Thank you for trying Sticky AMP!!

মায়ায় ভরা বঙ্গবন্ধুকন্যা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে ‘ভ্যাকসিন হিরো’ পুরস্কার তুলে দেন এনগোজি অকোনজো ইবিলা। ছবি: বাসস

রংপুর সার্কিট হাউস থেকে ঢাকায় ফেরার ভোরে আপা বললেন, ‘পাভেল তোর মা কোথায় রে, বাড়িতে? আমি তোদের বাড়িতে যাব।’ শেখ হাসিনা আপার কথায় চমকে তাকালাম। ‘কী, আপনি আমাদের বাড়িতে যাবেন? কিন্তু আর কিছুক্ষণ পরই তো আমরা ঢাকায় রওনা হব!’ প্রটেকশন টিম পজিশনে গেছে রাস্তায়। তা ছাড়া বেশ কিছু পথসভাও আছে ঢাকার পথে। পীরগঞ্জে ড. ওয়াজেদ মিয়ার বাড়ি, মানে আপার শ্বশুরবাড়িতে যাত্রাবিরতি। যাত্রার শুরুতেই আমাদের বাড়ি। বললাম, ‘এই সাতসকালেই? বাড়িতে তো খবর দিতে হবে।’ আপা বললেন, ‘শোন, নিরাপত্তার লোকজনকে তোর বাড়ির ঠিকানাটা বলে দে।’ 

আপার কথায় খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে মন। মা আপাকে সামনে পেয়ে কী যে খুশি হবেন! মুহূর্তে মায়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। ঢাকায় হাসু আপা যখন এসেছিলেন আমার বউভাতের অনুষ্ঠানে, মা খুব খুশি হয়েছিলেন। আহ্‌, আনন্দে আমার অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। আপার ভিআইপি রুম দোতলা থেকে আমি ছুটে নেমে আসি নিচে নিরাপত্তা দলের সবাইকে খবরটা জানাতে। ছাই রঙের বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ জিপটার পাশেই তৈরি ছিলেন স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসার আর আপার ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় নিয়োজিত মেজর (অব.) শোয়েব। তাঁদের দুজনকে আমাদের বাড়ির লোকেশন বুঝিয়ে বললাম। 

স্থানীয় থানায় ওয়্যারলেস মেসেজে একটা অগ্রগামী টিম রওনা হয়ে গেল তখনই শালবনের বাড়ির ঠিকানায়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পায়রা চত্বর সেন্ট্রাল রোড ধরে শালবনে ছুটে চলল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বঙ্গবন্ধুকন্যার গাড়িবহর। সামনে হুইসেল বাজানো পুলিশের গাড়ি। আপার সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল জলিল, মতিয়া চৌধুরী, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর, সোহেল তাজসহ আরও অনেক নেতা।

শালবন মিস্ত্রিপাড়াবাসীর ঘুম ভাঙল পুলিশের ছুটে চলা সাইরেনের আওয়াজে। উৎসুক বাসিন্দারা ঘুমন্ত চোখে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখার চেষ্টা করছে কে যায়। হারাগাছ সড়কটায় তখনো জমেনি দিনের ব্যস্ততা। নিরাপত্তার লোকজন আমাদের বাড়িতে আগে এসে পড়ায় শালবনে ছড়িয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যার আগমনের খবর। রাস্তার মোড়ে মোড়ে একজন-দুজন করে উৎসুক জনতা ভিড় করতে শুরু করেছে। পুলিশ আর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা দল যখন আমাদের বাড়ির আনাচকানাচে সর্বত্র চোখ বোলাচ্ছে, তখন আশপাশের বাড়ির লোকজনও জানে না কে আসছেন ওই বাড়িতে। বড় ভাই, ভাবি—ডা. ফারুক, ডা. মোমেনা তাঁদের দুই ছেলে তুষার-তমালকে নিয়ে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আর মা ছিলেন দাওয়ায় বসে। 

আগের কথা বলি। আপার মতোই এমন মায়া ছিল বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের। প্রথিতযশা বহুমুখী প্রতিভার মানুষটির অমায়িক ব্যবহারে আমরা ছিলাম তাঁর গুণমুগ্ধ। শুধু ব্যবহারই নয়, তিনি মানুষকে সম্মান করতেন দারুণ আর অসাধারণ ছিল তাঁর সেন্স অব হিউমার। সেই কামাল ভাই একদিন গণভবনে দেশের বিশিষ্ট ক্রীড়াব্যক্তিত্বদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরিচয়পর্বের এক ফাঁকে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধুর সামনে। আমার তখন হাঁটু কাঁপা অবস্থা। 

আমি কিশোর, সদ্য মোছের রেখা ওঠা আবাহনী ক্রীড়াচক্রের আলোকচিত্রী। তখন আমি সাপ্তাহিক একতায়ও কাজ করি। আসলে পরিচয় করার মতো আমার তেমন কোনো পরিচিতিই হয়নি। তারপরও একজন আলোকচিত্রী হিসেবে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন শেখ কামাল তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে, জাতির জনকের সঙ্গে। কী যে মায়াভরা বিশাল মনের মানুষ ছিলেন কামাল ভাই! বড় বোন হাসু আপাও তাঁর মতোই। আপার সঙ্গে ধানমন্ডির বাড়িতে দেখা হয়েছে অনেকবার। আর প্রতিবারই কথা বলেছেন আদরে-মায়ায়। কোনো দিন জোরে কথা বলেননি কোনো কারণে, কিন্তু তাঁরা হলেন জাতির জনকের সন্তান। 

গণভবনে বাগদান অনুষ্ঠানে অনেকের সঙ্গে আমি ছিলাম কামাল ভাইয়ের পার্সোনাল ফটোগ্রাফার হিসেবে। গণভবনের লনে সন্ধ্যারাতে ক্ষুদ্র ফ্ল্যাশের আলোতে ছবি তুলছিলাম আমি। দুটি ক্যামেরা আমার হাতে। একটি বাবার ইয়াশিকা ইলেকট্রো ৩৫, অন্যটি স্টুডিও সাহাজাহানের ১২০ বক্স ক্যামেরা। সেটিও ছিল ইয়াশিকা-ম্যাট। সেই সন্ধ্যায় শেখ কামাল ভাইয়ের বাগ্‌দত্তা স্ত্রী খুকী ভাবি, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃতী অ্যাথলেট ‘ব্লু’, সত্যিকার অর্থেই ছিলেন আমার দেখা ‘রাজকন্যা’। কী মিষ্টি দেখতে, কী দারুণ ভাসা-ভাসা চোখ। 

বঙ্গবন্ধু পুত্রবধূকে গণভবনে রিসিভ করতে দোতলার অফিস থেকে নিচে নেমে এসেছিলেন সেই সন্ধ্যায় আর প্রথম দর্শনেই হয়েছিলেন মুগ্ধ। কারও কোথাও ছিল না অহংকার। মুহূর্তগুলো ভেসে ওঠে মনের পর্দায়। সেই দিন হাসু আপা শরবতের গ্লাস তুলে দিয়েছিলেন খুকী ভাবির মুখে। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের সেই ঝলমলে স্মৃতি আজ যেন বাস্তবে নেমে এল রংপুরে। 

কী দারুণ সৌভাগ্য আমাদের রত্নগর্ভা মায়ের। তাঁর জীবদ্দশায় আবার স্বাগত জানালেন হাসু আপাকে শালবনের বাড়িতে। বঙ্গবন্ধুকন্যা আমাদের বাড়িতে পদধূলি দিচ্ছেন। আবেগে উদ্বেলিত আমি ছুটে আসি মাকে নিয়ে মায়ায় ভরা বঙ্গবন্ধুকন্যাকে স্বাগত জানাতে। আমরা এতটাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় যে শূন্য হাতে তাঁকে স্বাগত জানালেন আমার মমতাময়ী মা। মাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন হাসু আপা। 

হাসু আপা বেশ কিছু সময় কাটালেন মায়ের সঙ্গে বাড়ির আঙিনায়। আপ্যায়নের জন্য মায়ের অস্থিরতা দেখে চিন্তিত হাসু আপা মাকে বললেন, ‘বাঙালি মায়ের অভ্যাস আর গেল না, মেয়ে বাড়িতে এসেছে তাতে মা কেন এত ব্যস্ত হচ্ছেন, মেয়ে কি কখনো অতিথি হয়?’ এই না হলে মায়ায় ভরা রাজকন্যা! বয়োবৃদ্ধ মা আজ বিছানায় শয্যাশায়ী। প্রধানমন্ত্রীর গুরুদায়িত্বের পরও সুযোগ পেলেই অসুস্থ মায়ের খোঁজ নিতে যিনি ভোলেন না। 

শুভ জন্মদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পাভেল রহমান: আলোকচিত্রী