শিশুশিক্ষার পরম্পরা রক্ষা পাবে কী করে?
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইগুলোয় ভুলত্রুটি ধরা পড়ার ঘটনা এ বছরই প্রথম ঘটল—ব্যাপারটা মোটেও এ রকম নয়। কিন্তু এবার শোরগোল হচ্ছে বেশি; এর আগে কখনো এতটা শোরগোল হয়নি।
শোরগোল, প্রতিবাদ, সমালোচনা ইত্যাদির প্রধান কারণ কিন্তু ভুলত্রুটির বাড়াবাড়ি নয়। ওটা গৌণ কারণ। মুখ্য কারণটা হলো পাঠ্যবইগুলো থেকে বেশ কিছু লেখা বাদ দেওয়া। সংবাদপত্রে খবর ছাপা হয়েছে, লেখাগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের দাবি অনুসারে। সংগঠনটির নেতারা নাকি সরকারকে লিখিতভাবে একটা তালিকা দিয়ে বলেছিল, ওই তালিকায় উল্লেখিত লেখকদের লেখা পাঠ্যবইগুলো থেকে বাদ দিতে হবে। তাদের সেই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১২টি লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে এবং ১৭টি লেখা সংযুক্ত করা হয়েছে। এই সংযোজন ও বিয়োজনের কাজটি করা হয়েছে পাঠ্যবইগুলোর সংশ্লিষ্ট সংকলক ও সম্পাদকদের কিছুই না জানিয়ে। ১৩ জন সংকলক-সম্পাদক সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি প্রকাশ করে দেশবাসীকে এ কথা জানিয়ে দিয়েছেন।
বিষয়টি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি-প্রসূত। হেফাজতে ইসলামের দাবি শুধু ধর্মসংক্রান্ত নয়, তাদের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিও তারা জাতির ওপর চাপাতে চেয়েছে এবং সরকার তাদের সেই ইচ্ছা পূরণ করেছে। অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিমনস্ক নাগরিক সমাজ হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে সরকারের এমন নতিস্বীকারে বেশ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগের মতো একটা রাজনৈতিক দল, যারা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার ধারকবাহক বলে দাবি করে, তাদের শাসনামলে একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক মহলের চাপে শিশু-কিশোরদের পাঠ্যবইয়ে এমন পরিবর্তন আনা হয়েছে দেখে অনেকেই বিস্মিত, ক্ষুব্ধ ও দুঃখিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের প্রতিবাদ খুব সোচ্চার নয়। মনে হয়, তাঁরা আওয়ামী লীগের সরকারকে বেশি বিব্রত করতে চান না, বেকায়দায় ফেলতে চান না।
উদ্ভূত সমস্যাটির এই রাজনৈতিক দিক অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ; এটা গভীর চিন্তাভাবনা ও বিচার-বিবেচনা দাবি করে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে শিক্ষার দর্শন আরও গভীর ও ব্যাপক। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবই প্রণয়নের পেছনে একটা বড় দর্শন থাকে। এ বিষয়ে আমাদের উচিত অগ্রসর সমাজগুলোর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া। শিক্ষার উদ্দেশ্য যদি হয় সুবিবেচক মানুষ, বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন দায়িত্বশীল নাগরিক ও দক্ষ লোকবল তৈরি করা, তাহলে এসব উদ্দেশ্য সাধনে যেসব জাতি সাফল্যের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের দিকে আমাদের তাকানো উচিত। আমাদের উচিত ফিনল্যান্ডের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে জানা; এ ক্ষেত্রে তারা সেরা বলে সারা বিশ্বে স্বীকৃত। আমাদের সরকারের উচিত ফিনল্যান্ডে গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের পাঠানো, তাঁরা সে দেশে গিয়ে বিশদভাবে জেনে আসুন সেখানে পাঠ্যবইগুলো কীভাবে প্রণয়ন করা হয়। কীভাবে পাঠ্যবিষয় নির্বাচন করা হয়, কীভাবে নতুন নতুন পাঠ্য-উপাদান তৈরি করা হয়। কোন স্তরে কোন কোন বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। যাঁরা পাঠ্যবস্তু নির্বাচন ও প্রণয়ন করেন, তাঁদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কী ব্যবস্থা সে দেশে গড়ে তোলা হয়েছে। শিক্ষক গড়ে তোলার ব্যবস্থা ও পদ্ধতিগুলো কী।
হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে কিছু পাঠ্যবই থেকে বাংলা সাহিত্যের আদি ও ক্ল্যাসিক কিছু গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, হেফাজতের যুক্তি অনুযায়ী সেগুলোর রচয়িতারা অমুসলিম। অথবা সেগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি ভিন্নধর্মের বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা। পৃথিবীর কোনো সভ্য সমাজের সরকার এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নেয় না। সব দেশে, সব জাতির মধ্যে কিছু বুনিয়াদি সাহিত্য থাকে; সেগুলো বিদ্যালয়ে সব সময় পড়ানো হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেসব গল্প-কাহিনি পড়ে; এভাবে ধ্রুপদি সাহিত্য অতীতের সঙ্গে বর্তমানের, প্রাচীনের সঙ্গে নবীনের পরম্পরা রক্ষা করে। একই গল্পের মধ্য দিয়ে দাদি ও নাতনি পরস্পরের অভিজ্ঞতা-অনুভূতির বিনিময় করতে পারে।
আমাদের ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয়ে কী পড়ানো হবে, কী পড়ানো চলবে না—এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার কোনো সংগঠনের একক অধিকার হতে পারে না। বিষয়টিকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির প্রায়োগিক বিবেচনার অধীনস্থও করা চলে না। এ সরকারের শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে অনেক প্রজ্ঞাবান অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ জড়িত আছেন বলে জানা যায়। সরকার তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ না করে, তাঁদের অজ্ঞাতসারে সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক মহলের কুপরামর্শে জাতির ভবিষ্যৎ বিপন্ন হয়, এমন সিদ্ধান্ত নিলে অবশ্যই তাঁদের জোরালোভাবে প্রতিবাদ করা উচিত। হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে পাঠ্যবইগুলোতে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে, সেগুলো বাতিল করাই যুক্তিসংগত।
মশিউল আলম: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
mashiul.alam@gmail.com