Thank you for trying Sticky AMP!!

শিক্ষকদের শিক্ষা অফিসে ঘোরাফেরা

পরম পরাক্রান্ত দুদকের চেয়ারম্যান আবার বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, তাঁরা যেন শিক্ষা অফিসে ঘোরাফেরা না করেন। অন্যথা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সংবাদমাধ্যমের এই খবর আগে কোথাও শুনেছি বলে মনে হওয়ায় রেকর্ড ঘেঁটে দেখি বছরখানেক আগে ফেব্রুয়ারি ২০১৮–এর ১৪ কি ১৫ তারিখে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে ‘দুর্নীতিমুক্ত সরকারি সেবা, দুর্নীতির অভিযোগের প্রকৃতি’ বিষয়ে দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক এক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে দুদকের চেয়ারম্যান বলেছিলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক স্কুল চলাকালে উপজেলা অফিসে এলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আলোচনা সভার পর দুদকের চেয়ারম্যান উপজেলার চরবড়ালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সাহেবগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয় ও হাঁসা বালিকা উচ্চবিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী মতবিনিময় সভা করেন। সেখানকার শিক্ষকদের দুর্নীতিবিরোধী স্লোগানসংবলিত ছাতা এবং শিক্ষার্থীদের দুর্নীতিবিরোধী স্লোগানসংবলিত শিক্ষা উপকরণ দেন। উপহার দিতে দিতে তিনি আবার সবাইকে জানিয়ে দেন, শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি তিনি সহ্য করবেন না।

এ রকম হুঁশিয়ারির হদিস আরও মেলে সে বছরের এপ্রিল মাসে দুদক চেয়ারম্যানের যশোর সফরের সময়। এপ্রিল ১১, বুধবার যশোর সার্কিট হাউস মিলনায়তনে খুলনা বিভাগের শ্রেষ্ঠ জেলা ও উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্যদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে তিনি আবার বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি কোনোক্রমেই সহ্য করা হবে না। (তবে কি অন্য সব ক্ষেত্রে একটু–আধটু দুর্নীতি সহ্য করবেন)। শিক্ষকেরা এখন নিশ্চয় ভয় পেয়ে আর শিক্ষা অফিসের দিকে হাঁটছেন না। কিন্তু তাঁদের তো শিক্ষা অফিসে যেতেই হয়। তবে কি তাঁরা সেই অঞ্জন দত্তের গানের কিশোরের মতো বলবেন, ‘অন্য পাড়া দিয়ে যাচ্ছি তাই’।

চেয়ারম্যান অবশ্য তাঁর হুঁশিয়ারিতে একটা ফাঁক রেখেছিলেন। বলেছিলেন, ‘স্কুল চলাকালে উপজেলা অফিসে এলে তবেই ধরা হবে।’ স্কুলের সময় আর অফিসের সময়ের মধ্যে কোনো ফারাক না থাকলে সে দায় কে নেবে? তিনি কি সব সময় শিক্ষা অফিসে যান ‘খুশিতে, ঘুরতে, ভাল্লাগে’ তাই, না তাদের ‘ঠেলায়’ পড়ে আসতে হয়। শিক্ষক, প্রধান শিক্ষককে যখন-তখন ডেকে পাঠানোর রেওয়াজ চলে আসছে সরকারি তথা এমপিওভুক্তির (এমপিদের করতলভুক্ত বলেন অনেক দুষ্টলোক) প্রক্রিয়া চালুর সূচনালগ্ন থেকে? জেলা প্রশাসক চাইলেই তাঁকে যেকোনো রাষ্ট্রীয় কাজে লাগানোর জন্য মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিতে পারেন, তলব করতে পারেন। গ্রাম–ওয়ার্ড পর্যায়ে যাবতীয় সরকারি ফুট–ফরমাশ কারা খাটে?

যাক সে কথা। এই যে পাহাড়ের তিন জেলার ২২০ স্কুলের (রাঙামাটির ৮১, বান্দরবানের ৮০, খাগড়াছড়ির ৫৯) শিক্ষকেরা দুই বছর ধরে বেতন পাচ্ছেন না। তাঁদের গাঁটের পয়সা খরচ করে হামেশাই জেলার শিক্ষা অফিসে এ কাগজ–সে কাগজ নিয়ে ধরনা দিতে হচ্ছে, তার কী হবে? কোন দুর্নীতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে তাঁদের যাপন করতে হচ্ছে মানবেতর জীবন? শিক্ষকদের শিক্ষা অফিসে বা এমপি অথবা তাঁর প্রতিনিধির (?) দুয়ারে শিক্ষকদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ভোট দেওয়ার পরও ভোটারের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীদের বয়ানমতো, ‘খুশিতে, ঘুরতে, ভাল্লাগে’ বলে নয়, নিতান্তই পেটের দায়ে। তাঁদের ভোগান্তি সৃষ্টির ব্যবস্থার মধ্যেই দুর্নীতির ফন্দিফিকির সুপ্ত থাকে। সেটা দূর করাই হবে ‘বাপের কাম’।

গত সংসদে প্রাথমিক শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সারা দেশে ২০ হাজার স্কুলে কোনো প্রধান শিক্ষক নেই। চেষ্টা হয়েছিল ৩৪ নম্বর বিসিএস পরীক্ষায় উপযুক্ত বিবেচিত না হওয়া প্রার্থীদের মধ্য থেকে ৯০০–র মতো পদ পূরণ করা হবে। নিয়োগে দুর্নীতি আর দুর্নীতি পালনজনিত জটিলতায় সৃষ্ট নিয়োগজট এড়ানোর জন্য বিসিএসের তলানি দিয়ে কাজ সারার কৌশলটি হয়তো মন্দের ভালো। কিন্তু একটা মানসম্মত ও শ্রদ্ধা করার মতো শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে না। প্রাথমিক ধাপে অঙ্কে ফেল করা অনেক ছাত্রের পরে ভালো অঙ্কের শিক্ষক হওয়ার নজির আছে ভূরি ভূরি। কিন্তু অসফল বিসিএসরা প্রায় ভেঙে পড়া মানের প্রাথমিক শিক্ষাকে কীভাবে টেনে তুলবেন, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এটা তাঁরাই পারবেন, যাঁরা প্রাথমিক শিক্ষাকে ব্রত হিসেবে নিতে প্রস্তুত। জানেন শিশুশিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্ব। পাঠদানের আধুনিক কলাকৌশল আর আছে স্কুলকে আনন্দতীর্থ করে গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছা, শিক্ষার্থী আর তাদের অভিভাবকদের কাছে জবাবদিহির আগ্রহ। এসব বিষয়ে বিস্তর পড়াশোনা ছাড়া যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিলেই তা আপনা–আপনি সংক্রমিত হয় না।

প্রাথমিক আর মাধ্যমিক স্তরে উপযুক্ত শিক্ষকের সমস্যা, অপ্রতুলতা কোন দেশে ছিল না? এখনো অনেক দেশ এ সমস্যায় ভুগছে। ভারতে এ সমস্যাই খাবি খাচ্ছে অনেক দিন ধরে। ২০১৭ সালে সে দেশের পার্লামেন্টে অনেক আলাপ–আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাঁরা শিক্ষক হতে চান, তাঁদের শিক্ষক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া হোক। উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পরপরই তাঁরা শিক্ষা প্রদানমূলক স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শুরু করতে পারেন। ঘোষণা মোতাবেক উচ্চমাধ্যমিকের পর চার বছরের বিএড কোর্স চালু হয়েছে ভারতে। আগে তিন বছরের স্নাতক পাঠ শেষ করে আরও দুই বছরের বিএড কোর্স করতে হতো; অর্থাৎ পাঁচ বছর লাগত শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার যোগ্যতা অর্জনের জন্য। এখন সময় এক বছর কম লাগবে। আর বন্ধ হবে রাতারাতি বিএড পাস করিয়ে দেওয়ার প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের রমরমা দুর্নীতির নিবিড় ধ্বংসাত্মক ব্যবসা। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টা ভেবে দেখতে পারেন।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক