Thank you for trying Sticky AMP!!

শিল্প ও ব্যবসায় কেন পিছিয়ে রাজশাহী?

প্রথম আলো ফাইল ছবি।

রাজশাহী শিক্ষা নগরী হিসেবে পরিচিত। এখানে আছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয়, আছে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজসহ অনেকগুলো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শিক্ষা নেওয়ার পর মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য কর্মসংস্থান প্রয়োজন, রাজশাহীতে তার সুযোগ কম। এখানে উল্লেখ করার মতো শিল্পকারখানা নেই। রাজশাহীর শিল্পোদ্যোক্তারা ঢাকা বা অন্যান্য স্থানে গিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু রাজশাহীতে শিল্প গড়ে উঠছে না। ব্যবসা-বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটছে না।

শুক্রবার সকালে রাজশাহী চেম্বার ভবনে কথা হচ্ছিল রাজশাহী শিল্প ও বণিক সমিতির অন্যতম পরিচালক সাদরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জানালেন, একটি অঞ্চলে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করতে যে আর্থসামাজিক পরিবেশ দরকার, তার কিছুই এখানে নেই। যেমন রাজশাহীর যোগাযোগব্যবস্থা অপ্রতুল ও ভঙ্গুর। সড়কপথই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। ট্রেন চালু থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় কম। শুধু ব্রডগেজ লাইন আছে। বিমানে যাত্রী পরিবহন করা হলেও পণ্য পরিবহনের সুযোগ নেই। সড়কপথে ঢাকা যেতে সময় লাগে সাত–আট ঘণ্টা। রাজশাহীর নিকটবর্তী যে বন্দরটি আছে, সেই সোনা মসজিদ স্থলবন্দরের অবকাঠামো খুবই দুর্বল। এই অবস্থায় শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে কীভাবে?

রাজশাহীতে গিয়েছিলাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের হালচাল জানতে। বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলি। নির্বাচন নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ আছে ঠিকই; কিন্তু তার চেয়ে বেশি উদ্বেগ রাজশাহীর বেকারত্ব নিয়ে। শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের বেহাল অবস্থা নিয়ে। ওই ব্যবসায়ী নেতা আরও বললেন, রাজশাহীতে শিল্পকারখানা না হওয়ার বড় কারণ গ্যাসের সংকট।

শুধু রাজশাহী নয়, দেশের দক্ষিণ ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অংশেই গ্যাস নেই। বাংলাদেশ এখন দুই ভাগে বিভক্ত-গ্যাসসমৃদ্ধ অঞ্চল এবং গ্যাসশূন্য অঞ্চল। দেশের ৯০ ভাগ শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে এই গ্যাসসমৃদ্ধ অঞ্চলে। ফলে গ্যাসশূন্য অঞ্চলে বেকারত্ব ও দারিদ্র্য-দুটোই প্রকট। এই প্রসঙ্গে কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) একটি জরিপের কথা মনে পড়ল। এতে দেখা যায়, শিল্পসমৃদ্ধ নারায়ণগঞ্জে দারিদ্র্যের হার ৩ শতাংশের কম আর শিল্পশূন্য কুড়িগ্রামে ৭১ শতাংশ। শুধু রাজশাহী নয়, গোটা উত্তরাঞ্চলই শিল্পায়নে পিছিয়ে আছে। এই পিছিয়ে পড়া জনপদকে ঋদ্ধ জনপদে পরিণত করতে হলে শিল্পায়নের বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা আঞ্চলিক বৈষম্য রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানা নেই। তারা তেলা মাথায় তেল দিতেই পছন্দ করেন।

রাজশাহী রক্ষা আন্দোলনের সম্পাদক জামাত খানকে জিজ্ঞাসা করি, রাজশাহীতে গ্যাসের দাবিতে তো আপনারা দীর্ঘদিন আন্দোলন করলেন, ফল কী পেলেন? তিনি বললেন, আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৩ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। নয় হাজারের মতো বাসাবাড়িতে গ্যাস গেছে। এ ছাড়া ছয়–সাতটি কারখানায়ও গ্যাস-সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচনের পর আবার সেই উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়। তবে আরেকজন ব্যবসায়ী নেতা জানান, গ্যাস-সংযোগ পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে বলা যাবে না। সম্প্রতি একটি ফিশ ফুড কারখানা নতুন করে গ্যাস-সংযোগ পেয়েছে।

কিন্তু এসব প্রতীকী সংযোগ দিয়ে শিল্পায়ন সম্ভব নয়। পাইপের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাস-সংযোগ দেওয়ার সুযোগও কমে আসছে। বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে।

বর্তমানে রাজশাহীতে যদি কেউ রপ্তানিমুখী কোনো শিল্পকারখানা করেন, তার উৎপাদিত পণ্য সড়কপথে ঢাকায় যেতে লাগবে সাত থেকে ঘণ্টা, চট্টগ্রামে ১৪ থেকে ১৫ ঘণ্টা। কিন্তু কারখানাটি চট্টগ্রামে হলে এক ঘণ্টার কম সময়ে পণ্য বন্দরে পৌঁছাবে। সে ক্ষেত্রে উদ্যোক্তারা কেন রাজশাহীতে শিল্প গড়ে তুলবেন? তবে যমুনা সেতুতে পণ্যবাহী ট্রেনলাইন চালু হলে কম সময়ে পণ্য পরিবহন করা যাবে বলে আশা করা যায়। এ-সংক্রান্ত একটি প্রকল্পও পাস হয়েছে একনেকে।

ট্রেনের সময়সূচি নিয়েও রাজশাহীবাসীর ক্ষোভ রয়েছে। সড়ক পরিবহনমালিকেরা প্রভাব খাটিয়ে এমন সময়সূচি করেছেন, যাতে ট্রেনে কম যাত্রী যান এবং তারা বেশি লাভবান হয়। ট্রেনে ভ্রমণ সাশ্রয়ী ও নিরাপদ। আলাপ প্রসঙ্গে আরেক ব্যবসায়ী নেতা বললেন, রাজশাহীর ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন। কেননা গ্যাস না থাকায় এখানকার শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। কিন্তু সরকার তাদের কোনো কর সুবিধা দেয় না। সরকারের উচিত কর সুবিধা দেওয়া। একই দেশে বৈষম্য চলতে পারে না। একই সমস্যার মুখোমুখি উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় সব শিল্পোদ্যোক্তা।

গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজশাহীতে এসেছিলেন। তাঁর রাজশাহী আগমন উপলক্ষে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা একগাদা দাবিনামা পেশ করেছিলেন। সেসব দাবির কতটা পূরণ হয়েছে, জানতে চাইলে দৈনিক সোনালি সংবাদ-এর সম্পাদক ও রেশম শিল্প সমিতির সভাপতি লিয়াকত আলী বলেন, ‘আমরা অনেক দাবিই পেশ করেছিলাম। কিন্তু দু-একটা ছাড়া বেশির ভাগই অপূর্ণ রয়ে গেছে। রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও আইটি ভিলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু আমরা এখানে যে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করেছিলাম, সে বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।’

রাজশাহীতে ষাটের দশকে সরকারি উদ্যোগে এখানে একটি চিনিকল, একটি পাটকল, একটি টেক্সটাইল এবং একটি রেশম কারখানা স্থাপন করা হয়েছিল। ক্রমাগত লোকসানের কারণে চিনিকল বন্ধ হয়ে গেছে। টেক্সটাইল কারখানাটি আংশিক চালু আছে, তা-ও ইজারার মাধ্যমে। রাজশাহীর ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিত রেশম কারখানাটি কখনো চালু হয়, কখনো বন্ধ থাকে। নির্বাচন সামনে রেখে ২৭ জুলাই আবার কিছু লুম চালু করার পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সেটি কত দিন স্থায়ী হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন।

রাজশাহীর ব্যবসায়ীদের দাবি, রাজশাহী বিমানবন্দরটিকে আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়া হোক। তাহলে কলকাতা, বাগডোরা ও কাঠমান্ডুর সঙ্গে সরাসরি বিমান যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এই অঞ্চলের একমাত্র বন্দর সোনা মসজিদকে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দরে উন্নীত করা হোক। সেখানে কোনো গুদামঘর না থাকায় পণ্যের আমদানি-রপ্তানি মারাত্মকভাবে কমে গেছে। আগে এই বন্দর থেকে ৪৫টি পণ্য আমদানি-রপ্তানি হতো। এখন হয় মাত্র ৫টি। তাঁরা মোংলা বন্দর ও সোনা মসজিদের সঙ্গে সরাসরি ট্রেন চালুর কথাও বলেছেন। এ ছাড়া রুগ্ণ পদ্মায় ড্রেজিং করার মাধ্যমে পুরোনো নৌপথ চালুর প্রস্তাবও দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

রাজশাহীতে প্রচুর পরিমাণে কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয়। আমের উৎপাদন বেড়েছে কয়েক গুণ। অতএব, এখানে আমসহ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে উঠলে স্থানীয় কৃষকেরা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি এই অঞ্চলে কর্মসংস্থান বাড়বে। এসব পণ্য রপ্তানি করে দেশও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে। বর্তমানে রাজশাহী অঞ্চলের অনেক শ্রমিক বাইরে গিয়ে শিল্পকারখানায় কাজ করেন। এখানে নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠলে তাঁরা বাড়িতে থেকেই কাজ করতে পারবেন।
রাজশাহী বিসিক নগরীতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের অনেক শিল্প আছে। কিন্তু সেখানকার উদ্যোক্তারা চান, কৃষিভিত্তিক শিল্পকারখানার জন্য আলাদা একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হোক। সরকার সেটি করতে রাজিও আছে। কিন্তু সবার আগে জ্বালানি সমস্যার সমাধান করতে হবে। রাজশাহীতে বর্তমানে জাতীয় গ্রিড থেকে মাত্র ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়, যেখানে ঢাকার মিরপুর অঞ্চলের চাহিদাই ৩০০ মেগাওয়াট।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan 55 @gmail. com