Thank you for trying Sticky AMP!!

সব চৌকিদার চোর নয়

বর্তমান কংগ্রেসপ্রধান রাহুল গান্ধী গদিনশিন প্রধানমন্ত্রী মোদিকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন ‘চৌকিদার চোর’, মানে গাছ খাচ্ছে বেড়ায়। এই রাজনৈতিক বাত কি বাত ক্রমেই নির্বাচনী স্লোগানে পরিণত হয়। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতির অবস্থান বোঝাতে মুখরোচক বাগধারায় পরিণত হয় সহজ কিন্তু সর্বগ্রাসী এই শব্দ দুটি। ভারতে প্রশ্ন ওঠে, সব চৌকিদার কি চোর, নাকি চোরেরাই এখন চৌকিদার হচ্ছে। চোর-চৌকিদারের টম অ্যান্ড জেরি মার্কা পাল্টা লড়াইয়ে নেমে মোদি তাঁর দেশের প্রায় ২৫ লাখ চৌকিদারের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স করে তাঁদের কাছে বিচার দেন। তিনি তাঁদের বলেন, ‘কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থে দেশের তাবৎ চৌকিদারকে ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগান তুলে অপমান করছেন। গোটা দেশের চৌকিদারদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, যেভাবে বারবার চোর বলে আপনাদের অপমান করা হচ্ছে, তাতে আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আমি দেশের সব চৌকিদারের কাছে ক্ষমা চাইছি। যতই আমাদের চোর বলুক, আমরা কিন্তু ভয় পাব না। আমরা এই অপমানকেই অলংকার হিসেবে ব্যবহার করব। দেশের চৌকিদারদের মতোই আমিও রাত-দিন চব্বিশ ঘণ্টা সজাগ আছি।’

ভারতে সবাই জানে, যখন কেউ বলে যে 'চৌকিদার চোর' তখন সে নরেন্দ্র মোদির কথাই বলে। বলা বাহুল্য, চৌকিদার শব্দটি রাহুল রূপক অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। যাঁরা দিন-রাত সততার সঙ্গে রাস্তাঘাট, ব্যাংক, টাঁকশাল, থানা, জেলখানা, হাসপাতাল, স্টেশন প্রভৃতি পাহারা দিচ্ছেন, তাঁদের তিনি অসৎ বলেননি। তার পরও মোদি দেশের সব চৌকির চৌকিদারের কাছে বিচার দিয়েছেন। রাহুল ‘শিয়ালের কাছে মুরগি ভাগা’ না দেওয়ার কথা বললে মোদি হয়তো শেয়ালদের ডেকে বিচার দিতেন। রাজনীতিতে কোনোটাই অসম্ভব নয়।

সে যা-ই হোক, ভারতের ধান ভারতে ভানতে যে গীত খুশি তারা গাক, সেসব নিয়ে আমাদের চিন্তা না করলেও চলবে। তবে আমাদের ধানের অন্য গীত। এ দেশে চৌকিদারদের ওপর আমাদের ভাসা ভাসা ভরসা যখন ক্রমেই হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে, তখন ইদানীং দু-একজন বেশ সাহসের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসেছেন। নাটোরের সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আকতার বানু দাঁড়িয়ে থেকে প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে নিয়ম মেনে তিন টন ধান কিনিয়েছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও তাঁর দলবলকে দিয়ে। এর দুদিন আগেই কৃষিমন্ত্রী হাল ছেড়ে দিয়ে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় খাদ্য গুদামগুলো জিম্মি থাকে। সরকার সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য কেনার জন্য ঘোষণা দিলেও তাঁদের চাপে তা সম্ভব হয়ে ওঠে না । ফলে সরকারি উদ্দেশ্যও বাস্তবায়ন হয় না, শস্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত থাকেন সাধারণ কৃষকেরা।

এ রকম গা-সওয়া ইঙ্গিত পাওয়ার পরও কথিত প্রভাবশালীদের সিন্ডিকেট ভেঙে নিজের মেরুদণ্ড শক্ত করে দাঁড়ালেন নাটোরের সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আকতার বানু। সরাসরি প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনে দেখালেন, চাইলে কী না সম্ভব । প্রমাণ করলেন চুরিকে প্রশ্রয় না দেওয়ার মতো চৌকিদার এখনো আছে। সব চৌকিদার চোর নয়। তাঁর এই দৃঢ়তার ছবি সংক্রমিত হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে।

এটা ঠিক, উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁর আর দশটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে ধান কেনার মৌসুমে গুদামে গুদামে খবরদারি বেশি দিন করতে পারবেন না, তবে সিস্টেম বা প্রচলিত ব্যবস্থা যখন কাজ করে না, তখন অন্য রকম কিছু কাজকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। জেসমিন বানু সেটাই করেছেন। অনিয়মের বাঁকা লেজটা সাধ্যমতো সোজা রাখার চেষ্টা করেছেন কয়েক ঘণ্টা ধরে। তিনি তাঁর চেষ্টার মাধ্যমে তাঁর ওপর-নিচ সমান সব সহকর্মীর কাছে একটা বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন, ‘আমি পারলে আপনারাও পারেন।’

এরপর কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘কোনোভাবেই কোনো সিন্ডিকেট ধান গুদামে দিতে পারবে না। বেশিসংখ্যক কৃষক যাতে ধান বিক্রি করতে পারেন, সে জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে কমপক্ষে ৪০ জন কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা হবে।’ সেখানকার সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘গ্রামে গিয়ে প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা হচ্ছে, যাতে করে কৃষকেরা প্রকৃত দাম পান। সরাসরি কৃষকদের তালিকা করে দেওয়া হয়েছে। একজন কৃষক কমপক্ষে আধা টন ধান সরকারকে দিতে পারবেন।’ এই জেলায় থেকে ১ হাজার মেট্রিক টনের বেশি ধান কেনা হবে। সদর উপজেলা থেকে কেনা হবে প্রায় ৩০০ মেট্রিক টন।

প্রশাসন যদি মন থেকে চায় আর পদে থাকা মানুষগুলো যদি একবার ভাবেন, কাদের রক্ত ঘাম করা পরিশ্রমের খাজনার টাকায় আজ তাঁদের কুরসিতে বসা, তাহলে এখনো আমাদের সম্ভাবনা আছে। শুধু নিজের দায়িত্বটা পালন করার জন্য মাঝেমধ্যে চেয়ার ছেড়ে ঘরের বাইরে এলেই চলবে। না হয় কৃষক পিতাদের কথা ভেবে শুধু ধান কেনার কয়েক সপ্তাহের দৈনন্দিন কাজকর্ম একটু অন্য নিয়মে করলাম। যেমন শিখিয়েছিলেন এ দেশে পল্লি উন্নয়নের পথিকৃৎ কুমিল্লার বার্ডের প্রতিষ্ঠাতা আখতার হামিদ খান।

খবর আসছে চুয়াডাঙ্গা থেকেও। সেখানকার জেলা প্রশাসকেরা প্রকৃত উৎপাদক কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে দলবল নিয়ে মাঠে নেমেছেন। সরকার নির্ধারিত মণপ্রতি ১ হাজার ৪০ টাকা দরে ধান কিনেছেন তাঁরা। গতকাল (২১ মে) পর্যন্ত নাটোরে জেলা প্রশাসক কিনেছেন ১৬ মেট্রিক টন ধান—এটা ইউএনও জেসমিন বানুর কেনা ধানের অতিরিক্ত। চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় দরিদ্র কৃষকদের সঙ্গে ধান কাটা-মাড়াইয়ের কাজ করে জেলা প্রশাসক পরে ওই এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত দামে ধান কিনে নিয়েছেন। কৃষকেরা আশা করছেন, ক্যামেরা চলে গেলও সারা দেশে সরাসরি ধান কেনার এ ধরনের উদ্যোগ চালু থাকবে। দেশে ধান কেনার পরিমাণ বাড়াতে হবে। চাল আমদানি এখনই বন্ধ করতে হবে। ধান-চালের মানসম্মত সংরক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে, যাতে পরে কৃষকদের খারাপ ধান সরবরাহের দোষে দোষী করার পথ বন্ধ হয়। আর চোর-চৌকিদারদের লাল ঘরে পাঠাতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকর্মী ও গবেষক।
nayeem5508@gmail.com