Thank you for trying Sticky AMP!!

যে দিনটির কথা ভুলে গেছে সবাই

১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৫। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র টিএসসি এলাকায় তখন বিকেল। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটির (ডিইউডিএস) আয়োজনে ‘ভালোবাসা দিবস বিতর্ক’ অনুষ্ঠান চলছে। এতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাওয়া বিতার্কিকদের মধ্যে আমিও একজন! মনে তাই ভীষণ ফুর্তি।

দিনটিকে এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। স্বোপার্জিত স্বাধীনতা ভাস্কর্যকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে তৈরি করা মঞ্চে চলছে রম্য বিতর্ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আর ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে ঘুরতে আসা কয়েক শ মানুষ ঘাসের ওপর বসে বিতার্কিকদের পাল্টাপাল্টি যুক্তি উপভোগ করছেন। হঠাৎ দূর থেকে একটা বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে এল। মঞ্চের সামনে চত্বরে বসে থাকা দর্শকেরা নড়েচড়ে বসলেন। সবাই বোঝার চেষ্টা করছেন কী ঘটল। চারপাশ স্বাভাবিক থাকায় ভাবলাম গাড়ির টায়ার ফেটেছে। পুনরায় বিতর্ক শুরু হলো। কয়েক মিনিট পরেই আবার প্রচণ্ড শব্দ। এবার খুব কাছে, মাত্র কয়েক হাত দূরে। পরিষ্কার দেখলাম মঞ্চে বসা অমর একুশে হলের অমিত আর আমার হলের (বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল) ছোট বোন রিমুর ঠিক পেছনে ককটেলের ফুলকি উড়িয়ে একটা বোমার বিস্ফোরণ ঘটল।

সবাই পাগলের মতো দিগ্‌বিদিক ছুটছে। চারপাশে বারুদের গন্ধ। উড়ছে ধোঁয়া। অনেকের মতো নূপুর আর আমিও দৌড়াচ্ছি, দুজনই আতঙ্কে দিশেহারা। আমরা টিএসসি ভবনের নিচতলায় চলে গেলাম। দেখলাম সেখানে অন্য বিতার্কিকেরাও জড়ো হয়েছেন। অমিতের পিঠে আর রিমুর পায়ে স্প্রিন্টার বিঁধেছে। আরও বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। পুলিশ ঘটনাস্থল ঘিরে রেখেছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। এ অবস্থার মধ্যেই দেখলাম হতবিহ্বল অবস্থা কাটিয়ে ডিইউডিএসের সদস্যরা আহত ব্যক্তিদের ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। বিতার্কিকেরাও ছুটল সেদিকে।

ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে দেখলাম, স্ট্রেচারে স্প্লিন্টারবিদ্ধ ক্ষতবিক্ষত পা নিয়ে শামসুন্নাহার হলের ছোট বোন ফাতেমা প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তার পায়ের দিকে তাকানো যাচ্ছে না, রক্তে চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। পাশের স্ট্রেচারে আরেকটি মেয়ে, তার শরীরেও স্প্লিন্টার বিঁধেছে। আমাদের সামনেই দুজনের শরীর থেকে চিকিৎসকেরা স্প্লিন্টার বের করলেন। আমাদের দায়িত্ব হলো তাদের জড়িয়ে ধরে রাখা, যেন নড়াচড়া করতে না পারেন। সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। ফাতেমাকে আমরা দু-তিনজন মিলেও ধরে রাখতে পারছিলাম না। পা থেকে স্প্লিন্টার বের করার প্রতিটি মুহূর্তে তিনি পাগলের মতো চিৎকার করছিলেন। একসময় ক্ষত পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ হলো। এক হাত দিয়ে হাতে নল দিয়ে লাগানো স্যালাইনের বোতল উঁচু করে ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। নূপুর অন্য মেয়েটির শরীর থেকে স্প্লিন্টার বের করার কাজে সাহায্য করতে গেল। এভাবে কত মুহূর্ত কেটে গেল জানি না। একসময় তাদের দুজনকেই ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়া হলো। আমরা সারা হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে অন্যদের খবর নিলাম। বাসার সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। আস্তে আস্তে আঘাতপ্রাপ্ত সবারই শরীর থেকে স্প্লিন্টার বের করা শেষ হলো। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত অবস্থায় আমরা যখন হলে ফিরলাম, তখন গভীর রাত।

ওই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে কোনো তদন্ত হয়নি। পত্র-পত্রিকায় কেউ কলমের ঝড় তোলেননি। থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। পরের বছর ২০০৬-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি ডিইউডিএসের বিতার্কিকেরা কালো পতাকা নিয়ে ও মুখে কালো কাপড় বেঁধে র‍্যালি করেছিল। র‍্যালিতে ওই সময়ের ডিইউডিএসের মডারেটর ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম স্যারও ছিলেন।

এরপর কয়েক বছর বিতার্কিকেরা ভালোবাসা দিবসে নির্দিষ্ট সময়ে টিএসসি এলাকায় একত্রিত হয়েছে, মানববন্ধন করেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কখনো দিনটিকে স্মরণ করার কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি না মেলায় ভালোবাসা দিবসসহ বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর অনুষ্ঠান আয়োজনের সংখ্যা কমে গেছে। ধীরে ধীরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কীভাবে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিস্তার ঘটেছে তা স্বচক্ষে দেখার দুর্ভাগ্যও আমাদের হয়েছে। এটাই সান্ত্বনা যে তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যথাসম্ভব স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তারা রাজাকার স্তম্ভ তৈরি করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেছে।

আমরা যারা সেদিন টিএসসি এলাকায় ছিলাম, হোক বিতার্কিক হিসেবে অথবা দর্শক হিসেবে, আসুন সেই দিনটির কথা, আমাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা সবাইকে জানাই। পত্রিকায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখি। শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে একটি বোমা হামলা হওয়া মানে সেটি সারা দেশের তরুণ সমাজ এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার ওপর হামলার শামিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কাছে আমার প্রস্তাব, ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা হামলার ঘটনাটিকে স্মরণ করে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিবছর ১৪ ফেব্রুয়ারি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হোক। ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’কে মূল প্রতিপাদ্য করে সেই আয়োজনগুলোতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা তাদের শক্ত অবস্থানের কথা ঘোষণা করবেন। আজ থেকে তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিটি ভালোবাসা দিবস হোক বাংলাদেশ এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি গভীর ভালোবাসা প্রকাশের দিন। দেরি হোক, সময় তো যায়নি।

উপমা মাহবুব, উন্নয়ন পেশাজীবী