Thank you for trying Sticky AMP!!

রাজনীতির ঘৃণা-বিদ্বেষও অতিমারি বাড়ায়

ফিলিপাইনের করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য কট্টরপন্থী দুতার্তেকেই দায়ী করা হচ্ছে

দিন কয়েক আগের কথা। যমুনা টিভিতে চলছে টক শো ‘আমজনতা’। ক্ষমতাসীন দলের সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান সাহেব এবং বিএনপির সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন (আলাল) সাহেবের আলোচনাযুদ্ধ শেষ হয়েছে। টক শোর শেষ দিকে উপস্থাপক একটি চমক আনলেন। দুজনকেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাদের একদল অন্য দলের দোষ ছাড়া কিছুই দেখেন না, ঠিক আছে। কিন্তু কিছু না কিছু ভালো কাজ তো সবারই থাকে। আজ প্রতিপক্ষ দলের দু-একটি ভালো কাজের কথা বলুন, প্লিজ।’

শাজাহান খান উত্তর দিলেন, ‘তা হলে তো মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজতে হবে।’ অর্থাৎ কিছুই নাই! মোয়াজ্জেম সাহেব অবশ্য খানিকটা উতরে গেলেন। বললেন, একটা ভালো কাজ হয়েছে বাকশালে ফেরত না যাওয়া। আরেকটা ভালো কাজ, গত কয়েকটি সরকারের করা আইন-কানুনকে খুব বেশি কাটাছেঁড়া করে চুয়াত্তরের আইনের কাছাকাছি না নিয়ে যাওয়া। তিনিও প্রকারান্তরে এই ধারণাই দিলেন যে, আসলে ক্ষমতাসীনদের ভালো কাজ কিছু নেই। ভালো বলতে এটুকুই যে আরও খারাপ কিছু করেনি!

একসময় কানাডার ম্যানিটোবা প্রদেশের আইনসভা ভবনে কর্মরত ছিলাম। সেই সময় ব্যক্তিগত আগ্রহেই বিশ্বের প্রায় ৩০টি উন্নয়নশীল দেশের বহু সাংস্কৃতিক (মাল্টিকালচারাল) অনুষ্ঠানের কিছু কিছু আর্কাইভ ভিডিওর শ্রুতলিখন (ট্রান্সক্রিপশন) করেছিলাম। অনুষ্ঠানগুলো মুলত সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যদের টক শো।

শ্রুতলিখনের সময় শতভাগ না হলেও অন্তত ৯০ ভাগ ভিডিওতেই দেখলাম, নেতারা প্রতিপক্ষ সম্পর্কে কথা বলার সময় প্রশংসার কমতি রাখছেন না। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে মঞ্চে উঠে বলছেন, ‘আপনারা ভাগ্যবান যে মি. অমুকের (বিরোধী পক্ষ) মতো পরিশ্রমী, নিবেদিতপ্রাণ ও দরদি মানুষ আপনাদের সঙ্গে আছেন। তাঁর দল সরকারে না থাকতে পারে, কিন্তু তাঁর মাধ্যমে আপনাদের ভালো-মন্দ সরকারকে অবহিত করতে দ্বিধা করবেন না। মনে রাখবেন, আমরা পরস্পরের সহযোগী।’

যে রকম পারস্পরিক সম্মান ও শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁরা একে অন্যকে সম্বোধন করেন, দেখলে-শুনলে বুঝতে পারা যায়, তাঁরা গণতান্ত্রিক দেশের রাজনীতিক। এই সম্মানবোধটি যেখানে নেই, সেখানে গণতন্ত্র নেই। সমীকরণটি এরকমই সহজ। কর্মসূত্রেই গণতন্ত্রের আরও অনেক সৌন্দর্য চাক্ষুষ করেছি। প্রায় সব দুর্যোগ মোকাবিলা কমিটিই দেখতাম সর্বদলীয়। ধরা যাক, একটি এলাকায় টর্নেডোতে কিছু ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হলো। এলাকাটিতে বিরোধী দলের সমর্থন বেশি। অবধারিতভাবেই সেই এলাকার বিরোধী রাজনীতিককে প্রধান করেই দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি তৈরি হয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তাঁদের দায়িত্ব বিনা পক্ষপাতে পালন করেন। সরকারে নেই বলে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিরোধীদের সঙ্গে আচরণেও ন্যূনতম হেরফের করা হয় না।


পাশের দেশ ভারতে করোনা প্রতিদিন কয়েক হাজার প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। হাসপাতালে জায়গা নেই। ফুটপাত, মসজিদ-মন্দিরে ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল বানানো হয়েছে। অক্সিজেনের সংকট চরমে। দিল্লিতে শ্মশানে ও কবরস্থানে গণসৎকার চলছে। দুনিয়াজুড়ে পত্রপত্রিকা-টিভিতে সেসব সংবাদ মুহুর্মুহু প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলছেন, সব মিথ্যা কথা। অক্সিজেনের কোনো সংকট নেই। উল্টো উগ্রমূর্তি ধারণ করে হুমকি দিয়ে বললেন, যারা বলছে অক্সিজেনের সংকট, তাদের সবার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। ফিলিপাইনের দুতার্তেও এ রকম খেপেছিলেন। গত বছর সত্য বলার অপরাধে এবং লকডাউনের নিয়মে সামান্য হেরফের করায় এক লাখ নাগরিককে গ্রেপ্তার করেছিলেন। জেল-জরিমানারও সীমা-পরিসীমা রাখেননি। এই গায়ের জোরি মানসিকতাই বলে দেয়, শাসকেরা গণতন্ত্রহীন নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতির কাদায় আটকে আছেন, যা থেকে উদ্ধারের সম্ভাবনা ক্ষীণ।

নিম্নতর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘ডিনায়াল’ বা অস্বীকৃতির প্রবণতা বড় বেশি। এই বদ-অভ্যাস শুধুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরোধিতাতেই থেমে থাকে না, সব কর্মকাণ্ডেই ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় সত্যকে অস্বীকার করার মচ্ছব। দুর্যোগ হয়তো মহাদুর্যোগে পরিণত হচ্ছে, কিন্তু দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা অনবরত অস্বীকার করে চলেন। করোনাকালে ভারত, ব্রাজিল, ফিলিপাইন, বাংলাদেশ, এমনকি ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্রেও এই আচরণ দেখা গেছে। তাঁরা অনর্গল বলেছেন, তাঁদের মহাপ্রস্তুতি রয়েছে। টিকা-অক্সিজেন-আইসিইউ-ওষুধ সবকিছুর পর্যাপ্ত জোগান রয়েছে। সত্য-মিথ্যা বহু কিছু মিলিয়ে ভবিষ্যতের নিরাপত্তার স্বপ্নও দেখিয়ে গেছেন বিরতিহীন। তাঁদের বক্তব্য-বিবৃতিতে সন্দেহ বা প্রশ্ন উত্থাপন করাও নানা রকম গণনিয়ন্ত্রণমূলক আইনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ।

উল্লেখিত সব দেশের মধ্যেই আরেকটি বিষয়ে মিল রয়েছে। বিরোধী দল সহায়তা করতে চাইলে বলে, দরকার হবে না। ভিন্ন দল-মতের মানুষ স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে কিছু করতে চাইলেও নিগৃহীত হচ্ছেন। অনেকে বিপদে পড়ার ভয়ে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে হাত-পা গুটিয়ে থাকছেন। বাংলাদেশে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বেশ কিছু কর্মীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তাঁরা কেন করোনা কার্যক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন না। অজুহাত বা বাস্তবতা যাই হোক, তাঁদের উত্তর, ‘মামলা-হামলার ভয়’ এবং ‘সীমা-পরিসীমাহীন ঝুঁকি’ রয়েছে। কর্মীদের নামে অসংখ্য মামলা। তারপর নাশকতা বা করোনা-সহায়তার নামে অন্তর্ঘাতের অভিযোগ আনা হলে জানে পানি থাকবে না।

দুনিয়াময় করোনা নিয়ন্ত্রণে সফল দেশ, প্রদেশ বা রাজ্যগুলোর দিকে তাকালে আমরা কী দেখি? সরকার ও বিরোধী দলের কাদা ছোড়াছুড়ি নয়, কাঁধে কাঁধ মেলানো ঐক্যই অগ্রগতির মূল। জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় সবাই এককাট্টা, এক আত্মা, এক ধর্ম। ধর্মবিশ্বাসের পার্থক্যও কোনো বিভাজন তৈরি করতে পারে না। কারণ, সর্বজনীন সত্য হচ্ছে নগর পুড়লে দেবালয়ও রক্ষা পায় না।


বিশ্বজুড়ে করোনার দাপট থেকে আমরা একটি শিক্ষণীয় সরল অনুসিদ্ধান্ত তৈরি করতে পারি। বহুদলীয় গণতন্ত্র যেখানে সচল, অর্থাৎ সরকারি ও বিরোধী দল যেখানেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে, সেখানেই করোনা নিয়ন্ত্রণ সহজ হচ্ছে। আমাদের আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটেই সেই উদাহরণ কম নয়। ভিয়েতনাম সফল। প্রতিবেশী ভারতের কেরালা রাজ্যে ক্ষমতায় উদারবাদী সরকার। সেখানে কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা খুবই সুসংহত। করোনা নিয়ন্ত্রণে। অক্সিজেন দুষ্প্রাপ্য নয়। অন্যদিকে দিল্লি, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, বিহার, আসাম, ছত্তিশগড় প্রভৃতি প্রায় সব কটি বিজেপিশাসিত রাজ্য ও অঞ্চলে করোনা মারাত্মক প্রাণসংহারি রূপ নিয়েছে। জনজীবন বিপর্যস্ত। সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে বিজেপি।

গত বছর কানাডা ও ট্রাম্প শাসনাধীন যুক্তরাষ্ট্রের বেলায়ও বিশ্ববাসী দেখল করোনা ব্যবস্থাপনার আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কানাডা সফল, যুক্তরাষ্ট্র অসফল। ইউরোপে নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক প্রভৃতি উদার কল্যাণ রাষ্ট্র সফল, কিন্তু ব্রিটেনে রক্ষণশীল সরকার প্রায় ব্যর্থ। ব্রাজিল আর ফিলিপাইনের করোনা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য কট্টরপন্থী বলসোনারো ও দুতার্তেকেই দায়ী করা হচ্ছে। যেসব দেশ ব্যর্থ হয়েছে, সেসব দেশের সব কটিরই শাসকদল বিরোধী ও ভিন্নমতের প্রতি তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টির দায়ে অভিযুক্ত। ট্রাম্প যেমন হিস্পানিক, মুসলমান, কৃষ্ণাঙ্গ, উদ্বাস্তু ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের প্রতি ঘৃণা ছড়ান। মোদি মুসলিম ও তথাকথিত বহিরাগতদের উদ্দেশে ঘৃণা ছড়ান। এসব সংকীর্ণ রাজনীতিকে মুখ্য ক্ষমতা-কৌশল বানাতে গিয়ে তাঁরা দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা প্রস্তুতিতে পিছিয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশেও নানা উপায় ও পদ্ধতিতে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ জিইয়ে রাখা আছে। কিন্তু, করোনা যে দল-মত বিবেচনায় নিয়ে আঘাত হানবে না, এই বোধোদয় প্রয়োজন। বাংলাদেশে রোগবালাই, অতিমারি-মহামারিসহ সব ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় দলীয় ভেদবুদ্ধি পাশে সরিয়ে রেখে সর্বদলীয় ও সর্বজনীন প্রতিরোধ উদ্যোগের চর্চা শুরু হওয়া প্রয়োজন।

হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান ও সমাজ বিজ্ঞান; সদস্য সিপিএস, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়