Thank you for trying Sticky AMP!!

সমাজতন্ত্রে সমাজ ও ব্যক্তির দ্বন্দ্ব নিয়ে বিতর্ক

আমার সমাজতন্ত্র শিরোনামে সুগভীর বিশ্লেষণমূলক গ্রন্থ রচনার জন্য অধ্যাপক আজিজুর রহমান খানকে সশ্রদ্ধ সাধুবাদ। প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ প্রকাশিত হয়েছে ভাষা আন্দোলনের মাসে, গত ফেব্রুয়ারিতে। এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের পাঠক সমাজে সমাজতন্ত্র এখনো একটি গভীর আগ্রহের বিষয়।

নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘তুমি যদি কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলো যে ভাষা সে বোঝে, তাহলে সেটা তার মাথায় প্রবেশ করে; আর তুমি যদি কারও মাতৃভাষায় কথা বলতে পারো, তাহলে সেটা তার হৃদয়ে পৌঁছায়।’ আজিজুর রহমান খান আমাদের মাতৃভাষাতেই জ্ঞানগর্ভ বইটি লিখেছেন। এ জন্য তাঁর বাণী অনায়াসে আমাদের হৃদয় অবধি পৌঁছায়।

সমাজতন্ত্রের মতো এত বড় একটা বিষয়, যা সারা বিশ্বকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল, মাত্র ১৫৯ পৃষ্ঠার একটি বইয়ে ১০০ বছরের সেই ইতিহাস সুনিপুণভাবে গ্রন্থিত করেছেন তিনি। এই বইয়ে তিনি খুবই কম ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন এবং বাংলায় অনেক নতুন পরিভাষাও উপহার দিয়েছেন। লেখক বইটির বিভিন্ন জায়গায় রবীন্দ্রনাথ থেকে অনেক উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এ থেকে বোঝা যায়, তিনি গভীরভাবে রবীন্দ্রনাথ অধ্যয়ন করেছেন, রবীন্দ্রনাথের গান শুনেছেন। লেখকের ভাষা সুন্দর ও সাবলীল।

মার্ক্স তাঁর বিখ্যাত বই জার্মান ইডিওলজিতে আশা প্রকাশ করেছেন, ‘ভবিষ্যতের সমাজে একই মানুষ দিনের এক সময়ে পশুশিকারি, অন্য সময়ে মত্স্যজীবী এবং আরেক সময়ে শিল্পসমালোচক হতে পারবে।’ মার্ক্সের এই স্বপ্ন সমাজ ও রাষ্ট্রে বাস্তবায়ন সম্ভব কি না, লেখক সেই আলোচনা করেছেন। সমাজের স্বার্থ ও ব্যক্তির বিকাশের মধ্যে যে বিরোধ রয়েছে, তা সম্পর্কে আজিজুর রহমান খান তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘মার্ক্সের তত্ত্বে সমাজের স্বার্থ ও ব্যক্তির বিকাশের মধ্যে বিরোধের সম্ভাবনা স্বীকার করা হয়নি। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তির ওপর সমষ্টির স্বৈরশাসন অনিবার্য, যার ফলে ব্যক্তির অন্তঃস্থিত ক্ষমতার প্রকাশ অসম্ভব। ব্যক্তির স্বাধীনতা এই ব্যবস্থায় সর্বতোভাবে সীমাবদ্ধ হয়েছে, চিন্তার স্বাধীনতার অভাবে ব্যক্তির সৃষ্টিশীলতা খর্ব হয়েছে।’

রুশ বিপ্লবের নেতা লেনিন ‘বৃহত্তর গণতন্ত্র’–এর কথা বলে সর্বজনীন ভোটাধিকার ও তার ভিত্তিতে নির্বাচনকে ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্র’ বলে উপহাস ও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু সেই বৃহত্তর গণতন্ত্র লেনিন কিংবা তাঁর উত্তরসূরিরা দেখিয়ে যেতে পারেননি। বরং লেনিন এমন একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। এই বইয়ে লেখক বলেছেন, লেনিন যে বিপ্লব করেছিলেন, সেখানে বৃহত্তর রাশিয়ার জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না। রুশ সামরিক বাহিনীর তিরিশ হাজার সেনার সমর্থন নিয়ে তিনি জারতন্ত্রকে উৎখাত করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফলে বিপ্লবের যে অবজেক্টিভ কন্ডিশনের কথা কার্ল মার্ক্স বলেছিলেন, তার প্রতিফলন লেনিনের রুশ বিপ্লবে দেখা যায়নি। রাশিয়ার বিপ্লব একটা মিথ হয়ে আছে, আসলে সেখানে রাশিয়ার আপামর জনসাধারণের তেমন কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। বিপ্লবের আগের রাশিয়া ও বিপ্লবের পরের রাশিয়ার তুলনা করলে আমরা দেখব, ব্যক্তির বিকাশ, সৃষ্টিশীলতা ও স্বাতন্ত্র্য, ব্যক্তির অধিকার বিপ্লব-উত্তর রাশিয়ায় প্রবলভাবে মার খেয়েছে।

বিপ্লবের আগে রাশিয়া শিল্প-সাহিত্যে পৃথিবীর অন্যতম সেরা দেশ। তলস্তয়, দস্তয়েভস্কি, গোর্কি, পুশকিন, আন্তন চেখভ, ইভান তুর্গেনিভ, নিকোলাই গোগল—এঁরা সবাই বিপ্লব–পূর্ব রাশিয়ার ফসল। কিংবা বিপ্লবের সময়ের কথা যদি বলি, আলেক্সান্দর ব্লক, নিকোলাই গুমিলিওভ, আন্না আখমাতোভা প্রমুখ কবি তখন তাঁদের সৃষ্টিশীলতার শিখরে। সের্গেই ইয়েসেনিন ও মায়াকোভস্কি উদীয়মান কবি। ভাসিলি কান্দিনস্কি, মার্ক শাগাল ও কাজিমির মালেভিচ চিত্রশিল্পে অভিনব আন্দোলন সৃষ্টি করছেন। সের্গেই দিয়াজিলেভের ব্যালে নৃত্যের দল ইউরোপকে বিমুগ্ধ করছে। সংগীতে সের্গেই রাখমানিনোভ, ইগর স্ত্রাভিনস্কিরা বৈপ্লবিক ধারা প্রবর্তন করছেন। কিন্তু বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এই সৃষ্টিশীলতা মুখ থুবড়ে পড়ে, যা ছিল মর্মান্তিক। শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকদের ওপর বিপর্যয় নেমে এসেছিল বিপ্লব-উত্তর রাশিয়ায়। বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি না পাওয়া ব্লকের মৃত্যু হয় ১৯২১ সালে। ১৯২২ সালে আখমোতভার রচনা নিষিদ্ধ হয়। ১৯২৫ সালে ইয়েসেনিনের আত্মহত্যা বা মতান্তরে পুলিশ কর্তৃক গুপ্তহত্যা। ১৯৩০ সালে মায়াকোভস্কির আত্মহত্যা। কারাবাস ও পদচ্যুতির পর ১৯৩৫ সালে মালেভিচের মৃত্যু রাশিয়ার শিল্প-আন্দোলনের এক করুণ অধ্যায় হয়ে আমাদের দিকে বিশাল প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি থেকে এ প্রসঙ্গে চমৎকার উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখ করতে পারি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সমষ্টির কারণে ব্যষ্টির অত্যাচার। ছাঁচে-ঢালা মনুষ্যত্ব কখনোই টেকে না। সজীব মনের তত্ত্বের সঙ্গে বিদ্যার তত্ত্ব যদি না মেলে, তাহলে হয় একদিন ছাঁচই ফেটে চুরমার হবে, নয় মানুষের মন যাবে মরে, আড়ষ্ট হয়ে, কিংবা কলের পুতুল হয়ে দাঁড়াবে’ (রাশিয়ার চিঠি, পৃষ্ঠা-৪)। ১৯৩০ সালে রাশিয়া ভ্রমণের পর রবীন্দ্রনাথের এই দার্শনিক উপলব্ধি সত্যিই বিস্ময়কর। কিন্তু বিপ্লব-উত্তর রাশিয়া অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিশ্বজুড়ে যে প্রভাব তৈরি করতে পেরেছিল, রুশ বিপ্লবের প্রভাব যেভাবে দুনিয়ার এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল, সেটাও বিস্ময়কর। রাশিয়ার বিপ্লব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বইয়ের লেখক আজিজুর রহমান খান বিখ্যাত ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ এরিক হবসবমের একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। ‘বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিমান যে সামরিক যন্ত্র জারশাসিত রাশিয়াকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছিল, তাকে পরাজিত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ থেকে বিশ্বের দুটি পরাশক্তির একটি হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীতে তুলনায় শ্লথ ও সীমাবদ্ধ, ইসলামের বিজয় ছাড়া এই মতাদর্শের জয়যাত্রার আর কোনো তুলনা নেই।’ (পৃষ্ঠা-৭৩)

বাংলাদেশেও সমাজতন্ত্র একসময় প্রবল আলোড়ন তুলেছিল, তাই এখানেও সমাজতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সৃষ্টিশীলতার বিতর্ক নিয়ে আলোচনা জরুরি। আর জরুরি এ আলোচনায় অধ্যাপক আজিজুর রহমান খানের বইটি অবশ্যপাঠ্য হয়ে উঠতে পারে।

রোবায়েত ফেরদৌস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক

robaet.ferdous@gmail.com