Thank you for trying Sticky AMP!!

শ্রীলঙ্কায় ক্ষমতার ওলট-পালট

ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে সরিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা শ্রীলঙ্কাকে দাঁড় করিয়েছেন নতুন বাঁকে। নতুন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে সেনাসদস্যদের পাহারা। ছবি: এএফপি

শ্রীলঙ্কায় এখন দুজন রাজনীতিবিদ নিজেদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাবি করছেন। ২৬ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার দপ্তর থেকে একই সঙ্গে দুটি ‘এক্সট্রা অর্ডিনারি গেজেট’ প্রকাশিত হয়। গেজেট দুটি প্রকাশ করেন প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারি উদয় সেনিবিরতে। প্রথম গেজেটে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহেকে বরখাস্তের আদেশ দেন; দ্বিতীয় গেজেটে তাৎক্ষণিকভাবে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের কথা জানান।


তাৎক্ষণিকভাবে রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথও নিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু বিক্রমাসিংহে তাঁর বরখাস্তের আদেশ মেনে নিতে অস্বীকার করছেন। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনও ছাড়েননি তিনি। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে তাঁর অবস্থান দেখাতেই কূটনীতিবিদদের এক বৈঠকও আহ্বান করেছিলেন গতকাল সেখানে তিনি। তাঁর সমর্থকেরা প্রেসিডেন্টের গেজেট দুটিকে সংবিধানপরিপন্থী বলছেন। অন্যদিকে, রাজাপক্ষে নিজ বাসভবনে বসেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রিত্বের উভয় দাবিদার এ মুহূর্তে তাঁদের পাশে শক্তিধর সামরিক আমলাতন্ত্রের সমর্থন দেখাতে সচেষ্ট আছেন। রাজাপক্ষের বাসভবন থেকে শপথের পর প্রথম যে ছবিটি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো হয়, তাতে দেখা যাচ্ছে, দেশের পুলিশপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করছেন তিনি। স্পষ্টত, এটা একটা বার্তাস্বরূপ। প্রত্যুত্তরে বিক্রমাসিংহের মন্ত্রিসভার মুখপত্র রাজিথা সেনারত্নে সামরিক বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে সংবিধান অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন।

এমন পাল্টাপাল্টি পরিস্থিতি বেশ নাটকীয় অবস্থার জন্ম দিয়েছে দেশটিতে। মূলত, প্রেসিডেন্ট সিরিসেনাই আকস্মিকভাবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই অচিন্তনীয় অবস্থার জন্ম দিয়েছেন। কলম্বোয় বিদেশি কূটনীতিবিদেরা কেউই প্রেসিডেন্টের এই আকস্মিক পদক্ষেপের ছিটেফোঁটাও আগাম টের পাননি। সেটাও বিস্তর কূটনৈতিক বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে।

যদিও কয়েক মাস ধরে সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহের সম্পর্ক তিক্ত যাচ্ছিল, কিন্তু প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করতে পারেন, এমনটি ছিল প্রায় কল্পনাতীত। দেশে ইদানীং পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে জল্পনাকল্পনা চলছিল। প্রেসিডেন্টের নতুন ঘোষণায় পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নিল।

দুই.
প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহকে বরখাস্তের পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা পার্লামেন্ট অধিবেশন মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেছেন। স্পষ্টত, আগামী দুই সপ্তাহ রাজাপক্ষেকে পার্লামেন্টে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংগ্রহের’ সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। পার্লামেন্টে সর্বশেষ যে সমীকরণ ছিল, তাতে বিক্রমাসিংহের পক্ষে ১০৬ জন এবং সিরিসেনা-রাজাপক্ষের পক্ষে ৯৫ জন সদস্যের সমর্থন রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সরকার গঠনের জন্য ২২৫ সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টে অন্তত অর্ধেক সদস্যের সমর্থন প্রয়োজন। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী পদের উভয় দাবিদার সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের কঠিন এক চ্যালেঞ্জের মুখে আছেন এখন।

ভুটান ও মালদ্বীপের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করলে শ্রীলঙ্কার এই পরিস্থিতির একধরনের ব্যাখ্যা মেলে। তবে এর কিছু পৃথক তাৎপর্যও আছে।

ভুটানে ১৮ অক্টোবরের সর্বশেষ নির্বাচনে ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের অধিকারী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি প্রথম রাউন্ডেই পরাজিত হয়ে ক্ষমতার পরিসর থেকে আপাতত পুরোপুরি ছিটকে পড়েছে। দ্বিতীয় রাউন্ডের নির্বাচনে অংশই নিতে পারেনি তারা। প্রায় একই সময়ে মালদ্বীপে চীনপন্থী প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিন নির্বাচনে হেরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহের প্রেসিডেন্ট হওয়া নিশ্চিত করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের যে ত্রিমুখী ছদ্ম ঠান্ডাযুদ্ধ চলছে, মালদ্বীপ ও ভুটানের নির্বাচনকালে তার প্রকাশ ছিল প্রায় খোলামেলা। শ্রীলঙ্কার চলতি নাটকীয়তাকে তার থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবতে চাইছেন না কূটনীতিবিদেরা।

সিরিসেনার গেজেট দুটি প্রকাশ হওয়া মাত্র চীনের রাষ্ট্রদূত চেং শুয়েউয়ান প্রধানমন্ত্রী পদের উভয় দাবিদারের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে সাক্ষাৎ করেছেন। এই সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে চীন কলম্বোয় তার সক্রিয় উপস্থিতির কথাই জানিয়ে দিল। এ ধরনের বৈঠকের মধ্য দিয়ে আপাতত কলম্বোয় চলতি ঠান্ডাযুদ্ধে চীন এগিয়ে বলেই মনে হচ্ছে। রাজাপক্ষের প্রতি তাদের সমর্থন বেশ খোলামেলা। বিক্রমাসিংহের প্রতি দিল্লির সহানুভূতিতেও কোনো গোপনীয়তা নেই। প্রধান প্রধান ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রেসিডেন্ট সিরিসেনাকে তাঁর পদক্ষেপের জন্য দোষারোপ করা হচ্ছে। অন্যদিকে, কলম্বোয় চীনের রাষ্ট্রদূত চেং শুয়েউয়ান ইতিমধ্যে নতুন প্রধানমন্ত্রীকে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের শুভেচ্ছা পৌঁছে দিয়েছেন বলেও প্রচারমাধ্যমকে জানিয়েছেন। সিরিসেনার পদক্ষেপে তাঁরা খুশি বলেই মনে হচ্ছে।

ঠিক উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বিবৃতিতে। তারা দেশটিতে ‘সংবিধানের শাসন’ অনুসরণের দাবি জানিয়েছে। তাদের আবেগ ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সহানুভূতিশীল বলেই মনে হচ্ছে। ভারত সরাসরি কোনো বিবৃতি না দিলেও দেশটিতে ভারতঘেঁষা থিংকট্যাংক ‘ফ্রাইডে ফোরাম’ সিরিসেনার পদক্ষেপকে অসাংবিধানিক বলে দাবি করেছে। সিরিসেনা ও বিক্রমাসিংহে উভয়েই অবশ্য নিজ নিজ অবস্থানের পক্ষে দেশটির সংবিধানকে রক্ষাকবচ হিসেবে উল্লেখ করছেন। সংবিধান অনুযায়ী দেশটিতে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী উভয়ে তাঁদের কাজের জন্য পার্লামেন্টের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। প্রেসিডেন্ট পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনপুষ্ট সদস্যকেই প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবেন বলে উল্লেখ রয়েছে। তবে এও উল্লেখ রয়েছে, প্রেসিডেন্টের অধিকার রয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার।

প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা আজ দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। এতে তিনি পুরো ঘটনার ব্যাখ্যা দেবেন বলে মনে হয়। পাশাপাশি এও আশা করা হচ্ছে, তাঁর পদক্ষেপের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও বক্তব্য দেবেন তিনি। আগামীকাল রাজাপক্ষে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম ঘোষণা করবেন বলে কথা রয়েছে। যদিও এখনো স্পষ্ট নয়, রাজাপক্ষে ২৬ নভেম্বর পার্লামেন্টে তাঁর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন কি না।

তিন.
রাজাপক্ষেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের মধ্য দিয়ে আপাতত শ্রীলঙ্কায় ফ্রিডম পার্টির দ্বিধাবিভক্তির অবসান ঘটল। এত দিন রাজাপক্ষে ও সিরিসেনা এই দলের দুটি খণ্ডাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অতীতের ফ্রিডম পার্টিতে রাজাপক্ষেই সিরিসেনার নেতা ছিলেন। আগামীকাল যে মন্ত্রিসভা শপথ নেবে বলে মনে হচ্ছে, তার বাছাই মূলত রাজাপক্ষেই করবেন বলে ধারণা করা যায়। তাতে বিক্রমাসিংহের ন্যাশনাল পার্টির কিছু মুখও দেখা যেতে পারে। সেই মুখগুলোর সংখ্যা ও পরিচিতি নিয়েই শ্রীলঙ্কাজুড়ে মুহূর্তে জল্পনাকল্পনা চলছে।

ইতিমধ্যে পার্লামেন্ট কিছু কিছু সদস্যের আনুগত্য পরিবর্তনের আভাস মিলেছে। বিক্রমাসিংহের ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির কিছু সদস্যের পক্ষ পরিবর্তন প্রায় নিশ্চিত বলেই মনে হচ্ছে। এই সংখ্যা কত বড় হবে, সেটার ওপরই সিরিসেনা-রাজাপক্ষের হঠাৎ সৃষ্ট মৈত্রীর ভাগ্য নির্ভর করছে। এ বছরই এপ্রিলে আরেক দফা অনাস্থা ভোটে বিক্রমাসিংহে ২৬ ভোটে টিকে গিয়েছিলেন। এবার পরিস্থিতি পাল্টেও যেতে পারে।

ইতিমধ্যে গতকাল তামিল চা–বাগিচা শ্রমিকদের দল ‘সিলন ওয়ার্কার্স কংগ্রেস’ ও তামিলদের একটি উপদলের নেতা ডগলাস দেবানন্দন রাজাপক্ষের পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। উত্তর ও পূর্বাঞ্চলের এলটিটিইর প্রতি সহানুভূতিশীল তামিল ও রউফ হাকিমের নেতৃত্বাধীন মুসলমানদের মূল দলগুলো হয়তো নিকট অতীতের মতোই বিক্রমাসিংহের পক্ষে থেকে যাবেন। গুরুত্বপূর্ণ আরেক রাজনৈতিক শক্তি সিংহলি তরুণদের জনতা বিমুক্তি পেরামুনা বলছে, তারা কোনো প্রার্থীকে সমর্থন করবে না।

এ পরিস্থিতিতে রাজাপক্ষেকে ১৬ নভেম্বরের আগেই অসাধ্যসাধন করতে হবে। নিঃসন্দেহে মাঝের এই দিনগুলোতে ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিবিদেরাও তাঁদের সর্বোচ্চ কর্মদক্ষতা প্রদর্শন করতে তৎপর হবেন পর্দার অন্তরালে নিজ নিজ পছন্দের ‘প্রধানমন্ত্রী’র জন্য।

তবে চলতি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা প্রলম্বিত করা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির জন্য জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কারণ, নভেম্বর মাসেই দেশটির পার্লামেন্টে বাজেট অধিবেশন হওয়ার কথা।

আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক