Thank you for trying Sticky AMP!!

মোবাইল কোর্টকে জনবান্ধব করতে হবে

খাদ্যে ভেজালরোধসহ অনেক কাজেই মোবাইল কোর্টের প্রয়োজন হয়

২৪ জুলাই থেকে শুরু হচ্ছে জেলা প্রশাসক সম্মেলন। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনে সারা দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকেরা সুযোগ পাবেন সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে প্রায় সব মন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে মতবিনিময়ের। পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া হবে। তাঁরা নীতিনির্ধারকদের অবগত করবেন মাঠের চলমান পরিস্থিতি। সরকারি কার্যক্রম বাস্তবায়নে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথাও আলোচনায় আসবে। সরকারের নির্বাহী কর্তৃপক্ষের সব কাজের সঙ্গে তাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট। বিশেষ দায়বদ্ধতা রয়েছে আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা, ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে। তাঁরা যেমন বলবেন, তেমনি পাবেন কিছু সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান। কিছু ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি। এ ছাড়া সরকারের নীতি ও উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নে তাঁদের বিশেষ ভূমিকা সম্পর্কে নির্দেশনা পাবেন। এসব দৃষ্টিকোণ থেকে যুগবাহিত এ সম্মেলনটি ফলপ্রসূ বলে বিবেচিত হয়।

তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন অনেকগুলো বিষয়ভিত্তিক অধিবেশনে বিভক্ত। সেসব বিষয়ের মধ্যে একাধিকবার মোবাইল কোর্ট প্রসঙ্গটি আলোচিত হওয়ার কথা। উল্লেখ্য, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে জেলা প্রশাসকেরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটও। প্রস্তাব আসতে পারে তফসিলে নতুন কোনো অপরাধের সংযোজন কিংবা এটা পরিচালনায় বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সময়োচিত সাড়া দিতে ব্যর্থতার প্রসঙ্গ। উল্লেখ্য, ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথক্করণের ফলে নতুন প্রয়োজনীয়তার প্রেক্ষাপটে মোবাইল কোর্ট অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এরপর জাতীয় নির্বাচন শেষে ২০০৯ সালে এটা পায় সংসদের আইনের মর্যাদা। আইনটির সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা আছে। সেখানেই এর চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারিত হবে।

তবে অনেক হোঁচট খেলেও আইনটি ব্যাপক জনসমর্থিত বলে লক্ষ করা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়াবাড়ি সমালোচিত হয়েছে। কয়েকজন উচ্চ আদালতে এসে ক্ষমাপ্রার্থনা করে তিরস্কৃত হয়ে রেহাই পান। তবে ভেজাল প্রতিরোধ, বাল্যবিবাহ বন্ধ, মাদক কারবারিকে দমন, ইভ টিজিং প্রতিরোধসহ বহুবিধ কাজে সংশ্লিষ্ট হয়ে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে ব্যবস্থাটি। প্রচলিত আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এ ধরনের অপরাধীদের সাজা প্রদান দুরূহ ও সময়সাপেক্ষ বলে জনশৃঙ্খলা রক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ এ আইনটি চালু রেখেছে। তবে একে আরও জনবান্ধব করতে আইন কিংবা এর প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে কিছুটা খোলামেলা আলোচনা প্রয়োজন।

চরিত্রগতভাবে আইনটিতে অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ খুবই সীমিত। সে ক্ষেত্রে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি মানবাধিকারের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে। এ জন্যই দায়িত্বটি তাঁদের হাতে। মোবাইল কোর্ট আইনের কয়েকটি সুস্পষ্ট দিক আছে। এর একটি হলো, অপরাধটি সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে ঘটতে বা উদ্ঘাটিত হতে হবে। অন্যদিকে দোষ স্বীকার করতে হবে আসামিকে। এর ব্যত্যয় ঘটলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ওই আসামির বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে নির্দেশ দিতে পারেন। কিছু অঘটন ঘটার পর উচ্চ আদালত এবং সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে এখন মোটামুটি ঠিকঠাকই চলছে।

তবে আইনটি প্রয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু সংস্থা ক্ষেত্রবিশেষে অসহিষ্ণুতা দেখায়। তেমনি এর অংশীদার হয়ে পড়েন কোনো নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আসামিকে ধরে নিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসকক্ষে বিচার করা হয়-এমন অভিযোগও আসে। অভিযোগ আছে দোষ স্বীকার না করলেও তা করেছে বলে লেখা হয়। হয়তোবা সারা দেশে নিত্যদিন যত মোবাইল কোর্ট কাজ করছেন, সেই সংখ্যা বিচারে এ অনিয়মের মাত্রা খুবই কম। তবে এরূপ দু-একটি ঘটনাই তো অনেক সাফল্যকে ম্লান করে দিতে পারে।

মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী ম্যাজিস্ট্রেট দণ্ডিতকে আপিলের জন্য জামিন দিতে পারেন না। এ ক্ষমতা আপিল কর্তৃপক্ষ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বা তাঁর পক্ষে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের। যে জামিনের আবেদন ও আপিল করতেও দণ্ডাদেশের নকল প্রয়োজন। আর এই নকলপ্রাপ্তি বিভিন্ন অজুহাতে কিছু ক্ষেত্রে অযাচিতভাবে বিলম্বিত হয়। তেমনি বিলম্বিত হয় জামিন বা আপিল শুনানিও। এতে দণ্ডিত ব্যক্তির প্রতি অবিচার করা হলো বললে অত্যুক্তি হবে না। কেননা, এই আপিল নিষ্পত্তির পরই পরবর্তী আপিল করা যাবে দায়রা জজের কাছে। এমনটা ঘটা কিন্তু মোবাইল কোর্ট আইনের চেতনার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। আইনটির প্রণেতাদের উদ্দেশ্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও অপরাধ প্রতিরোধ কার্যকরভাবে সম্পাদন করা। অনেক কিছু ঠিকঠাকমতো চললেও কোথাও কেন এমনটা ঘটে, এটা দুর্বোধ্য। সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে যথার্থতা যাচাই করার জন্যই তো রয়েছে আপিল কর্তৃপক্ষ।

মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় এ ধরনের অনিয়মের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। সংশ্লিষ্ট নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অভিজ্ঞতার ঘাটতি কিংবা ভিন্ন কোনো মহলের চাপের কথা ক্ষেত্রবিশেষে জানা যায়। উল্লেখ্য, এই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কেউ হয়তোবা সরাসরি জেলা প্রশাসনে নিয়োজিত আছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ফৌজদারি কার্যবিধির ১০ ধারায় নিযুক্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আবার তাঁরা ছাড়াও অন্য সংস্থায় কর্মরত বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সে আইনের ১২ ধারা অনুসারে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দেওয়া হয়। এরূপ দেওয়া হয় সিটি করপোরেশন, রাজউক, বিদ্যুৎ, গ্যাস, বিমানবন্দর এমনকি র‍্যাবের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭ ধারা অনুসারে সব শ্রেণির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অধীন।

অবশ্য চর্চার অভাবে পরবর্তী অংশে আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেটরা এমনকি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরাও পারস্পরিক সম্পর্ক ভুলে গেছেন বা যাচ্ছেন। এ বিষয়টি নিয়ে সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। তবে নিজের সংস্থাপনের তদারকি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা করেন। তাঁদেরই দায়িত্ব নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা যাতে বিচক্ষণতার সঙ্গে কাজটি করেন, তা নিশ্চিত করা। মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় নবীন ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। তাঁদের বোঝাতে হবে জেলার আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা ও জনচাহিদার পাশাপাশি মানবাধিকারের বিষয়টির সমন্বয় নিশ্চিত করা। সমাজবিরোধী কোনো কোনো লোক অকুস্থলে শাস্তি পেলে আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়বে। তেমনি শক্তিশালী হবে সরকারের ভিত।

অন্যদিকে বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ নিয়ে নিরপরাধ কাউকে অথবা আইনের আওতা ডিঙিয়ে সাজা দিলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মোবাইল কোর্টের ভাবমূর্তি। ঠিক তেমনি দণ্ডিত ব্যক্তিদের রায়ের নকল কিংবা আপিল শুনানিতে কালক্ষেপণও বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। এতে পাল্টা ক্ষতিগ্রস্ত হবে জনশৃঙ্খলা। মর্যাদা হারাবে জনপ্রশাসন। এটা স্মরণে রাখতে হবে, মোবাইল কোর্টের জন্য নিবেদিত চিত্তের যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট আবশ্যক। এ ধরনের কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট নিকট অতীতেই গোটা দেশে জননন্দিত হয়েছেন, এটা ভুললেও চলবে না। এ ধরনের কর্মকর্তা কিন্তু রয়েছেন আমাদের মাঝে। দরকার তাঁদের যথাযথ প্রশিক্ষণ, প্রেরণা ও নানামুখী চাপের মুখে নিরাপত্তা বিধান। এরূপ করার মূল দায়িত্ব জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের। তাঁরা অনেকেই তা করছেন। তবে কিছু ক্ষেত্রে পেরেও উঠছেন না। বৈরী পরিস্থিতির পাশাপাশি তাঁদের শৈথিল্যও এ ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়। চাকরি বাঁচানোর দায় আছে সবার। তবে বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে অনেক কিছু করাও যায়।

অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করা মোবাইল কোর্টব্যবস্থাটি সূচনা থেকেই কোনো কোনো মহলের কাছে বিরক্তিকর ছিল। তবে এটা জন-উপযোগিতার সঙ্গে খুবই সংগতিপূর্ণ হওয়ায় এখনো ব্যাপক পরিসরে সমাদৃত। অনেক কাজের জন্যই মোবাইল কোর্টের প্রয়োজন হয়। সেই প্রয়োজন মেটাতে সাড়া দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। তাঁদের সহায়তা করেন বিভিন্ন আইনপ্রয়োগকারী বা সেবাদানকারী সংস্থার লোকজন। এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ম্যাজিস্ট্রেটেরই। তবে যাঁরা সহায়তা দিচ্ছেন, তাঁদের কার্যকর ভূমিকাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আবেগমুক্তভাবে প্রকৃত অপরাধীকে যথানিয়মে আইনের আওতায় আনতে হবে।

তেমনি মোবাইল কোর্ট আইনের বিধান যেখানে কার্যকর হবে না, সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে অপরাধী মনে হলে ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে পরিস্থিতির। তাঁকে প্রচলিত আইনে অভিযুক্ত করার সুযোগ রয়েছে। আইনের দ্বারা গঠিত কোর্ট আইন অনুযায়ীই চলবে। এর অন্যথা করার সুযোগ কোথাও কারও নেই। আর থাকাও সংগত নয়। জেলা প্রশাসকেরা তাঁদের এ সম্মেলন চলাকালে পারস্পরিক আলোচনা এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশনামতো বিষয়টি সম্পর্কে নিজেদের আরও সমৃদ্ধ করতে পারেন। এর ইতিবাচক ছাপ আমরা মাঠ প্রশাসনে দেখতে চাই।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
majumderali 1950 @gmail. com