Thank you for trying Sticky AMP!!

রাষ্ট্রের রোগ চিনবেন কীভাবে

কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ১০০ ডলার জরিমানা গুনেছেন, এথিক্স কমিশনে হাজির হয়েছেন, মৌখিক ও লিখিত তিরস্কার মাথা পেতে নিয়েছেন। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি দুই জোড়া সানগ্লাস উপহার নিয়েছিলেন, কিন্তু সংসদ সচিবালয়কে জানাতে গিয়ে তাঁর সহকারী ভুলবশত একই রকম দেখতে ভিন্ন আরেক ফরম পূরণ করায় সেটি ফেরত আ্সে। তারপর আবার শুদ্ধ করে পুনরায় পাঠাতে পাঠাতে নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যায়। তথ্য-প্রমাণসহ এতসব কারণ দর্শালেও শতভাগ মাফ পাননি। সংসদীয় কর্মবিবরণীতে তাঁর ভুলটি দেশের সব মানুষের জানার জন্য নথিবদ্ধ হয়েছে। এথিক্স কমিশন প্রেস রিলিজ দিয়ে ঘটনাটা সব পত্রিকাকে জানিয়েছে। পত্রিকাগুলো দেদার ছেপেছে। সাংবাদিকেরা ট্রুডোকে প্রশ্নবাণেও জর্জরিত করেছেন। দায়িত্বশীল ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের শক্তিই এমন যে প্রধানমন্ত্রীরও নিস্তার নেই।

সম্প্রতি ট্রুডোর ‘গ্রহণযোগ্যতা মান’(অ্যাপ্রুভ্যাল রেটিং)-এ ধস নেমেছে। কানাডার সবচেয়ে বড় স্বাধীন জরিপ প্রতিষ্ঠান অ্যাংগাস রিড ইনস্টিটিউট ডিসেম্বরে একটি জরিপ চালায়। তাতে দেখা যায় ট্রুডোর ‘গ্রহণযোগ্যতা মান’ ৩৫ শতাংশে নেমেছে। অথচ তাঁর সরকারের প্রথম বছর শেষে গ্রহণযোগ্যতা ছিল ৬৩ শতাংশ। উল্লেখ্য, ‘জনপ্রিয়তা’ এবং ‘গ্রহণযোগ্যতা মান’ এক নয়। তিনি এখনো জনপ্রিয়, কিন্তু গ্রহণযোগ্য নন। পরবর্তী নির্বাচনে জিতে আসবেন কি না, তা ‘জনপ্রিয়তা’ দিয়ে নয়, ‘গ্রহণযোগ্যতা’ দিয়ে নির্ধারিত হয়। ফলে তাঁর দল লিবারেল পার্টি শঙ্কিত। কানাডার মানুষ মিষ্টি ছেলে ট্রুডোকে এখনো ভালোবাসে বটে, কিন্তু কোনো আশকারা বা সুযোগ না দেওয়ার প্রশ্নে এককাট্টা।

‘গ্রহণযোগ্যতা’ পতনের কারণগুলো কৌতূহলোদ্দীপক। দুই বছর আগে ট্রুডো বৈধ সরকারি ছুটি কাটাতে পরিবারসহ গিয়েছিলেন বাহামার বেল আইল্যান্ডে। দ্বীপটির মালিক বিখ্যাত ধনকুবের প্রিন্স আগা খান। আগা খান ট্রুডোর বাবা পিয়েরে ট্রুডোর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, ট্রুডোদের পারিবারিক বন্ধু। তাই জাস্টিন আগা খানের কটেজে উঠেছিলেন; ব্যক্তিগত সৌজন্য-আতিথ্য নিয়েছিলেন। আগা খান তাঁকে একটি জ্যাকেটও উপহার দেন। তাঁর দপ্তর জ্যাকেট উপহার গ্রহণসহ সব তথ্য-প্রতিবেদন নির্দিষ্ট বিভাগে জমা দেয়। কিন্তু জাস্টিন তুলোধুনো হলেন এই অভিযোগে যে, আগা খান পারিবারিক বন্ধু হোন কিংবা ট্রুডো পারিবারিক ছুটিতেই থাকুন—তাঁর আতিথ্য নেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। নিয়ম বা আইন ভাঙা হয়নি বটে, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নীতি-নৈতিকতার চর্চায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। সেবারও এথিকস কমিশন এবং কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট (স্বার্থ-সংঘাত বিশ্লেষণী) কমিশনের উপর্যুপরি শুনানিতে হাজির হয়ে, কমিশনারদের ভর্ৎসনা শুনে; নিজের ভুল স্বীকার করে এবং এমনটি আর হবে না ধরনের মুচলেকা দিয়ে তবেই তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন।

ট্রুডো সম্প্রতি আরেকটি বড়সড় ঝামেলায় পড়েছেন। গত বছর ভারতে গিয়ে ঝলমলে পোশাক-আশাক পরে ছবি–ছাবা তুলে দেশের অর্থের অপচয় করেছেন কেন—জনগণ উত্তর চায়। ট্রুডোর বক্তব্য: যা যা করেছেন মেজবান দেশটির সংস্কৃতির প্রতি সম্মান ও গভীর অনুরাগ দেখাতে করেছেন। তবুও নিস্তার নেই। সব মহলে সিদ্ধান্ত একটিই—রাষ্ট্রপ্রধান এমন কিছু করতে পারেন না, যা রাষ্ট্রের নাগরিকদের কোনো না কোনোভাবে বিব্রত করতে পারে। কানাডীয়রা বলছেন, অন্যায় বা অনিয়ম কিছুই হয়নি বটে, তবে রাষ্ট্রের মর্যাদা খেলো হয়েছে। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো আরেকটি বেফাঁস কথা বললেন যে তাঁর পূর্বসূরি প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পার ভারতে গিয়ে তাঁর চেয়েও বেশি খরচ করেছিলেন। আগের খারাপ কোনো উদাহরণ দিয়ে নিজের অনুচিত কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টাটি কানাডীয়রা একেবারেই পছন্দ করেনি।

দুই
সামাজিক বিজ্ঞানে ‘সোশ্যাল এপিডেমিওলজি’ (সামাজিক রোগতত্ত্ববিদ্যা) এবং ‘পলিটিক্যাল এপিডেমিওলজি’ (রাজনৈতিক রোগতত্ত্ববিদ্যা) শাখা দুটি দ্রুত প্রসার পাচ্ছে। দুই শাখাতেই সুস্থ মানুষের দেশের তালিকার শীর্ষে থাকে কানাডা, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস ও আইসল্যান্ডের নাম। ট্রাম্প–যুগের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত তালিকার নিচে নেমে যাচ্ছে প্রতিবছরই।

‘সামাজিক রোগতত্ত্ববিদ্যা’ এবং ‘রাজনৈতিক রোগতত্ত্ববিদ্যা’র নানা গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য—যেসব দেশে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সৎ, স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল, দুর্নীতিমুক্ত, জবাবদিহিমূলক এবং সুশাসনযুক্ত—সেই সব দেশে নাগরিকের আয়ু বেশি, শারীরিক–মানসিক সুস্থতা অতুলনীয়, রোগ-বালাই কম, রোগপ্রতিরোধশক্তি বেশি ইত্যাদি। এই তালিকা দীর্ঘ। শারীরিক সুস্থতার কারণ মানসিক সুস্থতা। মানসিক সুস্থতার কারণ নাগরিকের সুনিদ্রা ও কম টেনশন। সুনিদ্রা ও টেনশনমুক্তির কারণ রাষ্ট্রের মূল চারটি প্রতিষ্ঠান—আইন, শাসন, বিচার ও নিরাপত্তার সততা, স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা, দুর্নীতিমুক্ততা, জবাবদিহিমূলকতা এবং সুশাসন। ন্যায্যতা নিশ্চিত, সুবিচার ও সুশাসন নিশ্চিত—তাই নাগরিক সুনিদ্রা দেয়, টেনশনমুক্ত থাকে। মানবিক, পরোপকারী ও সংবেদনশীল হয়। দেশগুলোর জনগণ সুখী, বসবাসযোগ্য ও শান্তিবাদী থাকে। কারণ তারা জানে ‘আমরা সবাই রাজা’ বা ‘আমরাই ক্ষমতাধর’। তাদের আত্মবিশ্বাস, সাহস, মনোবল, মতপ্রকাশের ও সত্য কথা বলার সৎসাহস তৈরি হয়। অগণতান্ত্রিক দেশের হিসাব সম্পূর্ণ বিপরীত। জনগণ তো বটেই, দেশগুলোই একধরনের ভয়াবহ শারীরিক-মানসিক অসুস্থতার আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে।

কানাডা প্রসঙ্গ টানলে অনেকেই বলেন, বাংলাদেশ কানাডা নয়; কোথায় আগরতলা কোথায় জারুলতলা ইত্যাদি। এই আত্মপ্রতারণামূলক আত্মপ্রবোধ অর্থহীন। উদাহরণ কানাডার হলেও মূল প্রসঙ্গ মোটেই কানাডা নয়; বরং প্রতিষ্ঠান ও প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ যে সংসদীয় গণতন্ত্রের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত, সেই বৈশ্বিক সত্যের ইঙ্গিত দেওয়া। ধনী কিংবা দরিদ্র, উন্নত বা অনুন্নত যেকোনো দেশই হোক না কেন—সৎ, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রচরিত্র সবখানে একই। মানবদেহের মতো। সাদা-কালো, লম্বা-বেঁটে হলেও সব মানুষের রক্তের রং, রক্তসঞ্চালন, হৃৎপিণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র যেমন একই রকম, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বা রাষ্ট্রের মূল অঙ্গগুলোর কাজও সব দেশে একই রকম।

সামাজিক ও রাজনৈতিক রোগতত্ত্ববিদ্যার আলোকে বাংলাদেশও একটি অসুস্থ রাষ্ট্র। আদুল আদুল চর্বিযুক্ত শরীর—যাকে ‘উন্নয়ন’ বলা হচ্ছে, তার নিচে অসংখ্য দগদগে ঘা, আর কিলবিল করা রোগজীবাণু। রুগ্‌ণ; রোগপ্রতিরোধ-ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে যখন পুরোপুরি রোগগ্রস্ত করে তোলা হয়েছে, তখন আরও রোগ বাঁধানোর পক্ষে যেকোনো যুক্তিই কুযুক্তি। রোগ নিরাময়ের যুক্তিই সুযুক্তি। সমাজচিন্তকদের দায়িত্ব হোক রোগের পক্ষে জিকির-কীর্তন বন্ধ করা এবং একটি একটি করে রোগ ধরিয়ে দিয়ে সারানোর ও চিকিৎসার সুপরামর্শ দেওয়া। এ সত্যটি বলা যে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে সুস্থ-সবল রেখে তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে দেওয়ার নামই গণতন্ত্র।

লেখক: নৃবিজ্ঞানী, কানাডার মানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো।