Thank you for trying Sticky AMP!!

সরকারের এক বছর পূর্তিতে কিছু কথা

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ৭ জানুয়ারি ২০১৯ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা তিনবারের মতো সরকার গঠন করেন, তবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি চারবার। আর কোনো বাঙালি চারবার প্রধানমন্ত্রিত্ব করার সৌভাগ্য অর্জন করেননি। জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর প্রায় ৪০ বছরের। তবে রাজনীতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শৈশব থেকে। শিক্ষাজীবনেও তিনি ছাত্ররাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। শেখ হাসিনা বর্তমান সময়ের পৃথিবীর সবচেয়ে অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের একজন। তাই ৭ জানুয়ারি তিনি যে সরকার গঠন করেন, তা নতুন বটে, কিন্তু সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি নতুন নন। তাঁর বর্তমান মন্ত্রিসভার অনেকেই নতুন। তাঁর মতো অভিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভার এক বছরের কর্মকাণ্ড মূল্যায়নের দাবি রাখে।

সরকারি দলের নেতারাও জানেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও ত্রুটিমুক্ত হয়নি। কিন্তু তা অতীতের অন্যান্য নির্বাচনের মতো সংঘাতপূর্ণও হয়নি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসে ওই নির্বাচন ছিল পরম শান্তিপূর্ণ। ভোটারদের দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটেনি। সন্ধ্যারাতে বিরোধী দলের প্রার্থীরা থোঁতা মুখ ভোঁতা করে টিভি সেটের সামনে বসে কপাল চাপড়ালেন। তাঁদের মধ্যে যাঁদের চোখে ভাসছিল ডিউটি ফ্রি সর্বশেষ মডেলের গাড়ি, রাজউকের প্লট প্রভৃতি, তা ঝাপসা হয়ে গেল। যাঁরা নতুন স্যুট বানাতে দিয়েছিলেন, এক বছরের মধ্যেও তাঁরা তা ডেলিভারি নিয়েছেন বলে মনে হয় না।

যাঁরা বিজয়ী হয়েছেন, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের চেয়ে তাঁরাই ভালো জানেন কার কল্যাণে তাঁরা এমপি। নির্বাচনের পরবর্তী এক সপ্তাহ আমাদের বড় কাগজগুলো শিরোনাম করতে থাকল: মন্ত্রিসভা গঠনে চমক আসছে। বর্তমানে ‘চমক’ শব্দটি আমাদের সাংবাদিকদের খুবই প্রিয়। চমক শব্দটার মানে হঠাৎ আতঙ্কও হতে পারে, বিস্ময়করও হতে পারে। যাঁদের মন্ত্রিত্বপ্রাপ্তির দূরতম সম্ভাবনা ছিল, তাঁরা গোঁফে তা দিলেন এবং আভাসে-ইঙ্গিতে রটাতে লাগলেন, তাঁরা এবার ‘হচ্ছেন’। পত্রিকার প্রতিবেদনে নামও উঠল কারও কারও। আত্মীয়স্বজন, বিশেষ করে শ্বশুরবাড়ির লোকদের কাছে মর্যাদা বাড়ল। অনেকের সাংবাদিকদের জল্পনার কারণে বিনিদ্র রাতও কাটল। তারপর গঠিত হলো ৪৭ সদস্যের মন্ত্রিসভা। তাতে চমকের কিছু দেখা গেল না। পুরোনো-নতুন মিশেল। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী ৩১ জন নতুন।

প্রথমবার মন্ত্রী হওয়াতে চমৎকারিত্বের কিছু নেই, বিস্ময়ের ব্যাপার তো নয়ই। যাঁরা জীবনে একাধিকবার মন্ত্রী হয়েছেন, তাঁদের অবধারিতভাবে প্রথমবার হতেই হয়েছে। তা হয়েছেন এ কে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী, তাজউদ্দীন। রেকর্ডপত্র থেকে যা দেখা যায়, প্রথমবার মন্ত্রী হয়েই তাঁরা দেশের কল্যাণে কাজ করেছেন। দলের জন্য এবং দেশের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। তাঁদের কারও ব্যক্তিগত ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানা ছিল না। দুটো অফিস ছিল না: একটি নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং দ্বিতীয়টি মন্ত্রণালয়।

ব্যক্তিগতভাবে আমি যেটুকু জানি তা হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু নিজের দলের নন, বিভিন্ন দলের নেতা, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, এনজিও মালিক, নাগরিক সমাজের লোকজন, বুদ্ধিজীবী-সুবিধাবাদী হোন, আধা সুবিধাবাদী হোন বা সুবিধাবঞ্চিত হোন—ব্যবসায়ী নেতা, সবারই স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে অবগত। তার ফলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের পরামর্শের বাইরে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। রাষ্ট্র চালাতে হলে দক্ষ, আধা দক্ষ কিন্তু বিশ্বস্ত সবাইকে নিয়েই চলতে হয়। তবে দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রত্যেকেরই কর্তব্য পদের মর্যাদা রক্ষা করা। পদকে নিজের ও পরিবার-পরিজনের ভাগ্য গড়ার উপায় করা অনৈতিক।

কীভাবে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন, সেটা এক জিনিস, কিন্তু দায়িত্ব পাওয়ার পর কী কাজ করলেন, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। নতুন মন্ত্রিসভার কেউ কেউ আন্তরিকতার সঙ্গে যথাসাধ্য দায়িত্ব পালন করলেও অনেকেই অনুধাবন করতে পারেননি তাঁদের পদটির গুরুত্ব। কোনো ক্ষেত্রেই সবার যোগ্যতা সমান হবে না। যোগ্যতা-দক্ষতার চেয়ে আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার মূল্য বেশি। মন্ত্রীই যদি ১০টা-৫টা অফিস না করেন, কর্মকর্তারা ঢিলেমি করলে তাঁদের দোষারোপ করার নৈতিক অধিকার থাকে না। স্বাধীনতার পর কয়েক বছর আমরা বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে কাজ করে দেখেছি, তাঁরা সচিবালয়ে অফিসের সময়ের পরও কাজ করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় অফিস করেন, কোনো অনুষ্ঠানে এক মিনিট দেরিতে যান না। কিন্তু তাঁর বর্তমান মন্ত্রিসভার অনেকেই সারা দিনে কতটুকু সময় অফিসে থাকেন, তা তাঁদের অফিসে খোঁজ নিলেই জানা যাবে।

আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর উদ্‌যাপিত হবে। তার প্রস্তুতির জন্য বিগত বছর এবং বর্তমান বছরটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান মন্ত্রিসভার ঘাড়ে বিরাট দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে সরকারের এবং দলের নেতারা যদি প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিকতার সঙ্গে সহযোগিতা না করেন, তাহলে উপলক্ষটি যথাযথ মর্যাদায় উদ্‌যাপিত হবে না।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা ‘অর্জন’ করবে। সেটা কম বড় গৌরবের কথা নয়। আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির কোনো বিকল্প নেই। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো মেগা প্রকল্পের কাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। কিন্তু সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ। রেলে অর্থ বরাদ্দ বাড়ছে, কিন্তু দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় সেখানে কোনো উন্নতি নেই।

উপযুক্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রস্তুতিমূলক কাজ না করে মন্ত্রীদের অনেকেই অনেক রকম আশাব্যঞ্জক কথা বলেন, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। দায়িত্ব নিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ব্যাংকিং খাতের উন্নতির জন্য তিনি ‘কিছু পদ্ধতি’ গ্রহণ করবেন। তার ফলে আশা করা গিয়েছিল খেলাপি ঋণের প্রবণতা কিছুটা হলেও কমবে। কিন্তু পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা যায় কমেনি, বরং বাড়ছেই। তিনি বললেন, ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ হালনাগাদ করা যাবে।

যাঁরা সৎ ও স্বচ্ছ ব্যবসায়ী, তাঁদের জন্য কোনো প্রণোদনা নেই। অর্থমন্ত্রী দয়াপরবশ হয়ে বলেছিলেন, ‘কোনো খেলাপি ঋণগ্রহীতা জেলে যাবে না।’ দেশের অর্থনীতির সব দায়দায়িত্ব একা অর্থমন্ত্রী কাঁধে নিলে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাজউদ্দীন আহমদকে তিন বছর দেখেছি, অফিসের পর বাড়িতে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন। বাংলাদেশের খ্যাতিমান অর্থমন্ত্রীদের কেউই ব্যবসায়ী ছিলেন না, সে জন্য নষ্ট ব্যবসায়ীদের জন্য তাঁদের বিশেষ দরদ ছিল না। ভালো ঋণগ্রহীতারা ১৩-১৪ শতাংশ হারে সুদ গুনবেন, আর মন্দদের সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। কী করে বাংলাদেশে মানুষ ভালো থাকবেন?

পেঁয়াজের ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের অকল্পনীয় সাফল্যে লবণ ব্যবসায়ীরা মালকোচা মেরে তৈরি হয়ে ছিলেন। মিডিয়ার চেঁচামেচির কারণে তাঁরা পিছিয়ে যান। কিন্তু অন্যান্য পণ্যের ব্যবসায়ীদের যে প্রস্তুতি নেই, তা বলা যাবে না। কিন্তু তাঁদের কুমতলব প্রতিহত করার প্রস্তুতি সরকারের আছে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই।

ক্যাসিনো অনেক দিনের পুরোনো মামলা, হঠাৎ তার বিস্ফোরণ ঘটে। যুবলীগের সম্মেলনের আগে হয়তো তার প্রয়োজন ছিল। অপকর্ম, জুয়া, দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার আরও শক্ত অবস্থান নেবে, জনগণের সেটাই প্রত্যাশা।

বুয়েটের আবরার হত্যাকাণ্ডের মর্মন্তুদ ঘটনাটি যদি না ঘটত, তাহলে বুয়েট ও অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র মানুষের অনেকটাই অজানা থাকত। ছাত্রসংগঠনের নেতাদের দৌরাত্ম্য না থামাতে পারলে স্থিতিশীল সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইসলামি জঙ্গিদের দমন করে সফল হয়েছে, ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের গায়ে তারা হাত দেবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সরকারি দলের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশ না পায়।

একটি শক্তিশালী বিরোধী দল সংসদে থাকলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি মজবুত হতো এবং সরকারও উপকৃত হতো। যেহেতু তা নেই, তাই সরকার কোনো চাপেও নেই। আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে পুরোনো শুধু নয়, বৃহত্তম দল। এই দলে ত্যাগী ও বিজ্ঞ নেতা রয়েছেন বহু। বিরোধী দলের অনুপস্থিতির শূন্যতার মধ্যে তাঁরা দেশের স্বার্থে ও জনগণের কল্যাণে ভূমিকা রাখতে পারেন। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের সেটাই প্রত্যাশা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক