Thank you for trying Sticky AMP!!

শতভাগ ভোটের সাতকাহন

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ছয় মাস পর নির্বাচন কমিশন কেন্দ্রভিত্তিক যে ফলাফল প্রকাশ করেছে, তাতে ভোট পড়ার অস্বাভাবিক চিত্র উঠে এসেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, ১০৩টি আসনের ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বলছে, এটা কোনোক্রমেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদাও বলেছেন, শতভাগ ভোট পড়াটা অস্বাভাবিক।

এ নিয়ে এখন নানামুখী আলোচনা চলছে। বি​ভি​ন্ন বিষয়ের পাশাপাশি নির্বাচন নিয়েও কাজ করে বেসরকারি সংস্থা সুজন। তারা নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত এই কেন্দ্রভিত্তিক ভোটের ফলাফলের আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করে তা প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, ১ হাজার ২০৫টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৯৬ থেকে ৯৯ শতাংশ। ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পড়েছে ৬ হাজার​ ৪৮৪টি কেন্দ্রে। আর ৮০ থেকে ৮৯ শতাংশ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে, এমন কেন্দ্রের সংখ্যা ১৫ হাজার ৭১৯টি।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত বেসরকারি সংস্থা ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। যেটা হয় না পৃথিবীতে কোথাও, সেটা চলতে পারে না।আমরা শুধু এটা দেখেছি মিলিটারি আমলে ডিক্টেটরদের সময়।’ তাঁর মতে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় কোথাও ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পড়লেই সেখানে কমিশনের আলাদা নজর দেওয়া উচিত। সেখানে শতভাগ ভোট কীভাবে পড়ল, সেটা নির্বাচন কমিশনের নিজেদেরই বের করতে হবে। (বিবিসি বাংলা অনলাইন, ৪ জুলাই ২০১৯)

তবে সিইসি নূরুল হুদা বলেছেন, এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কিছু করার নেই। গত ৩০ জুন ​তিনি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই। ভোটের পরই প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কেন্দ্রভিত্তিক সব নিষ্পত্তি করেন। একীভূত ফল রিটার্নিং কর্মকর্তা আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। তখন ওই বিষয়ে আমাদের কিছু জানায়নি; তাই এখন ইসির কিছু করার নেই।’ (ইত্তেফাক, ১ জুলাই ২০১৯)

নির্বাচনের ছয় মাস পর গত ২৯ জুন নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে কেন্দ্রভিত্তিক ফল প্রকাশ করা হয়। ফলাফল বিশ্লেষণ করে সেটা ৯ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করে সুজন গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরে। তাতে দেখা যায়, ৩০০ আসনে মোট ভোটকেন্দ্র ৪০ হাজার ১৫৫টি। এর অর্ধেকের বেশি, ২৩ হাজার ৬২১ কেন্দ্রে পড়েছে ৮০ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট। আর ৭০ শতাংশের ওপরে ভোট পড়ে ৩৩ হাজার ৬৯৪টি কেন্দ্রে। সুজনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী গড়ে ভোট প্রদানের হার ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ।

বিপরীত চিত্রও বিস্ময়কর

শতভাগ ​ভোটের বিপরীত চিত্রও আছে। ১১টি কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১০ শতাংশের কম। ২০টি কেন্দ্রে ১০ থেকে ১৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর ২০ থেকে​ ৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছে ৩০১টি ভোটকেন্দ্রে।

আবার কোথাও কোথাও ৫ শতাংশের কম ভোট পড়েছে। রংপুর-৩ আসনে সেনানিবাসের কাছে অবস্থিত দ্য মিলেনিয়াম স্টারস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর বগুড়া-৭ আসনের তিনটি কেন্দ্রে ৩ শতাংশের কম ভোট পড়েছে। এই কেন্দ্রগুলো হলো জাহাঙ্গীরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাইস্কুল, বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড হাইস্কুল (পুরুষ কেন্দ্র), বগুড়া ক্যান্টবোর্ড হাইস্কুল (মহিলা কেন্দ্র)।

২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া অবিশ্বাস্য

সুজনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, শতভাগ ভোট পড়া কেন্দ্রের মধ্যে এগিয়ে চট্টগ্রাম ও রংপুর বিভাগ। রংপুর-৫ আসনে সর্বোচ্চ ৯টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ৮টি, চট্টগ্রাম-৮ ও রংপুর-২ আসনে ৭টি করে, লালমনিরহাট-৩ ও রংপুর-৬ আসনে ৬টি করে, চট্টগ্রাম-৫, কক্সবাজার-৩, ময়মনসিংহ-২, ময়মনসিংহ-১০, দিনাজপুর-১, গাইবান্ধা-৪, নওগাঁ-৩ ও সিলেট-৪ আসনে চারটি করে ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে।

নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে, শতভাগ ভোট পড়া কিছুতেই স্বাভাবিক বা সম্ভব নয়। কারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ বা চূড়ান্ত করার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন হয় না। এর মধ্যে কেউ মারা যেতে পারেন। কেউ অসুস্থ, কেউ কারাগারে এবং বিদেশেও থাকতে পারেন কেউ কেউ।

কেন্দ্রভিত্তিক ফল প্রকাশিত হওয়ার পর এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘৩০ ডিসেম্বর কোনো নির্বাচনই হয়নি, যে কারণে আমরা ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছি।’ তিনি বলেন, নির্বাচনের ছয় মাস পর কমিশন ভোটের পরিসংখ্যান প্রকাশ করল। এত দিন পর তাদের এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে যে তারা ভোট ডাকাতির সঙ্গে জড়িত। নির্বাচনে তারা সক্রিয়ভাবে পক্ষপাতমূলক ছিল এবং এখনো আছে।

সুজনের বিশ্লেষণে বলা হয়, যে ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, এর মধ্যে ১৮১টি কে​ন্দ্র​ পড়েছে আওয়ামী লীগ থেকে বিজয়ী ৯০ জন সাংসদের আসনে। ২১টি কেন্দ্র জাতীয় পার্টি থেকে বিজয়ী ১০ জন সাংসদের আসনের। ৮টি বিএনপি থেকে বিজয়ী একজন সাংসদের, দুটি বিকল্পধারা বাংলাদেশের সাংসদের এবং একটি জাসদ থেকে বিজয়ী সাংসদের নির্বাচনী আসনে পড়েছে।

এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসন থেকে বিজয়ী হন বিএনপির প্রার্থী উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া। সেখানে ৮টি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। এসব কেন্দ্রে মোট ভোটার ২৩ হাজার ১৯৭। এসব কেন্দ্রে সর্বোচ্চ ভোট পান কলার ছড়ি প্রতীকের মঈন উদ্দিন। এই আটটি কেন্দ্রের পাঁচটিতে বিএনপির প্রার্থী ধানের শীষ প্রতীকে ‘শূন্য’ ভোট পান। বাকি তিনটিতে পান চার ভোট। কলার ছড়ি প্রতীকের মঈন উদ্দিন স্বেচ্ছাসেবক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। এ আসনে নৌকা প্রতীকের কেউ ছিল না। জোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ।

সুজনের বিশ্লেষণ অনুযায়ী যে ২১৩টি ভোটকেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে, তাতে ভোটপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে দেখা যায় যে নৌকা প্রতীকে ভোট পড়েছে বৈধ ভোটের ৭১ দশমিক ৮৩ শতাংশ। ধানের শীষে ১৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ, জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে ৭ দশমিক ১৯ শতাংশ, ইসলামী আন্দোলনের হাতপাখা প্রতীকে ১ দশমিক ১৭ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পেয়েছেন ২ দশমিক ৪৪ এবং অন্য দলগুলো ১ শতাংশের কম ভোট পেয়েছে।

সুজনের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়, ভোটের জন্য নির্ধারিত সময়ে শতভাগ ভোট পড়া সম্ভব কি না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ৯ জুলাই প্রথম আলোকে বলেছেন, শতভাগ ভোট পড়া বাংলাদেশে নতুন ঘটনা নয়। এর আগে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার আমলেও শতভাগ ভোট পড়েছে। অবশ্য নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম অদ্ভুত যুক্তি দিয়েছেন। বলেছেন, উল্লিখিত কেন্দ্রগুলোয় শতভাগ ভোট পড়েছে, এ কথা বলা যাবে না। কেননা, ওই সব কেন্দ্রে কিছু ভোট বাতিলও হয়েছে।

সুজনের বিশ্লেষণে বলা হয়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৮০ দশমিক ২০ শতাংশ ভোট পড়েছে, যা ১৯৯১ সালের পর অনুষ্ঠিত ছয়টি (’৯৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ছাড়া) নির্বাচনের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ৮৭ দশমিক ১৩ শতাংশ ভোট পড়েছিল এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বনিম্ন, অর্থাৎ ৪০ দশমিক ০৪  শতাংশ ভোট পড়েছিল।

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩৮টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অংশ নেন। শুরু থেকেই বিএনপি অভিযোগ করে আসছে যে আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। ভোটের আগে সারা দেশে অসংখ্য ‘গায়েবি মামলা’ দিয়ে তাদের নেতা-কর্মীদের এলাকাছাড়া করা হয়েছিল। ভোটের দিন বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিএনপি বা তাদের জোটের প্রার্থীর পক্ষে কোনো নির্বাচনী এজেন্ট দেখা যায়নি। বেশির ভাগ ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতিও ছিল অনুল্লেখযোগ্য। ভোটের দিন বিবিসি বাংলার এক খবরে বলা হয়, চট্টগ্রাম-১০ আসনের শহীদনগর সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে গিয়ে সকালে ভোট গ্রহণের আগে ব্যালট বাক্স ভরা দেখেছেন বিবিসির সংবাদদাতা। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের ৫০টি আসনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর এক পরিবীক্ষণের ফলাফলে ৪৭টিতেই অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, যা ১৫ জানুয়ারি টিআইবি প্রকাশ করে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বিবিসিকে বলেন, ‘নির্বাচন আচরণবিধির ব্যাপক লঙ্ঘনে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং একধরনের অভূতপূর্ব নির্বাচন হয়েছে, যার ফলে এই নির্বাচন অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য হিসেবে আলোচিত হচ্ছে।’ (বিবিসি বাংলা, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯)

সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের মতে, ২১৩ কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়া অবিশ্বাস্য।

টিপু সুলতান: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি