখানেই।

একজন সফল জননেতার জন্য বাগ্মিতা একটি বড় মূলধন। কথার মাধ্যমেই মানুষের কাছে যেতে হয়, তার আস্থা অর্জন করতে হয়, তঁাকে নিশ্চিত করতে হয়। তারপর অবশ্যই আসে কাজ। একজন নেতাকে মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য কথা আবশ্যিক শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়। কথা ও কাজের অপূর্ব এক সমন্বয় আনিসুল হক ঘটিয়েছিলেন, যা যেকোনো জননেতার জন্য অনুকরণীয়।

শেষত,আনিসুল হক ছিলেন অপ্রথাগতভাবে মেধাবী ও এক অনন্যসাধারণ স্বপ্নদ্রষ্টা। প্রথাগতভাবে আমরা ‘মেধাবী’ শিরোনামটিকে পড়াশোনা আর পরীক্ষার ফলাফলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি। যাঁরা তাঁকে জানতেন, তাঁদের মুখেই শুনেছি যে প্রথাগত নির্ণায়কেআনিসুল হক মেধাবী ছিলেন না। কিন্তু তাঁর মেধা ব্যাপ্ত ছিল বৃহত্তর পরিসীমায়—সৃজনশীল চিন্তায়, সৃষ্টিশীল কাজে। তাই নতুন নতুন ধারণায় সিক্ত হতেন তিনি, ভেতরে-বাইরে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার শেষ ছিল না তাঁর।

নতুন নতুন ধারণা আর দিকনির্দেশনা তাঁকে বারবার উজ্জীবিত করেছে। এক ভবিষ্যৎ স্বপ্নদৃষ্টি তাঁকে সম্ভবত তাড়িয়ে বেড়িয়েছে নিত্য। হয়তো তাই পাগলের মতো কাজ করে বেড়াতেন। এত স্বপ্ন, অত কাজ—এত স্বল্প সময়। কিন্তু স্বপ্নদৃষ্টিই তো একজন সৃজনশীল মানুষকে অন্যদের থেকে পৃথক করে।

আমার এই লেখা অপূর্ণাঙ্গ, খণ্ডিত এবং অসমাপ্তও বটে। কিন্তু সে আমার অক্ষমতা। এমন একজন ব্যক্তিত্বকে কে ধরতে পারে একটি ক্ষুদ্র লেখায়, আর যেখানে তাঁর খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। কিন্তু এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমার মনে হয়েছে, অমন একজন মানুষের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে হবে। না, ঔচিত্য থেকে নয়, কর্তব্য-কারণেও নয়, দায়িত্ববোধ থেকেও নয়—শুধু ভালোবাসার তাড়নায়, মমতার কারণে আর হৃদয়ের তাগিদে। এই লেখা ওই তিনটিরই সমষ্টি, আর কিছু নয়।  

ড. সেলিম জাহান ইউএনডিপির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক