Thank you for trying Sticky AMP!!

শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাস ও 'তোমরাই আমরা'

সব ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী যদি সম্প্রীতি ও সহযোগিতার নীতি চর্চা করে, তাহলে সন্ত্রাস ও বিভাজনের রাজনীতি পরাস্ত হবে

‘ভূমিকম্পের শহরে কী অপেক্ষা করছে’ শিরোনামটি ছিল ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের তৃতীয় টেস্ট সামনে রেখে। ১৫ মার্চ শুক্রবার ঢাকার খবরের কাগজগুলোর মধ্যে যুগান্তর–এর এই শিরোনাম চোখে পড়ার আগেই ক্রাইস্টচার্চে অন্য ধরনের এক ভূমিকম্প ঘটে গেছে। শহরটির দুটি মসজিদে জুমার নামাজে বর্ণবাদী সন্ত্রাস কেড়ে নিয়েছে ৫০ জনের প্রাণ, হাসপাতালেও প্রায় সমানসংখ্যক আহত মানুষের জীবন রক্ষার লড়াই। এই বর্ণবাদী সন্ত্রাস যে শুধু ক্রাইস্টচার্চকেই আন্দোলিত করেছে, তা নয়। পুরো নিউজিল্যান্ড এবং বিশ্বকেই নড়েচড়ে বসতে হচ্ছে।

বর্ণবাদ বিশ্বে নতুন কোনো সমস্যা নয়। তবে গণতান্ত্রিক বিশ্বে তা অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তা যে পরাস্ত হয়নি বা নিঃশেষ হয়ে যায়নি, তার আলামত বেশ কিছুদিন ধরেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছিল। কিন্তু এ রকম মুসলিমবিদ্বেষী সন্ত্রাসী হামলা যে ক্রাইস্টচার্চের মতো একটি শহরে ঘটবে, তা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। তা–ও একজন সন্ত্রাসীর পক্ষে প্রায় ছয় মাইল দূরত্বের দুটি মসজিদে হত্যাকাণ্ড চালানো কীভাবে সম্ভব, তা রীতিমতো ব্যাখ্যার অতীত। মাত্র ৪৪ লাখ অধিবাসীর দেশ নিউজিল্যান্ডে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত এক বছরে যেখানে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে মাত্র ৩৫ জন (সূত্র: স্টাফ ডট সিও ডট এনজেড), সেই দেশের একটি শহরে একজন সন্ত্রাসীর হাতে ৫০ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় কেউ হতভম্ব হয়ে পড়লে তাকে দোষারোপ করা যায় না।

বছরের পর বছর যে দেশটি শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, যার পররাষ্ট্রনীতিকে আগ্রাসী বলা যায় না, যেখানে অপরাধের হার কম, সেখানে নিরাপত্তাব্যবস্থায় কড়াকড়ি থাকার কথা নয়। আফগান যুদ্ধে দেশটি অংশ নিলেও জাতিসংঘের অনুমোদন না থাকায় ইরাক আগ্রাসনে নিউজিল্যান্ড অংশ নেয়নি। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের সব প্রান্ত থেকেই যুদ্ধপীড়িত উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে নিউজিল্যান্ডের নীতি অনেকটাই উদার। পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশ, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে কয়েক বছর ধরে যে ধরনের সন্ত্রাসী হামলা ঘটেছে, তার ছিটেফোঁটাও নিউজিল্যান্ডে দেখা যায়নি। সুতরাং দেশটির নিরাপত্তা–সতর্কতা আমাদের মতো হওয়ার কথাও নয়।

১৫ মার্চের হামলায় আমাদের জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা যে অল্পের জন্য বেঁচে গেছেন, তাতে নিঃসন্দেহে আমরা একটা বড় ধরনের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছি। কিন্তু বিষয়টিকে অনেকেই অন্য একটি মাত্রায় নিয়ে গেছেন। প্রতিটি জীবনই মূল্যবান, এই সত্য বিস্মৃত হলে তা থেকেই মানবতাবোধে বিচ্যুতির ধারা শুরু হয়। ওই হামলায় যে পাঁচজন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন, স্পষ্টতই নিউজিল্যান্ডের সরকার তাঁদের নিরাপত্তার বিধান করতে পারেনি, যেমন পারেনি ভারত, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সোমালিয়া, ফিলিস্তিন, জর্ডানসহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অন্য হতাহতদের। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড যদি নিরাপত্তাব্যবস্থা আগাম রেকি করার জন্য কোনো বিশেষজ্ঞ পাঠাত, তাহলেও যে তারা এই হামলার বিষয়ে কিছু অনুমান করতে পারত—এমন মনে করার কোনো কারণ নেই।

তবে, রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, নিরাপত্তার বিষয়ে আমাদের সামর্থ্য-পেশাদারিতে প্রধানত পাশ্চাত্যের দেশগুলোর আস্থার ঘাটতি রয়েছে। প্রায়ই এর প্রতিফলন দেখা যায় তাদের ভ্রমণসতর্কতায়। সেটা শুধু সন্ত্রাসবাদের ঝুঁকির প্রশ্নে নয়, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার ক্ষেত্রেও ঘটে। এর উল্টোটা কখনো ঘটেছে এমন নজির বিরল। এমনকি আফগানিস্তানে বাংলাদেশিরা অপহৃত ও নিহত হওয়ার পরও আফগানিস্তান ভ্রমণের ব্যাপারে
সরকার কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। নিউজিল্যান্ডের ক্ষেত্রে এখন ভ্রমণসতর্কতা জারির যে ব্যতিক্রম ঘটল, তা কতটা অপরিহার্য ছিল, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

ভারতের নিরাপত্তা পরিদর্শকেরা এসে সব দেখেশুনে সন্তোষ প্রকাশের পরই তাঁদের ক্রিকেটাররা বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। কিন্তু মুম্বাইয়ের তাজ হোটেলে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতে আমাদের ক্রিকেট দলকে পাঠানোর আগে সে রকম কোনো নিরাপত্তা পরিদর্শনের কথা জানা যায় না। অস্ট্রেলিয়ায়ও সন্ত্রাসী হামলার পর বাংলাদেশি ক্রিকেটাররা সেখানে খেলতে গেছেন। গত দু–তিন বছরে লন্ডনে একের পর এক সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে—যার অধিকাংশ ইসলামপন্থী জঙ্গি হামলা হলেও ইসলামবিদ্বেষী বর্ণবাদী সন্ত্রাসের ঘটনাও ঘটেছে। ফিন্সবারি পার্ক মসজিদে রোজার সময়ে তারাবি পড়ে বাড়ি ফেরার পথে নিহত হয়েছেন একজন বাংলাদেশি-বংশোদ্ভূত নাগরিক। আগামী গ্রীষ্মে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে যে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আসর বসবে, তার আগে কি তাহলে বাংলাদেশ নিরাপত্তা তদারকে বিশেষ ব্যবস্থা নেবে? মূল কথা হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদ আর কোনো একটি বা দুটি দেশে সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বজুড়েই এই ঝুঁকিটা রয়েছে। সুতরাং, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় বাস্তবসম্মত পদক্ষেপই প্রত্যাশিত। ক্রাইস্টচার্চের ঘটনায় ক্রিকেটারদের দ্রুত নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়া এবং টেস্ট বাতিল করে দেশে ফেরাটা অবশ্যই যৌক্তিক পদক্ষেপ। কিন্তু একই সঙ্গে আবেগ নিয়ন্ত্রণও জরুরি।

নিউজিল্যান্ডের সন্ত্রাসী হামলা ইসলামবিদ্বেষসহ সব ধরনের বর্ণবিদ্বেষের বিপদের বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে অভিবাসন একটি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং তা বর্ণবিদ্বেষী রাজনীতিকদের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রথম যে সরকারি আদেশ জারি করেছিলেন, তার লক্ষ্য ছিল কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা। পিউ রিসার্চের তথ্য বলছে, নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে আল-কায়েদার হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রে মুসলমানরা যতটা বর্ণবাদী হামলার শিকার হয়েছেন, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে তার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আর ইন্টারন্যাশনাল টেররিজম ইনডেক্স ২০১৮–এর হিসাবে ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সন্ত্রাসী হামলায় মৃত্যুর হার ২০১৪ সাল থেকে বেড়েই চলেছে। অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগের হিসাবে গত ১০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী সন্ত্রাসে হতাহতের সংখ্যা ইসলামপন্থী সন্ত্রাসে হতাহতের দ্বিগুণের বেশি।

ইউরোপেও এই একই ধারার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। হাঙ্গেরি ও ইতালি উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো অভিবাসী ভীতি এবং ইসলামবিদ্বেষ প্রচারের মাধ্যমে রাজনীতিতে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে। ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, গ্রিস, নরওয়ে, পোল্যান্ড, সুইডেনসহ ইউরোপের অনেক দেশেই ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণার আড়ালে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলো সংগঠিত হচ্ছে। বিশ্বের আরেক প্রান্ত অস্ট্রেলিয়ায়ও ডানপন্থী দলগুলো অভিবাসন এবং ইসলামভীতিকে রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত করেছে। মানবাধিকারকর্মীদের আপত্তি সত্ত্বেও দেশটি বহু অভিবাসনকামীকে প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতে প্রায় অবরুদ্ধ অবস্থায় রেখেছে। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পটভূমিতে নিউজিল্যান্ডেও অভিবাসনবিরোধী রাজনীতি ও ইসলামবিদ্বেষ অস্বাভাবিক নয়। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে নিউজিল্যান্ড যে অভিবাসনবিরোধী রাজনীতি ও ইসলামবিদ্বেষের প্রভাবমুক্ত থাকবে, এমনটি মনে করার কারণ নেই। বস্তুত, ক্ষমতাসীন লেবার সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্সের বিরুদ্ধেই এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এশীয়দের কথিত আগ্রাসনের (ইনভেশনের) বিরোধিতায় তিনি অগ্রগামী ছিলেন। রাজনীতিকদের এ ধরনের ভাষা এ ধরনের উগ্রবাদী সন্ত্রাসকে যে উৎসাহ জোগায়, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ কই? প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আহডার্ন নিজেও বিবিসির কাছে এই বর্ণবাদিতার অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে তার বিরুদ্ধে ঐক্যের কথা বলেছেন। ক্রাইস্টচার্চের হামলাকারী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যেমন প্রশংসা করেছে, তেমনি প্রশংসা নরওয়ের গণহত্যাকারী অ্যান্ডারস ব্রেইভিকের মুখে শোনা গেছে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জন হাওয়ার্ড সম্পর্কে।

গণমাধ্যমের ভূমিকাও এখন নতুন করে আলোচনায় আসছে। গণমাধ্যমে উচ্চারিত শব্দ ও ব্যবহৃত ভাষা পক্ষপাতমূলক এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা ও বিদ্বেষ ছড়ানোয় ভূমিকা রাখছে—এমন অভিযোগ ক্রমশই জোরদার হচ্ছে। ইসলামপন্থী জঙ্গিদের হামলার জন্য প্রায়ই পুরো মুসলিম সম্প্রদায় এবং ধর্মকে দায়ী করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়—যার কিছুটা অসতর্কতাজনিত আর কিছুটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিপরীতে, হামলাকারী শ্বেতাঙ্গ এবং ডানপন্থী আদর্শের অনুসারী হলে তাকে বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসেবে তুলে ধরা, তার মানসিক সুস্থতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলে একধরনের সহানুভূতি প্রদর্শনের অভিযোগও রয়েছে। জর্জিয়া ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ইসলামপন্থীদের সন্ত্রাসী হামলায় অন্যান্য সন্ত্রাসী হামলার চেয়ে ৩৫৭ শতাংশ বেশি খবর তৈরি হয়। আর হিংসা ও বিদ্বেষের প্রচার প্রসারে সর্বসাম্প্রতিক সংযুক্তি হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। ক্রাইস্টচার্চের হামলার সরাসরি সম্প্রচার এবং সেই ভিডিওকে কেন্দ্র করে সামাজিক বিতর্কে এর তীব্রতার প্রমাণ মেলে। লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকা তাই যথার্থই শিরোনাম করেছিল, ‘দ্য ফার্স্ট সোশ্যাল মিডিয়া টেরর অ্যাটাক’।

আশার কথা, নিউজিল্যান্ডে এই হামলার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আহডার্ন বিরল নেতৃত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যেই শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছেন শ্বেতাঙ্গ এই নারী। তিনি হামলার শিকার উদ্বাস্তু অভিবাসীদের ‘তোমরাই আমরা’ বলে ঘোষণা করে বলেছেন, ‘সন্ত্রাসী হামলাকারীর আমাদের মধ্যে কোনো স্থান নেই।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁকে সাহায্যের প্রস্তাব দেওয়ায় তিনি মুসলমানদের স্বীকার করে নেওয়ার কথা বলেছেন। ক্রাইস্টচার্চের অনুসরণে লন্ডন, নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন শহরে যাজকেরা মসজিদে গিয়ে নামাজের সময়টা পাহারা দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন, পাহারা দিচ্ছেন। সাধারণ মানুষ এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসছেন। স্কটল্যান্ডের অ্যাবারডিন শহরে ২০১৩ সাল থেকে সেন্ট জর্জ চার্চের দরোজা পাশের মসজিদের মুসল্লিদের জন্য প্রতি শুক্রবার খুলে দেওয়া হয় এবং গির্জার ভেতরেই অনেকে নামাজ পড়েন। সব ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী যদি এই সম্প্রীতি ও সহযোগিতার নীতি চর্চা করে, তাহলে সন্ত্রাস ও বিভাজনের রাজনীতি পরাস্ত হবে।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক