Thank you for trying Sticky AMP!!

দেশের সংগীতাঙ্গনের দুই তারকা রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমীন পেয়েছেন ‘মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা’।

মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার: চলচ্চিত্র বিকাশে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসুক

শিল্পকলার শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে চলচ্চিত্রশিল্প। প্রথম দিকে চলচ্চিত্রের উদ্দেশ্য বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে এর ব্যাপ্তি বহুলাংশে বেড়েছে। সমাজ সংস্কারের ও বিভিন্ন অসংগতি দূরীকরণে, জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সিনেমাশিল্প অবদান রেখে চলেছে। নানা বাস্তবতায় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার দায়বদ্ধতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। বড় বা ছোট পর্দার ছায়াছবি, নাটক, টেলিফিল্ম, ওয়েব সিরিজ এখন সিনেমা হলের গণ্ডি পেরিয়ে স্থান পেয়েছে মুঠোফোনেও।

অনেক সময় আমরা ভালো মানের সিনেমার কথা বলে থাকি। ভালো মানের চলচ্চিত্র তৈরি অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এর মধ্যে অন্যতম হলো চলচ্চিত্রের প্রসারে বা বিকাশে যাচাই–বাছাইয়ের মাধ্যমে সিনেমাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পুরস্কার প্রদান বা সঠিক কাজের মূল্যায়ন করা। আমাদের পাশের দেশ ভারত কেন্দ্রীয়ভাবে ২০–২৫টির বেশি সংগঠনের মাধ্যমে চলচ্চিত্রের সঙ্গে জড়িত অভিনয়শিল্পী, কলাকুশলী, নির্মাতা, পরিচালক, প্রযোজকদের পুরস্কারের মাধ্যমে সম্মাননা প্রদান করে থাকে। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কোরিয়া, ইরানে সরকারের পাশাপাশি বহু বেসরকারি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নিজস্ব অর্থায়ন ও উদ্যোগে সিনেমাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পুরস্কৃত করে চলচ্চিত্রশিল্পের বিকাশে ভূমিকা রাখছে। এ ক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল ইন্ডিয়ান ফিল্ম একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, এশিয়ানেট অ্যাওয়ার্ড, ন্যাশনাল ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, জি সিনে অ্যাওয়ার্ড, এমটিভি মুভি ও টিভি অ্যাওয়ার্ড, ক্রিটিক চয়েস মুভি অ্যাওয়ার্ড, গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড, ডিরেক্টরস গিল্ড অব আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড, রাইটার্স গিল্ড আমেরিকা অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি পুরস্কারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে অস্কার পুরস্কার তো রয়েছেই।

চলচ্চিত্র খাতে যত বেশি পুরস্কার চালু হবে, যত বেশি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যাবে, দেশে তত বেশি ভালো মানের চলচ্চিত্র তৈরি হবে। তবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তো এমনি এমনি চলচ্চিত্র খাতে আর্থিক সহায়তা বা পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। এ ক্ষেত্রে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।

এদিকে বাংলাদেশে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মূল্যায়নের মাধ্যমে পুরস্কার বা স্বীকৃতি দেওয়ার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই বললেই চলে, যা চলচ্চিত্রশিল্পের বিকাশের জন্য একেবারেই সহায়ক নয়। সিনেমায় অবদানের জন্য স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বেসরকারিভাবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (বাচসাস) ও এর ঠিক পরের বছর ১৯৭৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়। বেসরকারিভাবে সিনেমার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মূল্যায়নের মাধ্যমে পুরস্কার দেওয়ার প্রক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ অনেক দেশেই দেখা যায়, যা শুধু প্রশংসনীয়ই নয়, অনুকরণীয়ও বটে।

বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়া নেই বললেই চলে। তবে এই অভাব অনেকাংশেই পূরণ করছে বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার। ১৯৯৯ সাল থেকে বাংলাদেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান স্কয়ার গ্রুপ ও বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পঠিত জনপ্রিয় প্রথম আলো পত্রিকা এই পুরস্কার প্রদান করে আসছে। এই পুরস্কার বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও নির্ভরযোগ্য পুরস্কার।

দীর্ঘ পথপরিক্রমায় এই পুরস্কারের মনোনয়ন, বাছাই, জুরিবোর্ড ইত্যাদি বিষয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো বিতর্ক শুনতে পাওয়া যায়নি। ২৩ বছরে সিনেমাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনুপ্রেরণার অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার। এই পুরস্কারের অন্যতম আকর্ষণীয় দুটি দিক হলো আজীবন সম্মাননা ও জুরিবোর্ডের মূল্যায়নের পাশাপাশি তারকা নির্বাচনে দর্শকদের ভোট দেওয়ার সুযোগ।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে অনন্য অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০২ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২০ শিল্পীকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করেছে মেরিল-প্রথম আলো। তবে আরও বেশ কয়েকটি শাখায় পুরস্কার দেওয়া হলে চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আরও বেশি উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হতেন বলে আমার বিশ্বাস। যেমন শ্রেষ্ঠ খলনায়ক, শ্রেষ্ঠ গীতিকার, শ্রেষ্ঠ সুরকার, শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার, শ্রেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক, শ্রেষ্ঠ পোশাক ও সাজসজ্জাকার, শ্রেষ্ঠ শিশুশিল্পী ইত্যাদি। আশা করি, ভবিষ্যতে মেরিল-প্রথম আলো কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় বিবেচনা করবে।

উপরন্তু স্কয়ার বা মেরিলের মতো অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্র পুরস্কার চালু করলে দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতি আরও বিকাশমান হতে পারত। এতে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হতো এবং এর মাধ্যমে ভালো মানের সিনেমা, ভালো মানের চিত্রনাট্য ও আন্তর্জাতিক মানের অভিনয়শিল্পী পাওয়ার অধিকতর সুযোগ তৈরি হতো। সোনার বাংলা বিনির্মাণে সমাজ থেকে অসংগতি, অন্যান্য দুর্নীতি ও অনাচার দূরীকরণে চলচ্চিত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। নাটক, সিনেমা, টেলিফিল্মের মাধ্যমে ধর্মীয় উগ্রবাদ, জঙ্গিবাদসহ অন্ধকারের অপশক্তি নির্মূলে চলচ্চিত্র অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন; আমার অনেক পরিচিত সাংস্কৃতিক বন্ধু রয়েছেন, যাঁরা আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ভালো সিনেমা তৈরি করতে পারছেন না। এ ক্ষেত্রে, বড় বড় শিল্প বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করলে নির্মাতারা সুষ্ঠু ধারার সিনেমা উপহার দিতে বাধ্য হবেন। এ ছাড়া সমকালীন ফ্যাশনের ধারা, পোশাক ও সাজসজ্জা খাত, বিউটি পারলার ও সেলুন খাত, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিমেশন, মিডিয়া ও ফিল্ম স্টাডিজের মতো বিষয়ে দিন দিন পড়ার ঝোঁক বাড়বে।

এখন একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ের অবতারণা করা যাক। বাংলাদেশে স্কয়ারের মতো অনেক শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে; যেসব প্রতিষ্ঠান চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও দেশীয় শিল্প–সংস্কৃতি বিকাশে বিশেষ অবদান রাখতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠান করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটির (সিএসআর) মাধ্যমে চলচ্চিত্র ও খেলাধুলার উন্নয়নে আর্থিক সহায়তা দিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ অন্যান্য দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো খেলাধুলা ও চলচ্চিত্র খাতে বিনিয়োগ করে থাকে।

চলচ্চিত্র খাতে যত বেশি পুরস্কার চালু হবে, যত বেশি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যাবে, দেশে তত বেশি ভালো মানের চলচ্চিত্র তৈরি হবে। তবে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তো এমনি এমনি চলচ্চিত্র খাতে আর্থিক সহায়তা বা পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। এ ক্ষেত্রে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। যেমন যেসব প্রতিষ্ঠান শিল্প, সংস্কৃতি ও খেলাধুলা প্রসারে বিনিয়োগ করবে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ কর রেয়াত দেওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া, বর্তমানে চলচ্চিত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার বিস্ময়করভাবে বাড়ছে। অ্যানিমেশন, সায়েন্স ফিকশন, কালার কম্বিনেশন, কার্টুন তৈরি, ব্যাকগ্রাউন্ড দৃশ্য, অ্যাকশন দৃশ্যসহ অনেক কঠিন কাজ এখন প্রযুক্তির মাধ্যমে করা শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইটি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষ সুযোগ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

Also Read: গানের সুর, নাচের ছন্দে জমকালো আনন্দসন্ধ্যা

মোদ্দা কথা, স্কয়ারের মতো অন্য বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো চলচ্চিত্র প্রসারে অর্থায়ন বা পৃষ্ঠপোষকতার হাত বাড়ালে দেশীয় চলচ্চিত্রের বিকাশ ত্বরান্বিত হবে বলে আমার বিশ্বাস। সব শেষে ব্যতিক্রমধর্মী এই অনুষ্ঠান প্রায় দুই যুগ ধরে চালু রাখার জন্য মেরিল-প্রথম আলো কর্তৃপক্ষকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

শেখ হাফিজুর রহমান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের একান্ত সচিব।