Thank you for trying Sticky AMP!!

সবাই শামিল না হলে দেশ হেরে যাবে

মাদকের ছোবল থেকে মানবজাতিকে বাঁচানোর জন্য যুগে যুগে দেশে দেশে মাদকবিরোধী আইন হয়েছে। প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অনেক দেশে মাদকবিরোধী আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। আমাদের দেশেও কঠিন আইন আছে। বিভিন্ন দেশে মাদক প্রতিরোধ ও মাদকাসক্তের চিকিৎসার জন্য শত শতকোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তারপরও মাদকের ব্যবহার থেমে নেই। মাদক তার কালো থাবা বিস্তার করেই চলেছে।

১৯৬০ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়। ‘ওয়ার অন ড্রাগস’ স্লোগানটি প্রথম ব্যবহৃত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৭১ সালের ১৮ জুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা করেন, মাদকের অপব্যবহার জনগণের এক নম্বর শত্রু। রিচার্ড নিক্সন ফেডারেল সরকারকে মাদকের উৎপাদন, পরিবহন ও অপব্যবহার বন্ধ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দেন। তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মাদক দমনের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা হচ্ছে।

মাদকবিরোধী যুদ্ধের দীর্ঘ ৩০ বছর পর ড্রাগ এনফোর্সমেন্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আমেরিকা বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে মাদক নির্মূলের জন্য। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা অবৈধ মাদকের ১০ শতাংশ জব্দ করতে পারে। বাকি ৯০ শতাংশ মাদক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদকসেবীদের কাছে চলে যায়। তবে ১০ শতাংশ মাদকের জন্য কেন এত ব্যয়? মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান করে অসংখ্য লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেলে তাদের রাখতে জেল কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে দিন দিন মাদকসেবীদের ভিড় বেড়েই চলেছে। কিন্তু মাদক নির্মূল করা যায়নি, বরং বেড়েই চলেছে।

 বাংলাদেশের চিত্র

বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। মাদকাসক্তের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে কঠোর আইন আছে। পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রতিদিন বহু মাদকদ্রব্য উদ্ধার করছেন, গ্রেপ্তার করছেন এবং মামলা নিচ্ছেন। কিন্তু মাদকের বিস্তার ও আসক্তি রোধ করা যাচ্ছে না। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ৪১৭ কেজি হেরোইন, ৮৯ হাজার ১২ কেজি গাঁজা, ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৮২৮ ফেনসিডিল এবং ৩ কোটি ৬৯ রাখ ৪৭ হাজার ৮২২টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করে।

প্রধানমন্ত্রী মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিলে পুলিশ ও র‍্যাব ১৭ মে ২০১৮ থেকে বিশেষ অভিযান শুরু করে। এ অভিযানে বহু মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হন, বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার হয়। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মাদক ব্যবসায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে এনকাউন্টারে নিহত হন। এ অভিযানে মাদকের সরবরাহ কিছুটা হ্রাস পেলেও পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

 আমাদের যে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত

মাদকের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। মাদক ব্যবসার সঙ্গে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা গডফাদার জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব সদস্যকে শতভাগ সততা নিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁদের মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করতে হবে। কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা নেওয়াসহ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

জনগণের মধ্যে ব্যাপকভাবে সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে। এ লক্ষ্যে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে মাদকের কুফল সম্পর্কে জ্ঞান দান করতে হবে। কোনোক্রমেই যাতে তারা মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে, সে জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তাদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

প্রত্যেক পরিবারকে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন হতে হবে। পিতা–মাতা ও পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাঁদের সন্তানদের মাদকের বিরুদ্ধে সচেতন করতে হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকে মাদকের ক্ষতিকর বিষয় সম্পর্কে শিক্ষামূলক তথ্যাবলি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের মাদকের বিরুদ্ধে জ্ঞান দান করবেন এবং তাদের দিকে খেয়াল রাখবেন যাতে কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদক ব্যবহার না করে।

মাদকাসক্তদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে নিরাময় করে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবারের ভূমিকাই মুখ্য। কোনো পরিবারে কেউ মাদকাসক্ত হলে তা গোপন রাখা হয়। কিন্তু এটা গোপন রাখার বিষয় না। মাদকাসক্ত ব্যক্তি তো অসুস্থ। পরিবার-আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে তার পাশে দাঁড়াতে হবে। তাকে সুস্থ করার জন্য ভূমিকা নিতে হবে।

 আমাদের দেশে উন্নতমানের মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের অভাব আছে। সরকারি পর্যায়ে খুবই অপ্রতুল। অধিকাংশ বেসরকারি নিরাময় কেন্দ্রগুলো মানসম্মত নয়। সরকারি উদ্যোগে সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরে প্রয়োজনীয়সংখ্যক উন্নতমানের নিরাময় কেন্দ্র নির্মাণ করা অপরিহার্য। ওই সব নিরাময় কেন্দ্র অবশ্যই দক্ষ ও আধুনিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী ও সাইকোথেরাপিস্ট দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। শুধু সরবরাহ বন্ধের চেষ্টা করেই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। সমাজে মাদকের চাহিদা থাকলে যেকোনো প্রকারেই মাদকের সরবরাহ আসবে। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন এবং শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে নতুন করে মাদকাসক্তির প্রবণতা কমাতে পারলে সমাজে মাদকের চাহিদা কমে যাবে।

মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করা কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব ও কর্তব্য মনে করে বসে থাকলে হবে না। অভিযানের পাশাপাশি প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের সার্বিক কার্যক্রম সমানতালে চালাতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংস্থাকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সব পেশা ও মতের লোকদের ঐক্যবদ্ধভাবে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

পুলিশ কর্মকর্তারা কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে নিজ নিজ এখতিয়ারভুক্ত এলাকার সব শ্রেণির লোকদের উদ্বুদ্ধ করে মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন বেগবান করতে পারেন। তাঁরা নিজেরাও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ফোরামে গিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধকরণমূলক বক্তব্য দিতে পারেন। আলেম–ওলামাদেরও মাদকের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ নিতে হবে।

 এ কে এম শহীদুল হক বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক