Thank you for trying Sticky AMP!!

মাহাথির কি আরও থাকতে চান

মাহাথির মোহাম্মদ। ছবি: রয়টার্স

৭০ বছর ধরে রাজনীতিতে আছেন তিনি। এর মধ্যে দুই দফায় প্রায় ২৪ বছর তিনি মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। একবার ২২ বছর, আরেকবার ২২ মাস।

এসবের বাইরে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও মাহাথির মোহাম্মদের মননশীল এক পরিচিতি আছে বিশ্বজুড়ে। সেই পরিচয়ের সুবাদে একালে মালয়েশিয়া ও মাহাথির প্রায় সমার্থক। কিন্তু ৯৪ বছর শেষে তাঁর কি বিশ্রাম নেওয়াই সংগত নয়?

রাজনৈতিক জীবনের প্রায়ই মাহাথির ভারতীয় বংশলতিকা নিয়ে ঝামেলায় পড়তেন। বিরোধীরা এটা ব্যবহার করে বারবার তাঁকে অপদস্ত করত। তিনি যে ‘খাঁটি মালয়’ নন, অনেকাংশে ‘ভারতীয়’ তা-ই দেখাতে চাইত বিরোধীরা। কিন্তু গতকাল পদত্যাগের পরও অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকেই রাখা হলো, উপপ্রধানমন্ত্রী আজিজা ইসমাইলকে নয়। কারণ, সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে মাহাথিরের বিকল্প খুঁজে পেতে সহি ‘মালয়’দের অনেক বেগ পেতে হচ্ছে মালয়েশিয়ায়। এমনকি পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, সেটাও হয়তো মাহাথিরের অঙ্গুলি হেলনেই নির্ধারিত হবে।

৯৪ বছর বয়সের প্রধানমন্ত্রিত্বকালেও গত সপ্তাহ পর্যন্ত দেশে-বিদেশে তুমুল সক্রিয় ছিলেন মাহাথির। রোহিঙ্গা ও ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ক্রমাগত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বলেছেন। এসব বিষয়ে ওআইসির অকার্যকারিতার মুখে কুয়ালালামপুরে মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর সম্মেলন ডেকেছিলেন কিছুদিন আগে। ১৯ ডিসেম্বর শুরু হওয়া ওই সম্মেলনে কোনো কোনো প্রতিনিধি যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিকল্প হিসেবে মুসলমান দেশগুলোর জন্য বিকল্প মুদ্রা বা স্বর্ণকে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়ার প্রস্তাব তোলেন। মাহাথিরের মদদ ছাড়া এ রকম সাহসী কথাবার্তা শোনা যেত না, হয়তো তাঁর অনুপস্থিতিতে ভবিষ্যতে সেটা আরও বেশি অনুভূত হবে। কিন্তু তিনি কি আদৌ যেতে আগ্রহী?

বয়স যত বাড়ছিল, তাঁকে ততই আগ্রাসী মনে হচ্ছিল। তাঁর সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে মালয়েশিয়ার সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক খুব বিপদে পড়ে। ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন তিনি। এর আগে ২৮ সেপ্টেম্বরে মাহাথির নয়াদিল্লির কাশ্মীর নীতির সমালোচনা করেন। তারও আগে পাকিস্তান-ভারত যখন পরস্পর বিমানযুদ্ধে লিপ্ত, ঠিক তখন পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে সাহস করে সে দেশে যান মাহাথির। তাঁর পাকিস্তান আগমন ইমরান সরকারের জন্য উৎসাহব্যঞ্জক হয়েছিল। এ ছাড়া ইসলামি তাফসিরকারক জাকির নায়েককে ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেও মাহাথির সরকার নয়াদিল্লির অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে আছে।

সাত দশকের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে মাহাথির নিশ্চয়ই হিসাব কষে বারবার ভারতবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন। মালয়েশিয়ার ভারতীয় সংস্কৃতির বিপুল মানুষ আছে। সেখানে তারা প্রধানত যে দলের সঙ্গে যুক্ত সেই ডিএপি (ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টি) শাসক জোটে থাকলেও তাদের পক্ষপাত ছিল মাহাথিরের প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার ইব্রাহিমের দিকে। এরা মাহাথিরের বিরুদ্ধে যত সংঘবদ্ধ হয়েছে, তাঁর পক্ষে মালয়প্রধান দলগুলোকে কাছে পাওয়া তত সহজ হয়েছে।

সর্বশেষ এ সপ্তাহের পরিস্থিতি এ–ও সাক্ষ্য দিচ্ছে, আনোয়ার ইব্রাহিম হয়তো আবারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড় থেকে ছিটকে পড়লেন। এমনকি হয়তো তাঁর স্ত্রীও। শাসক জোটের বড় শরিক হলেও পিকেআরে ব্যাপক ভাঙন ও মতদ্বৈধতা দেখা দিয়েছে। এই দলের আনোয়ারবিরোধী উপদলের নেতা আজমিন আলীকে মাহাথিরের উত্তরসূরি হিসেবে সমর্থন দিচ্ছেন পাঁচ-ছয়টি দলের জনপ্রতিনিধিরা। তার মধ্যে আছে বিরোধী দল উমনুও। এই নতুন জোট নির্বাচনে জিতে আসা চারদলীয় ‘পাখতান হারাপান’কে হঠাৎ প্রতিস্থাপন করতে চাইলেও প্রাথমিকভাবে সফল হয়নি। নাটকীয় এই ‘ক্যু’ চেষ্টায় মাহাথিরের প্রাথমিক সমর্থন আছে মনে হলেও এখন তিনি এই উদ্যোগ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। অর্থাৎ বিদঘুটে এই ক্যু হয়েছে তাঁকে সামনে রেখে তাঁর সরকারের বিরুদ্ধেই।

২০১৮-এর নির্বাচন শেষে পাখতান হারাপান জোট থেকে অপেক্ষাকৃত ছোট দলের প্রতিনিধি হয়েও মাহাথির প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন এই অলিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে দুই বছর পর পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন প্রধান শরিক পিকেআরের আনোয়ার ইব্রাহিম।

সেই প্রতিশ্রুতি মতো ক্ষমতা ছাড়তে পিকেআরের কর্মীরা গত কয়েক মাস তুমুল চাপ তৈরি করেছিলেন মাহাথিরের ওপর। কিন্তু এখন তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়াও বারসাতুও ছেড়ে দিয়েছেন বলে ঘোষণা দিলেন। নাটকীয়ভাবে মন্ত্রিসভাও বাতিল হলো। কিন্তু তিনিই অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী থাকলেন। এতে তাঁর ক্ষমতা আরও একচ্ছত্র হলো। একই সঙ্গে চুক্তি করে আশায় আশায় বসে থাকা আনোয়ার ইব্রাহিম ১৯৯৮-এর মতো আবারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নিশ্চিত পরিস্থিতি থেকে ছিটকে পড়লেন।

পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ারকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে দূরে রাখতেই মাহাথিরই এসব ঘটনায় কলকাঠি নেড়েছেন কি না, এ নিয়ে সন্দেহ-অবিশ্বাস-গুঞ্জন আছে। তবে সবারই আশা, দীর্ঘদিন তিনি অপরিহার্য থাকলেও মালয়েশিয়াকে অবশ্যই তাঁর একজন যোগ্য উত্তরসূরি পেতে সুযোগ দিতে হবে।

কিন্তু বর্তমান দল বারসাতু থেকে পদত্যাগ করায় মনে হচ্ছে নিজের পুরোনো দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন বা উমনোতে আবারও ফিরতে পারেন মাহাথির। একদা এই দলের হয়ে ২১-২২ বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি।

রাজনৈতিক নাটকীয়তার মধ্যে দেশটিতে এখন মোট তিনটি বিকল্প দেখা যাচ্ছে। আনোয়ারের দলের বিদ্রোহী আজমিন আলীর নেতৃত্বে একটা নতুন সরকার অথবা নতুন নির্বাচন কিংবা অন্তর্বর্তী (বা নতুন?) প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথিরের আরও কিছু সময় কাজ চালিয়ে যাওয়া। মাহাথিরের জন্য শেষ দুটো বিকল্পই অপেক্ষা করছে মনে হয়। নির্বাচন হলে তিনি আবারও আজকের প্রধান বিরোধী দল উমনোতে ফিরে এসে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন, যা বিস্ময়কর। তবে অসম্ভব নয়।

আর তৃতীয় বিকল্পটি বাস্তব করতে পার্লামেন্টে তাঁকে বিরোধিতা পেরোতে হবে। মনে হচ্ছে, চলতি রাজনৈতিক ভাঙাগড়াকে ব্যবহার করে পার্লামেন্টে মাহাথির নিজ সমর্থকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ করে তুলতে চাইবেন। এটা কীভাবে করতে হয়, তৃতীয় বিশ্বের সবাই সেটা জানেন। তবে ৯৪ বছর বয়সী মাহাথিরের কাছে অনেকেই এটা হয়তো প্রত্যাশা করবেন না। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশেই এখনো রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের মোহ এবং ব্যক্তিগত প্রতিদ্বন্দ্বীর প্রতি বিদ্বেষ রাজনীতির মূল প্রণোদনা হয়ে উঠলে অনেক কিছুই সম্ভব।

আধুনিক মালয়েশিয়ার প্রতীক তিনি, তবে মাহাথির মোহাম্মদ এবার হয়তো নিজের সব অতীত নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে বাজি ধরছেন।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক