Thank you for trying Sticky AMP!!

রূপনগরের শোকগাথা

প্রথম আলো ফাইল ছবি।

বেলুন সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ এ বছর শুরু (২৫ জানুয়ারি ২০১৯) হয়েছিল ঢাকার মিরপুর থেকে। মিরপুর এলাকায় এ বছরের দ্বিতীয় বিস্ফোরণে গত বুধবার (৩০ অক্টোবর) বিকেলে রূপনগরে সাতটি শিশু নিহত হয়েছে।

জানুয়ারি মাসে (২৫ জানুয়ারি ২০১৯) মিরপুর ১-এ ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে বেলুনে গ্যাস ভরার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে একজন নিহত হন। শিক্ষার্থীসহ সে সময় আহত হয়েছিলেন আরও কয়েকজন। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার জন্য স্কুলের মাঠে তৈরি অস্থায়ী মঞ্চের পাশে বসেই বেলুন ফোলাচ্ছিলেন এলাকার বেলুন বিক্রেতা সিদ্দিক (৬০); সকাল আটটার দিকে ওই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এ ঘটনায় তিনি মারা যান। ছয়-সাত বছর ধরে তিনি মিরপুর ১ নম্বর এলাকায় বেলুন বিক্রি করতেন। একজন সামান্য বেলুন বিক্রেতার মৃত্যু তেমন বুদ্‌বুদ তুলতে পারেনি। বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত হলে, ভবিষ্যতে একই ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর ব্যবস্থা নিলে, হয়তো ৩০ অক্টোবরের নিষ্ঠুর ঘটনা আমাদের দেখতে হতো না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস বেলুন সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা আগেও ঘটেছে (দেখুন প্রথম আলো ২৬ ডিসেম্বর ২০১৫) রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্যানার ওড়ানোর জন্য দুজন বেলুন ব্যবসায়ীকে বেলুন ফোলানোর কাজে লাগানো হয়েছিল। বেলুন ফোলানোর শেষ দিকে সকাল সোয়া আটটায় একটি সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হলে কলেজের দুজন কর্মচারীসহ দুই বেলুন ব্যবসায়ী গুরুতর আহত হন। এ ঘটনার পর সেদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়াই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শুরু হয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত বিপজ্জনক পদ্ধতিতে বেলুন ফোলানোর পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়নি।

২১ মার্চ ২০১৯ বৃহস্পতিবার বিকেলে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলায় একই ধরনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মাইদুল ইসলাম (৩৮) নামের এক বেলুন বিক্রেতার মৃত্যু হয়। গোড়ল ইউনিয়নের বলারহাট কালীমন্দিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অষ্টপ্রহর মেলার এই দুর্ঘটনায় অনেকের মৃত্যু ঘটতে পারত। মেলা জমে ওঠার আগেই দুর্ঘটনা ঘটায় প্রাণহানি কম হয়েছে।

এর আগে (১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮) মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরে শিবচতুর্দশী মেলায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু হয়। আহত হয়েছিলেন চারজন। খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলার মমতা রানী বণিক (৩৫) ও তাঁর স্বামী গণেশ বণিক (৪০) প্রতিবছরই আদিনাথ মেলায় বেলুন বিক্রি করতে আসতেন। ভক্ত, পূজারি, নিয়মিত পর্যটক—সবার কাছেই বেশ জনপ্রিয় ছিলেন এই বেলুন দম্পতি। ঘটনার বছর দুয়েক আগে এই প্রতিবেদনের লেখকের এক প্রশ্নের জবাব গণেশ বণিক জানিয়েছিলেন, বেলুন বিক্রির মতো আনন্দের পেশা আর কিছু নেই। শিশু তার হাতের খাবার ফেলে দিতে রাজি কিন্তু বেলুন নয়। প্রতিটি শিশুই বেলুন হাতে পেয়ে যে হাসিটা দেয়, তাতেই আমার ভগবান দর্শন ঘটে। সিলিন্ডার বিস্ফোরণ আর বেলুনের ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে আলাপ আর বেশি দূর এগোয়নি। দুর্ঘটনার পর আদিনাথ মেলা পর্যবেক্ষণ কমিটির সভাপতি ও মহেশখালীর তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম সে সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। মেলায় বসা বিভিন্ন দোকানের সিলিন্ডারগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, এসবই মিডিয়া সামলানো মার্কা প্যাঁচাল ‘বাত কি বাত’।

মেলায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ক্রমেই যেন মেলার অংশ হয়ে উঠছে। আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা এলাকার সিরাজকে সবাই বেলুন সিরাজ বলেই চিনত। বড় বড় মেলায় দুই ছেলে সুমন (২৪) আর হৃদয়কে (১৮) সঙ্গে নিয়ে নিতেন। মাদারীপুর জেলার কালকিনির ভুরঘাটার কুণ্ডুবাড়ির মেলায় দুই ছেলে সুমন ও হৃদয়কে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন (সময় সংবাদ ১৫-১১-২০১৫)। সেখানে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় সিরাজ সরদার ও তাঁর দুই ছেলে সুমন, হৃদয়সহ পাঁচজন গুরুতর আহত হন। সিরাজ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পশ্চিম গোমদী ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত বিজয় মেলার মধ্যে বেলুন ফোলানোর জন্য আনা একটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে এক ব্যক্তি মারা যান, তিন শিশুসহ আহত হন আরও চারজন (বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৬ ডিসেম্বর ২০১৫)।

একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে খুলনার নিরালা প্রত্যাশা আবাসিক এলাকায়। ঢাকার আশুলিয়ার তৈয়বপুরের বর্ণচ্ছটা পিকনিক স্পটে। পাবনার ঈশ্বরদীতে উন্নয়ন মেলা উদ্বোধনের প্রাক্কালে (৪ অক্টোবর ২০১৮)। রাজবাড়ী জেলার পাংশার বাহাদুরপুরে গাশ্মীর মেলায়।

বছরের পর বছর এ রকম টুকরা খবর আমরা দেখি, কখনো বিচলিত হই, কখনো সেসব খবর হারিয়ে যায় আর সব মর্মান্তিক খবরের ভিড়ে। বেলুনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ আর বন্ধ হয় না। বেশির ভাগ সময় মারা যান গরিব অসহায় বেলুনওয়ালা।

কেন ঘটে এমন বিস্ফোরণ

অল্প পুঁজিতে একটা স্বাধীন কাজের খোঁজে থাকা বেকার মানুষকে এই কাজটা টানে খুব। কখনো মৌসুমি, কখনো সারা বছরের রুটিরুজির পথ
হিসেবে বেছে নেন বেলুনে গ্যাস ভরার কাজ। এঁরা আবার অনেক বেকার পথশিশুর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করেন।

পরিত্যক্ত বা বহু ব্যবহৃত একটা সিলিন্ডার সস্তা দরে কিনে ঝালাইটালাই করে তাতেই ‘মেডিসিন’ (রাসায়নিক) দিয়ে গ্যাস তৈরি করে বেলুনে ভরে দেন গ্যাসওয়ালা। এ গ্যাস তাঁরা নিজেরাই বানান। হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের সঙ্গে জিংক মেশালেই তৈরি হয়ে যায় হাইড্রোজেন গ্যাস। অ্যাসিডের সহজলভ্যতার ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিক্রেতারা সাধারণত গাড়ির ব্যাটারি থেকে এসব অ্যাসিড সংগ্রহ করে থাকেন। সস্তা আর সহজে পাওয়া যায় এমন বিকল্প রাসায়নিক দিয়েও বেলুন ওড়ানোর গ্যাস তৈরি করছেন গ্যাস বেলুনওয়ালারা। বাসায় বা মেলায় বসে অ্যালুমিনিয়াম, পানি এবং কস্টিক সোডার সমন্বয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করেন তাঁরা। এতে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। সিলিন্ডারকে ঠান্ডা হওয়ার যথেষ্ট সময় না দিয়ে ক্রমাগত অ্যাসিড আর জিংক কিংবা তার বিকল্প অ্যালুমিনিয়াম, পানি ও কস্টিক সোডা দিয়ে গ্যাস তৈরি করতে গেলেই বিভ্রাট ঘটে। মিরপুরেও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনাও সে রকম ইঙ্গিত দেয়। অনেকেই বেলুনওয়ালাকে সিলিন্ডারের মধ্যে সাদা বস্তু আর পানি ঢোকাতে দেখেছেন।

শুধু কি সিলিন্ডারেই ঝুঁকি

সিলিন্ডার না ফাটলেও হাইড্রোজেন গ্যাসে ভরা এক একটি বেলুন কিন্তু জীবন্ত বোমা (দেখুন প্রথম আলো ৩১ জানুয়ারি ২০১৮, ফানুস বন্ধ, বেলুনের কী হবে?) হাইড্রোজেন গ্যাস বিপজ্জনক, তাই গ্যাস বেলুন নিজের নিরাপত্তা বিবেচনা করে ব্যবহার করা উচিত বলে মনে করেন রসায়নবিদ এবং বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এসব বেলুন ফেটে গেলে কাছের সামান্য সিগারেটের আগুনেই ঝলসে যাওয়ার যথেষ্ট ঝুঁকি থাকে। গত বছরের (২০১৮) ৬ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে হাইড্রোজেন গ্যাসে ভরা বেলুন বাসে করে নিয়ে যাওয়ার সময় ঢাকার ফার্মগেটের কাছে বিস্ফোরিত হলে কমপক্ষে ১০ জন ছাত্র ও নেতার শরীর ঝলসে যায়। সে সময় বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন আহত ব্যক্তিদের শরীরের ৩ থেকে ৬ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছিলেন।

সারা পৃথিবীতেই এখন বেলুনে হাইড্রোজেনের বদলে হিলিয়াম ব্যবহারে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু হাইড্রোজেনে বিস্ফোরক উপাদান থাকা সত্ত্বেও যেহেতু এটা হিলিয়ামের চেয়েও সস্তা এবং সহজে পাওয়া বা তৈরি করা যায়, তাই হাইড্রোজেনের প্রতি ঝোঁকটাও বেশি। হাইড্রোজেন গ্যাসে ভরা বেলুন হিলিয়ামের বেলুনের চেয়ে দ্রুত আকাশে ওড়ে কিন্তু এক ঘণ্টার বেশি টেকে না, অন্যদিকে হিলিয়ামের বেলুন থাকে চার-পাঁচ ঘণ্টা। তবে হাতছাড়া বেলুন এক ঘণ্টা থাকলেও যা, পাঁচ ঘণ্টা থাকলেও তা। তাই মানুষ সস্তা জিনিসই খোঁজে।

শিশুদের কাছে সস্তা আর নিরাপদ আনন্দের উপকরণ পৌঁছানো জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। সেই সঙ্গে অনিরাপদ সিলিন্ডার আর ঝুঁকিতে ভরা গ্যাস বেলুনভিত্তিক জীবিকা বন্ধের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। রাস্তাঘাটে সিলিন্ডার দিয়ে বেলুনে গ্যাস ভরা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ২০০০ সালের শুরুতে। কিন্তু পলিথিনের মতো আবার সেটা ফিরে এসেছে। নিরাপদ জনপ্রিয় আর সস্তা বিকল্প না দিলে শুধু আইন দিয়ে বেশি দূর যাওয়া কঠিন।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
nayeem5508@gmail.com