Thank you for trying Sticky AMP!!

রাজনীতিতে রাজনীতি কোথায়?

বিএনপির সরকার পতনের হুমকি আর আওয়ামী লীগের পাল্টা হুমকি আগামী কয়েক দিনে বাড়তেই থাকবে বলে মনে হচ্ছে। বিএনপি জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘অবৈধ’ বলতে চায়। আওয়ামী লীগ ‘অবৈধ’ দূরের কথা, এই নির্বাচন যে সংসদীয় গণতন্ত্রের অনুশীলনে একটি বড়সড় ‘অস্বাভাবিকতা’, তা স্বীকারে নারাজ। প্রধান দুই দলের এমন অবস্থান যে স্থিতিশীলতার বিপক্ষে যায়, তা কে না বোঝে? কেবলই সংবিধানের ধারা-উপধারায় ভর করে রাজনীতির ব্যাখ্যা করনেওয়ালারা এই দুই অনড় অবস্থানের কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না দিতে পেরে রাজনীতিকদের ‘মন-মানসিকতার উন্নতি ঘটাতে হবে’-মার্কা বায়বীয় বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন, তাও অনেক দিন। আর এই ফাঁকে রাজনীতি দিনকে দিন নেই হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে। রাজনীতি নেই হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে? এ রকম একটা কথা বললে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবেন এমন মানুষের সংখ্যা, আশার কথা, এখনো অনেক। কিন্তু মোটা দাগে মানবকল্যাণ অর্থে রাজনীতিকে বিবেচনা করলে বাংলাদেশে রাজনীতি থেকে সত্যিই তো রাজনীতি নেই হয়ে যাচ্ছে। বড় দুই দলের কথার লড়াইয়ে সত্যিকারের রাজনীতি কোথায়? রাজনীতি যদি সত্যিই থাকত তাহলে তোবা গ্রুপের শ্রমিকেরা আমরণ অনশনে ঈদ যাপন করেন? শ্রমিকের মজুরি, শ্রমিকের পাওনা না দিয়ে পুরোনো-পাপী মালিকের বহাল তবিয়তে থাকার মধ্যে কি রাজনীতির দেখা মেলে? দেখা হয়তো মেলে, তবে তা রাজনীতির কদর্থে। নোয়াখালীতে আবার সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে।প্রশাসন ইতিমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছে। দৃশ্যত পরিস্থিতি ঠান্ডা। কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তিরা টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে রোদন করতে করতে মিডিয়া নজর সরে গেলে আবার আক্রান্ত হয়ে যাওয়ার শঙ্কা জানিয়েছেন। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুকে নিরবচ্ছিন্ন আতঙ্ক ও অস্বস্তির জীবন যাপন করতে হয়—এ কেমন রাজনীতি?
সামরিক শাসকেরা বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে রাজনীতিকে নেই করে দেওয়ায় বিপুল সাফল্য দেখিয়েছিলেন। নব্বই-পরবর্তী সংসদীয় গণতান্ত্রিক আমলে পুরোনো বুদ্ধিজীবীদের স্থলাভিষিক্ত হওয়া সুশীল সমাজের একাংশ এই ধারাটিকে জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতে বেশ পুষ্ট করছেন। মূলধারার রাজনীতির একটি অংশের ওপরে ক্রোধবর্ষণ করতে গিয়ে এঁরা রাজনীতি শব্দটিকেই ঘৃণিত করে তুলছেন; আর রাজনীতিকমাত্রই খারাপ, এ ধরনের একটা ধারণা নিরন্তর নির্মাণ করে চলেছেন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে এই ধারণা সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এঁদের সঙ্গে আছেন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সেই অংশটি, যাঁরা তাঁদের সন্তানের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের মাটিতে দেখতে এতটুকু প্রস্তুত নন। খারাপ রাজনীতিকের কাছ থেকে খারাপ-খারাপ সুযোগ নেওয়া (কথার কথা, অন্যায় প্রমোশন-পোস্টিং ব্যবসা) এই অংশটি সুযোগ পেলেই রাজনীতিক ও রাজনীতিকে গালাগাল করে এবং অন্যদেরও একই কর্ম করতে শেখায়। নিজের সন্তানকে শেখায় সবার আগে। এসব নেতিবাচকতার নিট-ফল হচ্ছে খুব রাজনীতিবিমুখ, রাজনীতিবিরোধী আত্মকেন্দ্রিক ভোগসর্বস্ব একটি তরুণ সম্প্রদায়, যাদের চোখের ভাষা পড়লে ভয় লাগে। রাজনীতিতে ‘মেধাবীদের’ প্রবেশে রাস্তা বন্ধ থাকা নিয়েও আহাজারি ও ক্রোধ করতে দেখা যায় রাজনীতি ঘৃণাকারীদের। ‘মেধাবী’ বলতে কী বোঝানো হয় কে জানে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি আসনের জন্য ৬০-৭০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যারা ভর্তি হয়, তারা কি ‘মেধাবী’ নয়? তাহলে এই ‘মেধাবীদের’ মধ্যে মূলধারার রাজনীতিতে আসা অনেকেই কীভাবে বখে যায়? মেধার অভাবে মূলধারার রাজনীতির এই দশা এমন সরল সমীকরণ বিরক্তির উদ্রেক করে মাত্র; কাজের কাজ কিছু হয় না। আর রাজনীতির ময়দানে গোলাপ ফুল ছিটিয়ে রাখা হবে আর মেধাবীরা এসে রাজনীতি করে ধন্য করে দেবে, এমন হাস্যকর কথা আমাদের দেশেই সম্ভবত বলা হয়। আসলে তথাকথিত ‘মেধা’ নয়, দরকার কমিটেড রাজনৈতিক কর্মী।
এখন কাজের কাজ হচ্ছে, রাজনীতিতে রাজনীতি ফিরিয়ে আনা। তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করা; রাজনীতিক মাত্রই খারাপ, এ রকম একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ধারণা না দেওয়া। তা না হলে রাজনীতির নামে কোন্দল, উপদলে-উপদলে হানাহানি, সিন্ডিকেটবাজি, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদী তৎপরতা চলতেই থাকবে। বিএনপি সরকার ফেলে দিতে চায়, তাতে সাধারণ মানুষের কী? নির্বাচনের অসংগতি এতটুকু স্বীকার না করার আওয়ামী অবস্থানে সাধারণ মানুষের স্বার্থ কোথায়?
শান্তনু মজুমদার: রাজৈনতিক বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক।