Thank you for trying Sticky AMP!!

লেবাননের শান্তি নির্ভর করছে ইসরায়েলের ওপর?

বৈরুত বন্দরে বিস্ফোরণের পর লেবাননে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। ছবি: এএফপি

বৈরুত বন্দরের বিস্ফোরণের প্রতিক্রিয়া কি লেবাননের রাজনীতিতে কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে? গত অক্টোবর থেকেই বৈরুত ফুঁসছে। গত জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরি পদত্যাগে বাধ্য হন। কিন্তু এতেও সমাধান হয়নি। নতুন সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি দেশটির জনসাধারণ। সে কারণে বিস্ফোরণের পর প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াব সরকারের পতন ঘটে প্রবল প্রতিবাদের মুখে। এর আগে ৫০ নাগরিকের স্বাক্ষরিত চিঠিতে লেবাননকে আবারও ফ্রান্সের অধীনে নেওয়ার দাবি জানানো হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন চাইছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে লেবাননের বর্তমান রাজনৈতিক এস্টাব্লিশমেন্টের বিপরীতের কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব আন্দোলনকারীরা তৈরিও করতে পারছে না। সে কারণে সাদ হারিরির পদত্যাগও সংকটের সমাধান করতে পারেনি। হাসান দিয়াবের পদত্যাগও সমাধান করতে পারবে বলে মনে হয় না। 

অনেকেই মনে করেন, লেবাননের রাজনৈতিক সংকটের মূলে রয়েছে দেশটির ধর্মীয় বিভাজনে তৈরি করা রাজনৈতিক ব্যবস্থা। কিন্তু এই সংকটে আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাবও রয়েছে। লেবাননে কারা ক্ষমতায় থাকবে, রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে, এর সঙ্গে ইসরায়েলের নিরাপত্তা জড়িত। ইসরায়েলের নিরাপত্তায় কোনো ধরনের গড়বড় বা শঙ্কা তৈরি হলেই অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের মতো লেবাননেও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হবে। লেবাননের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে মুসলিম ও খ্রিষ্টানরা মিলেই। এদের মধ্যে উপবিভাজনও আছে। মুসলিমদের মধ্যে শিয়া হিজবুল্লাহ ও সুন্নি নেতৃত্বে মতভেদ আছে। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মধ্যে অর্থনৈতিক বিভাজন রয়েছে। নিয়মানুসারে প্রেসিডেন্ট খ্রিষ্টান, প্রধানমন্ত্রী সুন্নি ও পার্লামেন্টের স্পিকার শিয়া দলগুলো থেকে নির্বাচিত হয়। সরকারি পদ ও চাকরিও ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়। এভাবেই লেবাননের রাজনীতির ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছিল। ক্ষমতার ভাগাভাগিতে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হলেও সম্পদের ভাগাভাগিতে ভারসাম্য আসেনি কখনোই। এ কারণেই লেবাননের ৫০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে। বিভিন্ন সময় সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম ও অযোগ্যতার অভিযোগ নিয়ে নাগরিকেরা পথে নেমে আসে। এবার বিক্ষোভকারীরা বলছে, তোমরা সবাই চলে যাও। কিন্তু সবাই চলে গেলে আসবে কে? নতুন নেতৃত্বের¡আভাস আপাতত লেবাননের রাজনীতিতে নেই।

বলা হচ্ছে, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের কাছাকাছি চলে এসেছে। লেবাননের মোট জনসংখ্যা ৭০ লাখ। তাদের মাথায় এখন ১০ হাজার কোটি ডলারের ঋণের বোঝা। সরকার আছে বটে কিন্তু কোনো কিছুর ওপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই। দুর্নীতি ও অনাস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বৈরুত বিস্ফোরণের পর আসা বিদেশি সাহায্য সরকারকে না দিয়ে সরাসরি নাগরিকদের দেওয়ার কথাও অনেকে বলেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, লেবাননের সরকার কি ব্যর্থ, নাকি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের পঙ্গু করে রাখা হয়েছে? যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই লেবাননের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। এতে লেবাননের বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশি সহায়তাও সরকারকে দেওয়া হয় না। লেবাননের রাজনীতিতে হিজবুল্লাহর একচ্ছত্র প্রভাবের কারণে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং হিজবুল্লাহকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, সৌদি আরবসহ পশ্চিমারা চায় লেবাননের রাজনীতি থেকে হিজবুল্লাহকে হটাতে। হিজবুল্লাহ বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী বেসরকারি সামরিক বাহিনীর অধিকারী। হিজবুল্লাহকে ইরান, সিরিয়াসহ অনেক দেশ সহায়তা করে। তাদের ইসরায়েল সীমান্তে ইরানের ছায়াপ্রতিনিধি বা প্রক্সি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি।

এই অবস্থায় হিজবুল্লাহর সমর্থনপুষ্ট কোনো সরকার সফল হবে না, এইটা স্বাভাবিক। লেবাননের সরকার যে অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্ত, এটা সবাই স্বীকার করে। সদ্য পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াবও স্বীকার করেছেন, তাঁর সরকারে দুর্নীতি ও অনিয়ম ছিল। সাদ হারিরিও দুর্নীতিবাজদের সতর্ক করে বলেছিলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা লেবাননকে বিপাকে ফেলবে। কিন্তু দুর্নীতি আর দূর হয় না। নতুন সরকার যে দুর্নীতিমুক্ত হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তাও নেই। পরবর্তী নির্বাচনেও বর্তমান দলগুলোই জিতে আসতে পারে। তাহলে পরিস্থিতির খুব বেশি পরিবর্তন হবে না। তাহলে কি ভবিষ্যতে আবারও একই দাবিতে আন্দোলন হবে? লেবাননে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ এই প্রথম নয়। ২০০৫ সালেও বড় ধরনের বিক্ষোভ হয়েছিল। রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তনের দাবিতে পথে নেমেছিল সবাই। পরিবর্তন যে আসেনি তা বোঝাই যাচ্ছে।

পশ্চিমাদের প্রয়োজন লেবাননে হিজবুল্লাহ প্রভাবমুক্ত সরকার; যেমনটা হয়েছিল মিসরে। ইসরায়েলবিরোধী মুরসিকে সরানোর খুব প্রয়োজন ছিল। মিসরে বিপ্লবের এক বছর পরেই দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে কায়রোর তাহরির স্কয়ারে আবারও সমবেত হয় বিক্ষোভকারীরা। সেই বিক্ষোভ যে অধিকতর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেয়ে বরং মুরসিকে হটানোর উদ্দেশ্যেই হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে পরিষ্কার হয়েছে। জেনারেল সিসি মুরসির চেয়ে আরও কঠোর শাসন কায়েম করলেও তাহরির স্কয়ারের ওই সব অধিকারকর্মী বা বিক্ষোভকারীকে আর মাঠে দেখা যায়নি। বরং তাদের অনেকেই গুম হয়েছে। কেউ কেউ জেলে ধুঁকছে। লেবাননের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, তাদের সেনাবাহিনী এতটা শক্তিশালী নয় যে হিজবুল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করে মিসরের মতো একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার গঠনে পশ্চিমাদের সহায়তা করবে। তাই কিছুদিন পরপরই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসাধারণ সরব হয়। ফরাসি উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার পর খুব কমই লেবাননে জনগণের সরকার গঠিত হয়েছে। গৃহযুদ্ধ, ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত—সবকিছু মিলিয়ে লেবাননের সরকারগুলো কখনোই নিজেদের মতো করে দেশ শাসন করতে পারেননি। শুধু লেবাননই নয়, আরবের অধিকাংশ দেশ, বিশেষ করে ইসরায়েলের নিকটবর্তী সব দেশেই একই অবস্থা।

হিজবুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কহীন বা হিজবুল্লাহবিরোধী সরকার গঠিত হলেই লেবাননের দুর্নীতি নিয়ে উচ্চবাচ্য কমে আসবে। যেমন সৌদি আরব, জর্ডান বা আরব আমিরাতের দুর্নীতি ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমাদের খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। তাই সেখানে কোনো বিক্ষোভও হয় না। বৈরুত বন্দরের বিস্ফোরণের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক থাকতে পারে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু কোনো পক্ষই কৌশলগত কারণে কিছুই বলতে পারছে না। এটা সাধারণ বিস্ফোরণ ছিল না; পুরো বৈরুতকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। অনেক বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু কারা হামলা করল বা কী কারণে এত বড় বিস্ফোরণ হলো, তা নিয়ে কেউ ঝেড়ে কাশতে চাইছে না। কেউই আনুষ্ঠানিকভাবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করেনি। এই বিস্ফোরণের আন্তর্জাতিক তদন্ত নাকচ করেছেন হিজবুল্লাহ নেতা নাসরুল্লাহ। আর ইসরায়েলের রাজনীতিবিদেরা মনে করছেন, এই বিস্ফোরণ তাঁদের জন্য ঈশ্বরের উপহার।

বিস্ফোরণের পর সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। সরকারের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকেই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করা হয়। বিস্ফোরক দ্রব্য তো সেখানে ছয় বছর ধরেই ছিল। এত দিন এসব নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি। হিজবুল্লাহ সরকারকে সমর্থন দেওয়ার বিনিময়ে বন্দর দিয়ে বিস্ফোরক আমদানি করেছে। হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ নতুন না। ১৯৮৭ সালে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এক প্রতিবেদনে বলেছিল, লেবাননের বন্দরগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই এবং এসব বন্দর ব্যবহার করে হিজবুল্লাহ অস্ত্র আমদানি করে ফিলিস্তিনের যোদ্ধা ও সিরিয়ার শাসকদের দিয়েছে।

বিশ্লেষক, বিশেষজ্ঞরা বলছেন বটে লেবানিজদের নতুন দিনের রূপান্তর শুরু করতে হবে; কিন্তু এটা সহজ হবে না। হিজবুল্লাহকে বাইরে রেখে লেবাননের নতুন রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করা খুবই কঠিন। তাই রাজনৈতিক অস্থিরতা শিগগিরই শেষ হবে না। আন্দোলনকারীদের দাবির ন্যায্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।

আরবরা বারবারই ন্যায্য দাবিদাওয়া দিয়ে পথে নামে। কিন্তু কখনোই খেয়াল করে না তাদের ন্যায্য দাবির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে জেনারেল সিসিরা ক্ষমতায় চলে আসেন। লেবাননে যত দিন কোনো সিসি না আসবেন, তত দিন থেমে থেমে বিক্ষোভ চলতেই থাকবে অথবা পুরোটাই হিজবুল্লাহর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।

ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক