Thank you for trying Sticky AMP!!

যে শোক ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন

মোহাম্মদ বদরুল আহসান।

সদ্য প্রয়াত লেখক-সাংবাদিক মোহাম্মদ বদরুল আহসানের স্মরণে সৈয়দ বদরুল আহসান এবং আব্দুল হান্নানের মতো প্রখ্যাত কলাম লেখকেরা তাঁদের লেখায় তাঁর পাণ্ডিত্য এবং ইংরেজি ভাষায় অসাধারণ দক্ষতার প্রভূত প্রশংসা করেছেন। ডেইলি স্টার–এ ‘ক্রস টক’ শিরোনামে প্রকাশিত তাঁর কলামগুলোর আমি ছিলাম একজন অনুরাগী পাঠক। বিষয়ের বৈচিত্র্যে এবং ভাষার মাধুর্যে কলামগুলো ছিল অতি সমৃদ্ধ। ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ ছাড়াও দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রেম-বিরহের কথা সুনিপুণ হাতে ইংরেজি ভাষায় লিখিতেন। তাঁর গদ্যশৈলীতে একটা অতিসুন্দর লালিত্য আছে, যা লিরিক্যাল বা গীতিধর্মী বৈশিষ্ট্যে অনিন্দ্য। তাঁর লেখার মধ্যে আছে কাভারলি পেপারস–এর লেখক জোসেফ এডিসনের বোধ-বুদ্ধি আর ভাষার ঐশ্বর্য এবং এ কালের লেখক অরুন্ধতী মুখার্জির ভাষার মাধুর্য। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র না হয়েও ইংরেজি ভাষায় তাঁর এই দক্ষতা কোথায় পাওয়া জিজ্ঞেস করলে তিনি তাঁর বাবা অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ সেরাজুল ইসলামের কথা বলতেন। তাই তিনি বোধ করি নিজের লেখার প্রথম সংকলন A Good Man in the Woods বাবাকে উৎসর্গ করেছিলেন; লিখেছিলেন, ‘যিনি আমার শিক্ষকও ছিলেন’। মোহাম্মদ বদরুল আহসান ছিলের একজন নিরহংকার, সাদাসিধে এবং বন্ধুবৎসল মানুষ। তাঁর অতি সাধনার সাপ্তাহিক পত্রিকা ফার্স্ট নিউজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি পত্রিকাটির কর্মীদের পাওনার বিষয়ে ছিলেন খুবই সংবেদনশীল এবং তাঁর অক্লান্ত চেষ্টায় সেসব বিষয়ের সুষ্ঠু সমাধান নিশ্চিত হয়।

ব্যক্তিগত জীবনে বদরুল ছিলেন নিভৃতচারী ও অন্তর্মুখী। নিজের কথা বলতে ছিলেন অনাগ্রহী। পেশায় ছিলেন ব্যাংকার, কিন্তু লেখালেখির প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ টান। বদরুলের সঙ্গে আমার বয়সের পার্থক্য পঁচিশ বছর। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে তিনি ছিলেন আমার কন্যা সাদিয়ার সহকর্মী। বয়সের এই বিশাল ব্যবধান আমাদের বন্ধুত্বের মধ্যে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি, বরং তা ক্রমেই প্রগাঢ় হয়েছে। আমি ডেইলি স্টার–এ তাঁর কলামের অনুরাগী পাঠক ছিলাম। বৃদ্ধ বয়সের নানা উপসর্গ, দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসা, হাঁটুর শরীরের ভার বইবার ক্ষমতা হ্রাস, শ্রবণের দুর্বলতা বৃদ্ধি, এসব নিয়ে একটি রসঘন কলামের শেষে তিনি লিখেছিলেন, এইসব হতাশার মধ্যে বৃদ্ধ বয়সে আশার বাণী একটিই যে এসব কিছুর অবসানে আর খুব বিলম্ব নেই। আমি তখন বার্ধক্যে উপনীত। লেখাটি পড়ে খুবই শাবাশ দিয়ে তাঁকে একটা ই-মেইল করলাম। তারপর থেকেই দুই অসম বয়সের বন্ধুত্ব।

২০০৬ সালের মাঝামাঝিতে আমার স্ত্রী-বিয়োগ ঘটে। বদরুল তখন দুবাইতে কর্মরত। আমাকে লিখে পাঠালেন, ‘ভ্রমণে শোকের লাঘব হতে পারে মনে করে অনুরোধ করছি কদিন আমার সঙ্গে কাটানোর জন্য।’ তাঁর ডাকের মধ্যে এমন একটা আন্তরিকতা ছিল যে তা উপেক্ষা করা যায়নি।

তাঁর ঢাকায় ফিরে আসার পর থেকে আমরা অনেক সময় কাটিয়েছি একসঙ্গে। বাইরে যাওয়ার বাতিক ছিল দুজনেরই। ফাইন ডাইনিংয়ের খোঁজে আমরা বাকি রাখিনি কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁ। প্রতি বৃহস্পতিবার ছিল আমাদের সাক্ষাতের দিন। যেদিন তিনি চলে গেলেন, সেই দিনটাও ছিল বৃহস্পতিবার। ভেবেছিলাম, তাঁকে ডাকব কোথাও খেতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমার ডাক পৌঁছানোর আগেই তাঁর অন্য ডাক এসে যায়। সকালে তাঁর বন্ধু আন্দালিব রাশদী জানালেন, বদরুল আর নেই। তিনি কি জানলেন, আমার যে শোক লাঘব করতেও আমাকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন, একদিন তাই আবার কঠিন করে ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন আজ!

দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক

                          তবে তাই হোক।

মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক

                          তবে তাই হোক।

পূজার প্রদীপে তব জ¦লে যদি মম দীপ্ত শোক

                          তবে তাই হোক। 

এম এ নূর: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী