Thank you for trying Sticky AMP!!

সংগীত ও চিত্রকলার মহোৎসব

সংগীতের উৎ​সব শেষ হয়েছে, শুরু হচ্ছে চিত্রকলার উৎ​সব

উনিশ বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। গিয়েছিলাম কানাডার অটোয়া শহরে। সেখানে এক বন্ধুর বাড়ি। আমরা পৌঁছেছিলাম শেষ বিকেলে। বন্ধু বাসাতেই ছিল, তার বিদেশি স্ত্রী তখনো অফিস থেকে ফেরেননি। ফিরলে পরিচয় পর্ব, কুশলবিনিময় শেষে চায়ের আয়োজন হলো। টেবিলে বন্ধুর স্ত্রী বলেন, তিনি ভারতীয় বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ জাকির হোসেনের তবলা বাদন শুনতে যাবেন। আমাদের আগ্রহ আছে কি না।
পড়ে যাই দোটানায়। না যেতে চাইলে বন্ধুকে আমাদের সঙ্গে ঘরে থাকতে হয়। ভাবলাম যাই। খুব আগ্রহ নিয়ে যাওয়া হয়নি। পরে মনে হয়েছে, ওস্তাদ জাকির হোসেনের সে তবলা বাদন উপভোগ করতে সেদিন যদি না যেতাম, একটা উল্লেখযোগ্য অসাধারণ ঘটনা থেকে জীবন বঞ্চিত থাকত। তবলা বুঝি না। কোনো দিন আলাদা করে শোনা হয়নি। গানের সঙ্গে তাল রক্ষার জন্য বাজানো হয়, এটুকুই জানতাম। বাদন শোনার পর বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলাম। বুঝে নয়, তবলা বাদনের মধ্যে যে অপার বিস্ময় লুকিয়ে থাকে, তার প্রকাশ ঘটেছিল সেদিন। অপরিণত শ্রোতা হলেও ওস্তাদ জাকির হোসেনকে মনে হয়েছিল জাদু জানেন।
সুন্দর ও বিশেষের প্রতি মানুষের আগ্রহ অসীম। তার সবচেয়ে উজ্জ্বল প্রমাণ বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব। দেশের সংগীত অনুরাগী এবং সাধারণেরা এ বছর পঞ্চমবারের মতো অসাধারণ এ আসর উপভোগ করতে পারলেন। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন যখন এ রকম একটি অনুষ্ঠান প্রথম আয়োজন করেছিল, তখন এমন অবাক করা দর্শক সাড়া মিলবে, এই ভিন্ন স্বাদের আয়োজন এতটা আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে, তা কি মনে হয়েছিল! একটু গভীরে তলিয়ে দেখলে প্রবল সাহস ও মানুষের প্রতি বিশ্বাসের সন্ধান মেলে। তা আনন্দের, গৌরবের। এ আনন্দ উপভোগের জন্য হাজার মানুষের বিনিদ্র রাত্রি কেটেছে। কেটেছে সুরলোকের মুগ্ধতায়।
ভালোর পাশাপাশি মন্দ বলা বা শোনাতে বিনোদন আছে। সে বিনোদনের চর্চাও থেমে থাকেনি। পাঁচ দিনের অনুষ্ঠানে বছরের পর বছর আগ্রহী মানুষের সংখ্যা কেবলই বেড়েছে। বেড়ে চলেছে দিনে দিনেও। অনেকের মনে প্রশ্ন, সবাই এতটা সংগীতপ্রেমী কি না। বড়ই অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন। হাতের পাঁচ আঙুল সমান নয়। মানুষও নানান রকম। যদি তা মেনে নিয়ে থাকি, সবাইকে সমান সংগীতপ্রেমী হতে হবে কেন। আরও তলানো সমালোচনাও শোনা যায়। শুনতে যায় কেউ, দেখতে যায় অনেকে, বহু মানুষ যায় দেখাতে।
কথা মিথ্যা কি সত্যি, সে হিসেবে মূল্যবান সময়ের অপচয় করার কী দরকার। এ কথা ঠিক, কোনো উদ্যাপন যথার্থ হয়ে ওঠে বা বর্ণিল শোভা পায় মানুষের বিচিত্রতাতেই। বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীতের এ উৎসবে মানুষ যায় সংগীতের টানে, বিস্ময়ের টানে। মানুষেরা মানুষের টানেও যায়। সব যাওয়াই বিশেষ। বছরে বছরে, দিনে দিনে সে বিস্ময়ের কথা ছড়িয়ে পড়েছে মুখ থেকে মুখে। তাতে উচ্চাঙ্গসংগীতের মতো একটি গভীর চেতনার বিষয় সর্বজন আগ্রহের বিষয়ে পরিণত হয়ে উঠেছে। সংস্কৃতির দীনহীন কালে বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব বিশেষ ও সাধারণ উভয়ের জন্য পরম প্রাপ্তি।
কোনো উৎসব, তার প্রাপ্তির বিষয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুভব ‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র একাকী কিন্তু উৎসবের দিনে মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া বৃহৎ।’ এই বৃহৎ অনুভবের আরেক সুযোগ সামনে হাজির। এক উৎসবের ইতি ঘটেছে। শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হচ্ছে এশীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। এবার স্বাগতিক বাংলাদেশসহ ৫৪টি দেশের শিল্পীদের ছবি একত্রে দেখার সুযোগ মিলবে দ্বিবার্ষিক এই আয়োজনে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিন থেকে শুরু হয়ে চলবে মাসজুড়ে।
অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের প্রতি মানুষের আগ্রহ অনুরাগের সঙ্গে চিত্রকলায় আগ্রহের তুলনা টানলে তফাত চোখে পড়বে। তা দুঃখের, হতাশার বা গ্লানিরও নয়; বরং আশার কথা আছে। চর্চার অভাবে শিল্পী ও সৃজনের গৌরব অনেকটা নেপথ্যেই থেকে যায়। চিত্রকলা সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর মানুষের এক বৃহৎ অংশ দ্য ভিঞ্চির মোনালিসার নাম জানে। আলোচনা, কথাবিনিময়ের ফল। এ ফল চর্চার। চর্চার অভাবে দেশের অত্যন্ত অগ্রসর শিল্পমাধ্যম শুধু অনুরাগীদের ধারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে।
সীমাবদ্ধতা উচ্চারণ করলে একটু ব্যাখ্যারও প্রয়োজন পড়ে। পৃথিবীর চিত্র মানচিত্রে বাংলাদেশের চিত্রকলা একটু একটু করে দৃঢ়, সুস্পষ্ট ও আগ্রহের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। নিজ দেশের দিকে তাকালেও তা সীমায় আটকা পড়ে নেই, ক্রমাগত অতিক্রমের সামর্থ্য চোখে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউরোপযাত্রীর ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘যে জাতির মধ্যে শিল্পচর্চা অধিক তারা অন্য জাতির চেয়ে বলিষ্ঠ বা তাদের জীবনীশক্তি অধিক।’
মানুষ সর্ববিষয়ে জ্ঞানসম্পন্ন নয়। আন্তরিক চেষ্টায় জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে। মনে আগ্রহ না থাকলে পাওয়া হয় না কিছুই। ছবি বা চিত্রকলার সামনে দাঁড়িয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগে ওঠে ‘ছবিতে কী বলতে চাওয়া হয়েছে’। এ প্রশ্নের উত্তর না পেলেও কিংবা নিজ মনে নিজস্ব ভাব বা কোনো অর্থের উদয় হলে তা ভুল বা অন্যায় বলবে না কেউ। চিত্রকরের সঙ্গে চিত্ররসিকের ভাবনার মিল হতে পারে, না-ও হতে পারে। তাতে ছবিটা ব্যর্থ হয় না। শিল্পীও ব্যর্থ হন না। ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দর্শক বিপন্নবোধ না করে ভাব বুঝতে বা অনুভবের চেষ্টা করেন, সেটাই আসল।
চোখ বড় করা ছোট্ট একটা কথা বলেছেন কবিগুরু, ‘যা আমাদের ভালো লাগে অগোচরে তাই আমাদের গড়ে তোলে।’
জগৎটাকে জগৎ বলেই জানা, কিন্তু তা এক মহা আকর্ষণীয় চিত্র প্রদর্শনী। বিস্ময়কর রং, রেখা, আকৃতি, গঠন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে চারদিকে। সেসব অনুভূতি সংলগ্ন করতে পারলে শিল্পের রস আস্বাদন সম্ভব হয়। বৃক্ষকে আমরা সচরাচর একরঙা সবুজ বৃক্ষÿ বলে জানি। মনোযোগ নিবিষ্ট করে তার মধ্যে আরও রঙের সমাবেশ খুঁজে পাওয়া যাবে। সচেতন-অসচেতনতায় চতুর্দিকের অসাধারণ শিল্পরূপ মানুষকে মোহিত করে, অনুপ্রাণিত করে। মানুষ তার মধ্যে বাস করে নিজেকে, আপন শক্তিকে আবিষ্কার করতে চায়, সৃজনের সামর্থ্য প্রকাশ করতে চায়। মুক্ত হওয়ার জন্য মানুষের যে আবেগ, চেষ্টা তা-ই শিল্প, শিল্পের সাধনা।
শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠেয় এশীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে ১৫০ জন শিল্পীর ২৬০টি শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হবে। বিপুল আয়োজন। অজস্র ভাবনা ও বিচিত্র প্রয়োগ ও উপস্থাপনার এ এক মহাসমাবেশ। যে কারও জন্য এ হবে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। শিল্পীদের জন্য এ আয়োজন বিশেষ। দেশের জন্য বিশেষ। অনুরাগীদের জন্য বিশেষ। কৌতূহলীদের জন্যও বিশেষ বলা চলে নির্দ্বিধায়। হয়তো এ আয়োজন অনেকের মনে বিশেষ কোনো আগ্রহই সৃষ্টি করবে না। কখনো বোঝার চেষ্টা না করে ‘বুঝি না’ বলার মানুষ রয়েছে অনেক। সেসব মন সৌন্দর্যবোধহীন নয়। রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘মানুষ যেখানেই আপনার কর্মের গৌরববোধ করেছে সেখানেই কর্মকে সুন্দর করবার চেষ্টা করেছে। তার ঘরকে বানাতে চায় সুন্দর করে, তার পানপাত্র অন্নপাত্র সুন্দর। তার কাপড়ে থাকে শোভার চেষ্টা। তার জীবনে প্রয়োজনের চেয়ে সজ্জার অংশ কম থাকে না।’
শিল্পী সবাই। কেউ থাকে জেগে, কেউ আছে ঘুমিয়ে। এমন উৎসবের সান্নিধ্য চোখ খুলে দেয়, মনের ঘুম ভাঙিয়ে দিতে পারে। জেগে থাকারাও জাগে নতুন উপলব্ধির আলোয়।

আফজাল হোসেন: অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, লেখক, বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা।
afzalhossain1515@yahoo.com