Thank you for trying Sticky AMP!!

রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের ক্ষয়ক্ষতি কত?

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির

সাধারণ্যে একটি দুর্ভাবনা আছে যে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান এবং সু চির বন্দিত্বের পর রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই বুঝি আর থাকল না। রোহিঙ্গাদের কপাল আরও বেশি পুড়ল। সঙ্গে বাংলাদেশেরও কপাল পুড়ল। রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরা সম্ভবত আর কখনোই হবে না। তবে উল্টোটি হওয়া, অর্থাৎ ভালো কিছু হওয়া কি একেবারেই অসম্ভব কিছু? না, ভালো কিছু হওয়া অসম্ভব নয়। তবে সে জন্য বাংলাদেশকে খুবই কৌশলী হতে হবে।

৬ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সেনাশাসক বাংলাদেশ সরকারকে পাঠানো এক চিঠিতে বলেছে, কেন সেনাশাসকেরা হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হলেন। তার পরই দেওয়া হলো আশ্বাস, তাঁরা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ও রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে আন্তরিক চেষ্টা করবেন। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও চিঠিটি পেয়ে বেশ খোশমেজাজি প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহলেও একটি ধারণা তৈরি হয়েছে যে বাংলাদেশ মিয়ানমারের জান্তা-শাসনে চিন্তিত তো নয়ই, বরং তাদের সঙ্গে দেনদরবার-আলোচনা এবং বৈধতাদানেও হয়তো বিশেষ অনাগ্রহী নয়।

বাংলাদেশ কি আসলেই মিয়ানমারের সেনাশাসকদের আশ্বাসকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে? উত্তর সম্ভবত ‘না’। তবে এ রকম ভাবনা অস্বাভাবিক নয় যে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের কর্মকৌশল নিয়ে হয়তো নতুন করে ভাবার একটি সুযোগ পেয়েছে। এমনটিও অসম্ভব নয় যে আন্তর্জাতিক মহলকে আরও সক্রিয় ও কার্যকর করতে পারার একটি বিরল সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের জন্য।


এত দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলের তেমন আন্তরিকতা দেখতে পায়নি। মানবিক সাহায্য দিয়ে এবং আহা-উহু করেই বিশ্ব রাজনীতির মোড়লেরা বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। এর পেছনে কারণ ছিল নগদ-নারায়ণের স্বার্থ। ২০১০ সালের আগে পর্যন্ত পশ্চিমারা অং সান সু চিকে গণতন্ত্রের কান্ডারি ধরে নিয়ে সামরিক শাসকদের চাপে রেখেছিল। সু চির এমন একটি পরিচিতি তৈরি করা হয়েছিল যেন বিশ্বে তিনিই মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রথম ও একমাত্র পোস্টার গার্ল। গণতন্ত্র-গণতন্ত্র ভাবটি তৈরি করা গেলে যে আন্তর্জাতিক লগ্নিকাররা মিয়ানমারের বাজারে হামলে পড়বে, জান্তা তা জানত।  

তাই সেনাশাসকেরা ২০০৮ সালে উদ্ভট জোড়াতালির একটি সংবিধান প্রণয়নের ব্যবস্থা করেন। সেনাদের জন্য সংরক্ষিত করা হয় ২৫ ভাগ সংসদীয় আসন। স্টেট কাউন্সিলর নামের একটি শিখণ্ডী রাষ্ট্রপ্রধান পদও তৈরি করা হয়। উদ্দেশ্য সু চিকে সেই পদে আসীন করা। এই নতুন মডেলের নির্বাচনপদ্ধতি ও সংকর গণতন্ত্র তৈরির সেনাকৌশলকে বিশ্ব অর্থনীতির মোড়লেরা ‘মন্দের ভালো’ সনদ দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক মহল উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলেছিল, এবার মিয়ানমারে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইবে। জোরেশোরে বিনিয়োগ করতে হবে দেশটিতে। নইলে গণতন্ত্র আসতে দেরি হয়ে যাবে। শুরু হলো ব্যাপক বিনিয়োগ। ধনী দেশগুলোর বহুজাতিক কোম্পানি মিয়ানমারের বাজারে ঢুকে পড়ল। সেনাদের তত্ত্বাবধানে জাতীয় অর্থনীতি তদারককারী সংস্থা প্রতিষ্ঠা পেল। সেনা মালিকানায় শত শত স্থানীয় শিল্প ও বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠল।

সু চি মুক্ত হয়ে স্টেট কাউন্সিলরের পদ নিলেই যে গণতন্ত্র আসবে না, আন্তর্জাতিক মহল কি তা বুঝত না? অবশ্যই বুঝত। সজ্ঞানেই তারা সু চির পুতুলচরিত্র রাষ্ট্রপ্রধান পদকে অনুমোদন দিয়েছিল। ২০১০-এর নির্বাচনে সেনানিয়ন্ত্রিত সংকর গণতন্ত্র এলে পশ্চিমারা খুশিতে গদ-গদ হয়ে গিয়েছিল। কারণ বাণিজ্য বেসাতির দরজা খুলে যাওয়া। সামরিক শাসকদের জন্যও ২০১০-২০২০ দশকটি শাপেবর হয়েছিল। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর অর্থনীতির বিবেচনায় পিছিয়ে পড়া অবস্থাটি দ্রুত কাটিয়ে ওঠা যেমন যাচ্ছিল, সু চিকে সামনে ঠেলে দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, ভারত, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগও সুনিশ্চিত করা যাচ্ছিল।


এসব বাস্তবতার আলোকেই বাংলাদেশের সদ্য সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শহিদুল হক সম্প্রতি কয়েকটি চাঁছাছোলা সত্য উচ্চারণ করলেন। ফেব্রুয়ারির ১৬ তারিখে কানাডায় রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষজ্ঞ প্যানেল পর্যালোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজক ছিল কনফ্লিক্ট অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউট কানাডা (ক্রিক) নামের একটি গবেষণা সংস্থা। আলোচনায় ছিলেন বেশ কয়েকজন কূটনীতি-বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার ও শরণার্থী সমস্যা বিশেষজ্ঞ। যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটেনের পার্লামেন্টের লেবার দলীয় সংসদ সদস্য এবং ছায়া পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনরত ক্যাথরিন ওয়েস্ট এবং যুক্তরাজ্যের রোহিঙ্গা বার্মিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান তুন খিনও।

সেই আসরটিতে বলা হলো যে আন্তর্জাতিক মহলের ভুল আশকারা-আহ্লাদের কারণেই মিয়ানমার রোহিঙ্গা গণহত্যার সাহস পেয়েছিল। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার সুরাহা করায় অংশ নেওয়া আন্তর্জাতিক সমাজেরই একটি অত্যাবশ্যক দায়। তারা এত দিন রোহিঙ্গা বিষয়ে গা ছাড়া ভাব নিয়ে চলছিল। কারণ, তারা চাইত মিয়ানমারে তাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ ঝঞ্ঝামুক্ত থাকুক। পররাষ্ট্রসচিব বললেন, সু চি আসলে অস্থি-মজ্জায় ও চিন্তা-চিন্তনে সেনাদেরই লোক। তাঁর পিতাই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা। যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা ছাড়া সু চি গণতন্ত্র বা মানবাধিকার কোনো বিষয়েই আগ্রহী ছিলেন না।

এবারের আকস্মিক সেনাশাসনে লগ্নিকারীদের স্বার্থ এবং লগ্নি দুটোই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই বিনিয়োগকারী দেশগুলো সেনাশাসকের পক্ষ নিতে পারছে না। তা ছাড়া ২০২০-র নির্বাচনে সু চির দল ব্যাপক ভোটে জয়ী হয়েছে; তরুণেরা চুপ থাকবেন না। ইন্টারনেটের সুবাদে নতুন প্রজন্ম স্বপ্ন দেখতে শিখে গেছে। তাঁদের সঙ্গে আগের প্রজন্ম যোগ দেবেই।

শহিদুল হকের ভাষ্যের আলোকে বলা যায়, মিয়ানমারের সেনারা দেশের অর্থনীতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ায় কোনোভাবেই চাইবেন না এই সাম্রাজ্য বেহাত হোক। সে জন্যই অভ্যুত্থানটি হলো। এখন ধনী দেশগুলোকে নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে হলে সেনানিয়ন্ত্রিত এই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের ওপরই আঘাতটি হানতে হবে। সব রকম অবরোধ আরোপ, অস্ত্র বিক্রি ও সমর প্রশিক্ষণ বন্ধ ঘোষণা করতে পারে আন্তর্জাতিক সমাজ। চীন, ভারত ও রাশিয়ার একচেটিয়া সমর্থন নিয়ে অর্থনীতি অনাক্রান্ত রাখা যাবে ভাবলেও অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞা অবশ্যই সেনাশাসককে বিপদে ফেলবে।

যেহেতু মিয়ানমারের সেনাশাসন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কূটনীতির সম্ভাবনাগুলো তৈরি করেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো একসময় মিয়ানমারকে ক্ষতিপূরণ দিতেও বাধ্য করতে পারে। ক্ষতিপূরণের জন্য না হলেও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের কোন কোন খাতে কতভাবে কীভাবে কীভাবে কত ক্ষতির কারণ হয়েছে, তার একটি চুলচেরা হিসাব রাখা প্রয়োজন।

কারণ, গণতন্ত্রপন্থী দেশগুলো নৈতিক দায়বদ্ধতার কারণে অনির্বাচিত স্বৈরশাসকের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে না। তদুপরি তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এবং আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে অভিযুক্ত। ফলে সেনাশাসকদের চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় তাঁরা অর্থনৈতিক কূটনীতিতেও পিছিয়ে পড়বেন। সেনাশাসকদের দুর্বল করার জন্য রোহিঙ্গা গণহত্যার অপরাধের বিষয়টিকেও প্রাধান্য দেওয়া হতে পারে। এভাবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক সমাজের কার্যকরভাবে এগিয়ে আসার একটি সুযোগও তৈরি হতে পারে।


শহিদুল হক রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাতিসংঘের অভিভাবকত্বে বহুজাতিকদের তত্ত্বাবধানে একটি ‘সেইফ জোন’ তৈরির মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করার প্রস্তাব রাখলেন। মাসখানেক আগেও বাংলাদেশের বর্তমান পররাষ্ট্রসচিব ‘নিরাপদ অঞ্চল’ ধারণাটিকে বাস্তবভিত্তিক নয় বলেছিলেন। শহিদুল হকের মন্তব্য থেকে অনুমান করা যায়, সেনাশাসন চালু হওয়ার পর ‘নিরাপদ অঞ্চল’ ধারণাটিকে বাংলাদেশ হয়তো আর উড়িয়ে দিতে চাইছে না।

আলোচনাটিতে কানাডায় বাংলাদেশের নবনিযুক্ত হাইকমিশনার ড. খলিলুর রহমান বলেন, মিয়ানমারকে জবাবদিহির আওতায় আনতেই হবে। এটি আন্তর্জাতিক সমাজেরই দায়। আর রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের কোন কোন খাতে কতভাবে কীভাবে কতটা ক্ষতির কারণ হয়েছে, তার একটি চুলচেরা হিসাব রাখা শুরু করতে হবে এবং সে জন্য নিরন্তর গবেষণাও চালিয়ে যেতে হবে। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, ‘রোহিঙ্গা আশ্রয়দানের ক্ষয়ক্ষতির হিসাব-নিকাশের এখনই সময়। বাংলাদেশ কোন কোন খাতে কী রকম ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে, সেই গবেষণাটি শুরু হওয়া দরকার।’

যেহেতু মিয়ানমারের সেনাশাসন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কূটনীতির সম্ভাবনাগুলো তৈরি করেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনো একসময় মিয়ানমারকে ক্ষতিপূরণ দিতেও বাধ্য করতে পারে। ক্ষতিপূরণের জন্য না হলেও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের কোন কোন খাতে কতভাবে কীভাবে কীভাবে কত ক্ষতির কারণ হয়েছে, তার একটি চুলচেরা হিসাব রাখা প্রয়োজন। আমাদের কাছে তথ্য থাকলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এবং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারালয়ে গণহত্যাকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া সম্ভব হবে।

হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।