Thank you for trying Sticky AMP!!

মোদি: চেনা পথের পথিক

নরেন্দ্র মোদি

নরেন্দ্র মোদির দেশ শাসনের প্রথম চার বছর খুব সংক্ষেপে যদি ‘কুসুম কোমল’ হয়, শেষের বছরটা তাহলে অবশ্যই ‘কণ্টকাকীর্ণ’। ভাগ্যের চাকা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো যে এভাবে ঘুরবে, একটা বছর আগেও কেউ তা কল্পনায় আনেনি। প্রথম চারটি বছর প্রধানমন্ত্রী যা করেছেন, বিন্দুমাত্র বাধা তাঁকে পেতে হয়নি। অথচ এই শেষের বছরটায় যা কিছু তিনি করছেন অথবা করতে চাইছেন, প্রতিটির পেছনে ঝুলে থাকছে বড়সড় একটা প্রশ্নচিহ্ন। 

মোদির কাছে সবচেয়ে গর্বের যে জায়গাটা ছিল, দেশবাসীকে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন উপহার দেওয়ার অঙ্গীকার, সেই ফানুসেই সুচ ফুটিয়েছে বিরোধীকুল। রাফাল যুদ্ধবিমান কেনাবেচা চুক্তি যে প্রশ্নাতীত নয়, এই শেষ বছরে তা স্পষ্ট। যে প্রশ্নগুলো বিরোধীরা তুলে ধরেছে, তার কোনো জুতসই ও গ্রহণযোগ্য জবাব সরকার দিতে পারছে না। রাফাল প্রশ্নে সংসদকে এড়িয়ে যাওয়া, চুক্তির গোপনীয়তাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তথ্য–প্রমাণ আড়াল করা এবং সরকারি সংস্থাকে বঞ্চিত করে আনকোরা এক বেসরকারি সংস্থাকে বেছে নেওয়ার পক্ষে যেসব যুক্তির অবতারণা করা হচ্ছে তা যে স্রেফ খোঁড়া, তেমন মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই আচরণের মধ্য দিয়ে এটা অন্তত স্পষ্ট, মোদি সরকার সত্য চাপা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আদালতের সাহায্য নিয়ে ঠিক এইভাবে আড়াল করা হয়েছে শাসক দলের সভাপতির পুত্রের এক বছরে ‘অস্বাভাবিক বাণিজ্যবৃদ্ধির’ অভিযোগও। কোথাও কিছু যদি না থাকে তাহলে তদন্তে কেন এত অনীহা? তথ্য গোপনের কেন এমন মরিয়া চেষ্টা?

রাফালের মতো অন্য কাঁটাগুলোও বেশ তীক্ষ্ণ। যেমন সিবিআই। যেমন রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া। অথবা সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত। সিবিআইয়ে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা নিয়ে যেভাবে দুই শীর্ষ কর্তা নিজেদের তো বটেই, গোটা প্রতিষ্ঠানকে হাস্যাস্পদ করে তুলেছেন, সংগঠনের ইতিহাসে তা কোনো দিন হয়নি। প্রশাসনে অহেতুক ‘গুজরাটীকরণ’ আমলাশাহিকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। সিবিআইয়ের আজকের সংকটের পেছনেও দায়ী সেই গুজরাটীকরণের অসমর্থনীয় প্রয়াস। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী আর কাউকে কিন্তু দায়ী করতে পারবেন না। তাঁর জন্যই দেশের সেরা গোয়েন্দা সংস্থা আজ মানুষের আস্থা ও ভরসা হারিয়েছে। কীভাবে সেই জায়গাটা সিবিআই ফিরে পাবে, এই মুহূর্তে তা অজানা।

রিজার্ভ ব্যাংকও হয়ে উঠেছে সরকারের চোখের বালি। অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রিজার্ভ ব্যাংকের ধারণাগত যে পার্থক্য ও বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, কীভাবে তার অবসান ঘটবে তা–ও আপাতত জানা নেই। এসবের বাইরে রয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা ও প্রধানত কৃষকদের অর্থনৈতিক দাবিদাওয়া। নাসিক থেকে মুম্বাই পর্যন্ত লংমার্চ শেষে কৃষকেরা দিল্লিতে দু–দুবার জমায়েত করেছেন। এখন তৃতীয়বারের মতো সমাবেশের কথা ভাবছেন। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি, গোরক্ষা আন্দোলন, কথায় কথায় গণপিটুনি, কাশ্মীর সমস্যা, শরিকি অসন্তোষ বিভিন্ন রাজ্যে সরকারের অবস্থান টলমল করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে আসন্ন পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের মোকাবিলার পরেই প্রধানমন্ত্রীকে নামতে হবে ফাইনালের আসল লড়াইয়ে। পাঁচ বছর আগে যে লড়াইটা তাঁর কাছে ছিল মাখনের মধ্যে ছুরি চালানোর মতো মসৃণ, এবার বহু চড়াই–উতরাইয়ে রয়েছে হোঁচট খাওয়ার আশঙ্কা।

এই সেদিন কর্ণাটকে পাঁচ কেন্দ্রের উপনির্বাচন হয়ে গেল। তিনটি লোকসভার, দুটি বিধানসভার। তিন লোকসভার মধ্যে দুটি ছিল বিজেপির দখলে। বেল্লারি কেন্দ্রটি বিজেপির কাছে ছিল সেই ২০০৪ সাল থেকে, অন্যটি শিবমোগা, বিজেপির সবচেয়ে বড় নেতা সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরাপ্পার খাসতালুক। বেল্লারি কেন্দ্র কংগ্রেস ছিনিয়ে নিয়েছে। ভোটের ব্যবধান সোয়া দুই লাখের বেশি। শিবমোগার দায়িত্ব ইয়েদুরাপ্পা তুলে দিয়েছিলেন তাঁর ছেলের হাতে। আসনটি না হারালেও ভোটের মার্জিন সাড়ে ৩ লাখ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৫২ হাজারে! ২০১৪ সালে এই কর্ণাটকে লোকসভার ২৮টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ১৭টি। তাদের বাড়া ভাতে ছাই ফেলতে কংগ্রেস ও জেডিএস এবার জোটবদ্ধ।

রাজ্যে রাজ্যে এই জোটবদ্ধতা যদি ২০১৯–এর নির্বাচনের আবহ সংগীত হয়ে দাঁড়ায়, বিজেপির হাল কী হবে, সেই প্রশ্ন ক্রমেই বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে বিজেপির সম্ভাব্য কৌশল স্পষ্ট হচ্ছে দিন দিন। বিজেপি আঁকড়ে ধরছে সেই বহু প্রাচীন মুশকিল আসানকে—হিন্দুত্ব।

বাবরি মসজিদ–রাম জন্মভূমি মামলা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য এখন সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনাধীন। অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখ থেকে সেই মামলার শুনানি শুরু হওয়ার কথা ছিল। বিজেপি চাইছিল, ভোটের বাদ্যি বাজার আগেই সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টির মীমাংসা করে ফেলুক। বিজেপির সেই আশায় বালি ফেলেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দিয়েছেন, তাঁদের কাছে বিষয়টির অগ্রাধিকার নেই। শুনানি জানুয়ারি মাসের আগে শুরু করা যাবে না।

সুপ্রিম কোর্টের ওই মনোভাবই বিজেপিকে নামিয়ে দিয়েছে হিন্দুত্ববাদের চেনা রাস্তায়। রামমন্দিরকে ইস্যু করে ১৯৯২ সালের ধাঁচের আন্দোলন শুরুর হুমকি দলের নেতারা শুনিয়ে রেখেছেন। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ দীপাবলির দিনকে বেছে নিয়েছেন অযোধ্যা অভিযানের জন্য। অযোধ্যায় গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তির মতোই অযোধ্যায় গড়ে তোলা হবে দেড় শ ফুট উঁচু রামচন্দ্রের মূর্তি, যা স্থাপিত হবে ৫০ ফুট উঁচু এক বেদির ওপর। ফৈজাবাদ জেলা শহর, যার মধ্যে অযোধ্যার অবস্থান, তার নাম বদলে দিয়ে অযোধ্যা রেখেছেন। কদিন আগেই নাম বদল করেছেন এলাহাবাদের। নতুন নাম প্রয়াগরাজ। অযোধ্যায় রামের নামে বিমানবন্দর ও তাঁর বাবা রাজা দশরথের নামে মেডিকেল কলেজ গড়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। তাঁর নামকরণের সূত্র ধরে গুজরাটের বিজেপি নেতারাও আহমেদাবাদ শহরের নাম বদলে কর্ণাবতী রাখতে চাইছেন। আগামী দিনগুলোয় এমন নামবদলের ঘোষণা আরও হবে। তাদের কাছে ধর্মীয় মেরুকরণের রাস্তাই ভোট জেতার সহজ পথ। ভোট যত এগোচ্ছে, বিড়ম্বিত বিজেপি ততই সেই চেনা পথে হাঁটা শুরু করেছে।

কট্টর হিন্দুত্ববাদকে আঁকড়ে ধর্মীয় মেরুকরণের চেনা রাস্তায় হেঁটে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি আগামী বছর উতরে গেলে অবশ্যই সেটা হবে আরও এক চমকপ্রদ জয়। কিন্তু সেই জয় কি নরেন্দ্র মোদির পরাজয় বলেও গণ্য হবে না? বিশেষ করে সেই মোদির, যিনি সুশাসন, উন্নয়ন ও ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’–এর স্লোগান শুনিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন?  

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি