Thank you for trying Sticky AMP!!

শিক্ষক যখন শিক্ষার্থী নির্যাতনের পক্ষে অবস্থান নেন

নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে প্রস্তাব করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। নির্যাতনের শিকার তাঁরই হলের একজন ছাত্র, নির্যাতনকারী যথারীতি ছাত্রলীগের নেতা বা কর্মী। বঙ্গবন্ধু হলে নির্যাতনের শিকার ছেলেটি এ জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে বক্তব্য দিতে গিয়েছিলেন। সে রাতে কমিটিরই একজন শিক্ষক তাঁকে নির্যাতকদের সঙ্গে আপসের প্রস্তাব দেন। কারণ, তিনি নাকি চান না অভিযোগকারীর কোনো ক্ষতি হোক!

মনে হতে পারে, এই শিক্ষক খুব শিক্ষার্থীবান্ধব বা বাস্তববাদী। তিনি জানেন, ছাত্র নয়, নির্যাতনকারীর সবচেয়ে বড় পরিচয়, সে ছাত্রলীগের সদস্য। তিনি হয়তো ভেবেছেন, নির্যাতনকারীকে শাস্তি দেওয়ার চেয়ে তার পক্ষ নিয়ে আপসের প্রস্তাব দেওয়াই সবার জন্য ‘মঙ্গলজনক’। নির্যাতনকে এভাবে অনুমোদন করার কারণে প্রকৃত বিচারে তিনি আসলে একজন নির্যাতনবান্ধব শিক্ষক।

তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে আমরা শিক্ষকসমাজের প্রায় সবাই আসলে তা–ই। আমরা নির্যাতনবান্ধব, নির্যাতনের প্রশ্রয়দানকারী, এমনকি কখনো এর পরোক্ষ সহযোগী। দিনের পর দিন দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে একের পর এক টর্চার সেলের অস্তিত্ব এবং বহু নির্যাতনের ঘটনা আমরা জেনেছি। আমরা প্রায় সবাই বিনা প্রতিবাদে তা মেনে নিয়েছি।

আমাদের মধ্যে বেশি নির্যাতনবান্ধব হচ্ছেন বিভিন্ন আবাসিক হলে ছাত্রদের দেখভালের দায়িত্বে নিযুক্ত শিক্ষকেরা। তাঁরা এ কাজের জন্য সম্মানী, নামমাত্র ভাড়ায় বাসা ও চাকরিতে প্রমোশনের সুবিধা পান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা এগুলো নির্দ্বিধায় ভোগ করেন নির্যাতনের ঘটনায় নির্বিকার থেকে এবং কখনো প্রশ্রয়দানকারী হয়ে। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে শিক্ষকদের এমন অমানবিকতা ও দায়িত্বহীনতার নজির আছে কি?

অংশত, আমাদের দায়িত্বহীনতার কারণে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনে মৃত্যু, অঙ্গহানি এবং অপরিসীম শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণার ঘটনা ঘটে চলেছে। বুয়েটে নির্যাতনে আবরারের মৃত্যুর পর সমাজ কিছুটা নড়েচড়ে বসেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাজার হাজার শিক্ষকের মধ্যে গুটিকয় শিক্ষক এসব প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন। এর প্রায় পুরোটাই ছিল লোকদেখানো বা বিবেকের সাময়িক দংশন। না হলে এরপরও অবাধে এসব ঘটনা ঘটতে পারে না দিনের পর দিন।

আমি আমাদের আইন বিভাগে দেখেছি, বিশেষ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা খারাপ রেজাল্ট করছেন, দিনে দিনে তা শুধু বাড়ছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, হলে তাঁদের পড়াশোনা করার সুযোগ নেই, কখনো মধ্যরাতেও রাজনৈতিক কর্মসূচির মহড়ায় অংশ নিতে হয় বলে সকালে ক্লাস করতে আসার উদ্যম পর্যন্ত পান না কেউ কেউ।

২.

গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো খুলে দেওয়ার পর গত পাঁচ মাসে এ ধরনের ১০টি ঘটনায় ১৬ জন ছাত্র নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা নির্যাতিত হয়েছেন ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ না নেওয়ার জন্য বা তাঁদের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যথেষ্ট সমীহমূলক ব্যবহার না করার জন্য। এর মধ্যে মাত্র তিনটি ঘটনায় সামান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। দুটো ঘটনায় হল থেকে বহিষ্কার করা হয় (এসব শাস্তি কখনো কার্যকর করা হয় না) এবং একটি ঘটনায় হলের রুম পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। ছাত্র অধিকার পরিষদের কর্মীদের নিয়ে গঠিত ‘স্টুডেন্ট অ্যাগেইনস্ট টর্চার’ নামের একটি সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে বিষয়টি তুলে ধরে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করে। এ বিষয়ে পরিষদের পক্ষ থেকে একটি অনুষ্ঠানে নির্যাতনের বিচার, নিয়মিত ডাকসু নির্বাচন ও গেস্টরুমে নির্যাতনবিরোধী আইন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এমন একটি আইন করার দাবি করেছেন ময়মনসিংহের কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও।

এর মধ্যে গেস্টরুমে নির্যাতন বন্ধে আলাদা আইনের দাবিটি করা হয়েছে সম্ভবত মরিয়া মনোভাব থেকে। আসলে এর প্রয়োজন নেই তেমন। যেকোনো ধরনের নির্যাতন ইতিমধ্যে দেশের সংবিধানে নিষিদ্ধ ও ফৌজদারি আইনে গুরুতর অপরাধ। এসব আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব পুলিশ, গোয়েন্দা আর বিচার বিভাগের। তবে এসবের বাইরেও নির্যাতন বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে হল প্রশাসনের বহু করণীয় আছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এসব প্রাথমিক দায়িত্ব তারা পালন করে না, এ জন্য তাদের কোনো জবাবদিহির মুখে পড়তে হয় না।

হল প্রশাসনের প্রাথমিক দায়িত্ব হচ্ছে হলে ঠিকমতো ছাত্রদের আসন বরাদ্দ দেওয়া ও প্রক্টরের সাহায্য নিয়ে অছাত্রদের বহিষ্কার করা। হলে ছাত্রদের আবাসিক সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো লিখিত মানদণ্ড না থাকলেও জ্যেষ্ঠতা ও মেধার ভিত্তিতে এটি করার রেওয়াজ ছিল বহু বছর ধরে। দলের প্রভোস্টের নেতৃত্বে আবাসিক শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত আসন বরাদ্দ কমিটির এ কাজটি করার কথা। বিজয় একাত্তর হলের দায়িত্বে থাকার সময় কয়েক বছর আগে অধ্যাপক শফিউল আলম ভূঁইয়া তা সঠিকভাবে করে দেখিয়েছেন। তাই অন্য সব হলে নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তঁার হলে এমন ঘটনা ঘটেনি তখন।

অন্য অধিকাংশ হলে প্রভোস্টরা এ দায়িত্ব পালন করেন নামমাত্র। হলের আসন বরাদ্দ করে আরও দুটো ছদ্ম হল প্রশাসন। একটি হলের ছাত্রলীগ সভাপতির, আরেকটি হলের ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদকের প্রশাসন। অলিখিত নিয়ম হচ্ছে, হলের কোনো রুমে বড়জোর দুজন ছাত্রকে বৈধভাবে আসন দেয় হল প্রশাসন, রুমপ্রতি বাকি ছয়জনকে হলে ওঠায় ছাত্রলীগ (বিএনপি আমলে ছাত্রদল)। আর হলের বারান্দা, ছাদ, মিলনায়তন বা লাইব্রেরির ‘গণরুমে’ কারা থাকবে, এটি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগ। বিনিময়ে এদের (ক্ষেত্রবিশেষে বৈধভাবে আসন পাওয়া ছাত্রদেরও) ছাত্রলীগের সব রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়, তাদের প্রতি আনুগত্যমূলক আচরণ করতে হয়, এমনকি নির্দেশ এলে কাউকে পেটানোর কাজে অংশ নিতে হয়। ঢাকা শহরে নতুন এসে বাধ্য হয়ে এভাবেই ‘গণরুমে’ থাকেন প্রধানত প্রথম বর্ষের ছাত্ররা। কোনো কারণে ব্যত্যয় ঘটলে শিকার হন অমানবিক অত্যাচারের।

৩.

আমি আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের প্রভোস্ট থাকার সময় উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের নেতৃত্বে প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির সভায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পেতাম। সেখানে প্রস্তাব করেছিলাম, হলে আসন বণ্টন করার ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতার রেওয়াজ বাদ দিয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হোক প্রথম বর্ষের ছাত্রদের। সিনিয়র ছাত্রদের মতো তাঁরা নতুন শহরকে চিনতে বা কোনোভাবে কিছু উপার্জন করতে শেখেন না, পরিচিত মহলও তাঁদের অনেক ছোট থাকে। একধরনের অসহায়ত্ব থেকে তাঁরা হলে যেনতেন প্রকারে আসন পেতে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। তাই তাঁদের অনিয়মতান্ত্রিকভাবে হলে উঠিয়ে হুমকি, নির্যাতন ও বাধ্যতামূলকভাবে সরকারি দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ানোর সুযোগ থাকে বেশি।

আমি আমাদের আইন বিভাগে দেখেছি, বিশেষ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা খারাপ রেজাল্ট করছেন, দিনে দিনে তা শুধু বাড়ছে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, হলে তাঁদের পড়াশোনা করার সুযোগ নেই, কখনো মধ্যরাতেও রাজনৈতিক কর্মসূচির মহড়ায় অংশ নিতে হয় বলে সকালে ক্লাস করতে আসার উদ্যম পর্যন্ত পান না কেউ কেউ।

প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বৈধভাবে হলে থাকার সুযোগ বাড়িয়ে এ অমানবিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নয়ন সম্ভব। পাশাপাশি হলের প্রতিটি রুমের আসনসংখ্যা বৈধভাবে দ্বিগুণ করে (যেখানে ইতিমধ্যে থাকছে অন্তত তিন গুণ) হলের বৈধ আসনসংখ্যা বাড়ানো যায়। মাস্টার্স বা স্নাতকোত্তর ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক সুবিধা বিলোপ করেও আসনসংখ্যা বাড়ানো সম্ভব।

বৈধভাবে নতুন ছাত্রদের হলে থাকার সুযোগ বাড়লে ক্ষমতাসীন দলের অবৈধ খবরদারি ও নির্যাতনের সুযোগ কমে যাবে। তবে এ জন্য একই সঙ্গে অবশ্যই হলের আবাসিক শিক্ষকদের, বিশেষ করে প্রভোস্টদের তাঁদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমি এটি নিশ্চিতভাবে জানি, প্রভোস্ট ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করলে আবাসিক শিক্ষকেরাও তা করেন।

এর আগে আমি একটি লেখায় নির্যাতন বন্ধে হলের ভেতর যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবও করেছিলাম। প্রস্তাব করেছিলাম হলে ছাত্রদের ডেটাবেইস তৈরির, ছাত্রনেতাদের সঙ্গে নিয়মিত উদ্বুদ্ধমূলক বৈঠকের ও হলে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে বাড়ানোর, অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন বা অ্যালামনাইদের সহায়তায় নতুন নতুন হল নির্মাণের।

৪.

আমার এসব প্রস্তাব অন্য শিক্ষকেরা জানেন না, তা নয়। কিন্তু এসব নিয়ে আমার জানামতে প্রশাসনিক পর্যায়ে কখনো কোনো আলোচনা হয়নি, কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আমরা সাধারণ শিক্ষকেরাও সংঘবদ্ধভাবে কিছু করতে পারিনি।

যত দিন পর্যন্ত আমরা তা না পারি, আমরাও নির্যাতনবান্ধব। কেউ কম, কেউ বেশি।

আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক