Thank you for trying Sticky AMP!!

শিশুদের শাস্তির বিকল্প হচ্ছে ইতিবাচক শৃঙ্খলা

লাঠি, স্যান্ডেল, ডাল ঘুঁটনি—সব পাশাপাশি রাখা। কার কার মনে আছে শৈশবের এই স্মৃতি। এমন একটি মিম (meme) ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছিলাম কিছুদিন আগে। এরপর দেখলাম এক ভিডিওতে এক শিশু পড়তে বসে কাঁদছে আর অনুরোধ করছে, তাকে যেন একটু আদর করে পড়ানো হয়। সেটা সম্ভবত ভারতের ছিল, পরে ক্রিকেট তারকা বিরাট কোহলিসহ অনেকেই এর প্রতিবাদ করেন। শিশুটির পরিবার থেকে অবশ্য বলা হয়েছিল, তিন বছরের শিশুটি খুবই দুরন্ত। যদি তাকে এভাবে শাসন করা না হয়, সে কিছুতেই পড়তে বসে না। তাহলে কি তাকে কিছু বলাই যাবে না?

দুই ক্ষেত্রেই পোস্টগুলো শেয়ার হয়েছে মজার ব্যাপার হিসেবে। শৈশবে মারধর কিংবা বকা খাওয়ার ব্যাপারটি সবাই বেশ স্বাভাবিকভাবেই নেন। তাঁদের যুক্তি, আমি তো এমন কঠিন শাসনের মধ্য দিয়েই বড় হয়েছি। কই আমার তো কোনো ক্ষতি হয়নি। ছোটবেলায় এমন শাস্তি না পেলে কি আজ এ অবস্থানে পৌঁছাতে পারতাম?

এমন মানসিকতায় অবাক হওয়ার কিছু কি আছে? ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে খুব অমানবিক কিন্তু বাস্তব একটি চিত্রই আমরা দেখতে পেয়েছি। আত্মহত্যার ঘটনাটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে এখন। কিন্তু এমন ঘটনা আমাদের দেশে বা সারা বিশ্বের কোথাও নতুন নয়। এ বছরই বাংলাদেশে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর অন্তত ১৩টি শিশু আত্মহত্যা করেছে (ডেইলি স্টার, ১৯ মে)। অতীতেও এমনটি হয়ে এসেছে। প্রশ্ন হলো, এমনটি চলতেই থাকবে? আমরা শিশুদের সুরক্ষার জন্য কী ব্যবস্থা নিচ্ছি?

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বলছে, শিশুদের সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক সহিংসতা, আঘাত, অবহেলা, নির্যাতন থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। এই অধিকার নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ আইনি, প্রশাসনিক, সামাজিক, শিক্ষামূলক ও সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের (আর্টিকেল ১৯)।

বাংলাদেশসহ ১৯৬টি দেশ এ সনদে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে শিশু অধিকার বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। এ ছাড়া জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে সর্বজনীন পরিবীক্ষণ পদ্ধতির (ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ) আওতায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনা হয়েছে। সেখানেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার, কর্মক্ষেত্রসহ সব জায়গায় শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলে সরকার তাদের সদিচ্ছার কথা জানিয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ২০১৬ অনুযায়ী, আমরা চাই সমাজের সর্বস্তরে সহিংসতা বন্ধ করতে। সুতরাং শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করা হবে এ লক্ষ্য অর্জনের পথে একটি বড় ধাপ।

বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্র জারির মধ্য দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুর শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ করেছে। তবে স্কুলে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ হলেও মানসিক শাস্তি বা অপমান–অবহেলার কথা উপেক্ষিত রয়ে যাচ্ছে। পরিবারে ও কর্মক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রতিরোধের জন্য আইন প্রণয়নের কথাও বলা হচ্ছে না। এর ফলে দুই ধরনের সমস্যা রয়ে যাচ্ছে। আইন না থাকায় শাস্তি প্রতিরোধে সামাজিক আন্দোলন কার্যকর হচ্ছে না, অভিভাবক ও বড়দের বলা যাচ্ছে না এটি বন্ধ করতে।আবার সামাজিক প্রেক্ষাপট, পারিবারিক মূল্যবোধ বিবেচনায় আইন প্রণয়নের ব্যাপারটিও এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। যার ফলে ভুগতে হচ্ছে শিশুদের। 

সর্বক্ষেত্রে শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধের জন্য আইন প্রণয়ন করা যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা। এ জন্য যে বাধাগুলোর কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো যুক্তিসংগত নয়। শারীরিক ও মানসিক শাস্তির ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে। আইসিডিডিআরবির এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব পুরুষ শৈশবে শাস্তির শিকার হন, তাঁদের মধ্যে পরে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দেখা যায়। নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের লক্ষে শিশুর প্রতি শাস্তি বন্ধ করার সুপারিশ করা হয়েছে।

আইন প্রণয়ন ও সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা—উভয় ক্ষেত্রেই কাজ করার সময় আমাদের কিছু প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সেই সর্বজনীন প্রশ্ন: কই, আমার তো কিছু হয়নি। এর উত্তরটাই দেওয়া যাক। আপনার কিছু হয়নি বলেই অন্য কোনো শিশুর ক্ষতি হবে না, এই নিশ্চয়তা কি দেওয়া সম্ভব? সবার মানসিক গঠন তো এক রকম নয়। তা ছাড়া, আপনার শৈশব যদি শাস্তিমুক্ত, আনন্দময় হতো, তাহলে আজ হয়তো আপনি আরও সফল হতেন।

আরও একটি বড় চিন্তার জায়গা হলো, শাস্তির বিকল্প কী? শিশুকে একটু–আধটু শাসন তো করতেই হবে। নইলে সে ‘মানুষ’ হবে কীভাবে। শাস্তি না দিয়ে কি আমরা তার ভবিষ্যত্টাই ক্ষতির মুখে ফেলছি না? উত্তর হলো, না। শাস্তির বিকল্প হিসেবে আছে ইতিবাচক শৃঙ্খলা। ভয় দেখিয়ে, মারধর করে নয়। শিশুকে শেখাতে হবে ভালোবাসা ও স্নেহের মধ্য দিয়ে। এটি যে আমাদের দেশেই সম্ভব, তার প্রমাণ ইতিমধ্যে আমরা পেয়েছি। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটোবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে সেভ দ্য চিলড্রেন তৈরি করেছে ইতিবাচক শৃঙ্খলার একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। এই প্রশিক্ষণ পাওয়া অভিভাবকেরা প্রায় সবাই জানিয়েছেন, শিশু লালনপালনে ইতিবাচক মনোভাব তাঁদের সাহায্য করেছে বাড়িতে একটি সুন্দর, সুস্থ পরিবেশ গড়ে তুলতে। সন্তানদের সঙ্গে তাঁদের এখন ভয়ভীতি নয়, বরং ভালোবাসার সম্পর্ক।

শিশুর প্রতি শারীরিক শাস্তি রোধে বিশ্বব্যাপী কাজ করছে গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ টু অ্যান্ড অল করপোরাল পানিশমেন্ট। বহুল জিজ্ঞাসিত এ প্রশ্নগুলো নিয়ে তারা প্রকাশ করেছে একটি বুকলেট সিরিজ, যা তাদের ওয়েবসাইটে বাংলায় পাওয়া যাচ্ছে। শিশুর প্রতি সব রকমের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রোধ করার জন্য অনেক দিন ধরেই প্রচারণা চলছে সারা বিশ্বে। ১৯৭৯ সালে সুইডেন দিয়ে শুরু, ২০১৮ সালে নেপালের মধ্য দিয়ে বিশ্বে ৫৪টি দেশ পরিবারসহ সর্বক্ষেত্রে আইন করে শিশুর প্রতি শারীরিক ও মানসিক শাস্তি নিষিদ্ধ করেছে। এ তালিকায় বাংলাদেশের নামটাও যুক্ত হোক দ্রুতই।

রুহিনা তাসকিন: সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড প্রোটেকশন অ্যান্ড চাইল্ড রাইটস গভর্নেন্সের কমিউনিকেশন ম্যানেজার