Thank you for trying Sticky AMP!!

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আকাশ থেকে পড়বে না

দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর হামলার ঘটনায় শাহবাগে প্রতিবাদ

কয়েক দিন ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির-বাড়িঘরে হামলা-অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর আমাদের লেখায়, সংবাদমাধ্যমের খবর পরিবেশনায় ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি বারবার ব্যবহার করায় অনেক বন্ধু বা পাঠক আপত্তি জানিয়ে লিখেছেন, ‘আমরাও এ দেশের নাগরিক। আমরা সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু অভিধায় চিহ্নিত হতে চাই না।’ তঁাদের আবেগ-অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, আমরা সবচেয়ে খুশি হতাম সংখ্যালঘু শব্দটি ব্যবহার করতে না পারলে। কিন্তু আক্রান্ত জনগোষ্ঠীকে আলাদাভাবে শনাক্ত করতে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে মার্জিত ও নিরীহ শব্দ। অন্য যেকোনো শব্দ ব্যবহার করলে ধর্মীয় বিভাজনটি আরও বেশি ক্লেদাক্ত হয়ে সামনে আসে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর প্রশ্নটি আসেনি। এ দেশের মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, বাঙালি, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে যার যার অবস্থান থেকে, যার হাতে যা আছে তা-ই নিয়ে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। সেটা ছিল গণযুদ্ধ। ফলে সে সময়ে কেউ প্রশ্ন করেননি, ‘আপনি কোন ধর্মের বা সম্প্রদায়ের মানুষ?’ কেউ জানতে চাননি, ‘আপনি কোন দল করেন?’ তখন সবার একটিই দল ছিল, যার নাম বাংলাদেশ।

কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় স্বাধীনতার পর আমরা সেই ঐক্য ধরে রাখতে পারিনি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সংকীর্ণ দলীয় ও গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল। যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল, সেই আওয়ামী লীগও এক বছরের মাথায় বিভক্ত হয়ে পড়ল—দলের, বিশেষ করে ছাত্রসংগঠনের গরিষ্ঠ অংশ আওয়ামী লীগের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে নতুন দল গঠন করল। সেই দল করা সঠিক না বেঠিক ছিল, সেই বিতর্কে যেতে চাই না। কিন্তু ইতিহাসের সত্য হলো মুক্তিযোদ্ধারা এক থাকতে পারেননি। যেসব বাম দল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের একাংশ সবকিছুতে সরকারকে সমর্থনের নীতি নিল, যা দেশের জন্য মোটেই ভালো হয়নি। আরেক অংশ সরকার উৎখাতের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে দিল। দেশব্যাপী তৈরি হলো অস্থিরতা, বিশৃঙ্খলা। সেই সঙ্গে বিদেশি চক্রান্ত তো ছিলই। এই প্রেক্ষাপটে স্বাধীনতার পৌনে চার বছরের মাথায় এক দল দুর্বৃত্তের হাতে সপরিবার বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতিই পাল্টে দেওয়া হয়; বিশেষ করে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে সংখ্যালঘুদের ‘অপর’ করে দেওয়া হয়। মূলত সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সমস্যাটি তখন থেকেই প্রকট হয়। যদিও এ দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মনোজগতে যে পাকিস্তানি ধারা জেঁকে বসেছিল, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ তা ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।

পাঠকদের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে বলব, স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু, বাঙালি-অবাঙালি বিভাজন কোনোভাবে কাম্য নয়। তবে বাংলাদেশের এখন যে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, তাতে সংখ্যালঘু শব্দটিই অপেক্ষাকৃত সহিষ্ণু ও নিরাপদ বলে মনে করি।

আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দল, সারা দেশে যার বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী আছেন, নানা নামে ও ব্যানারে সমর্থক গোষ্ঠী আছে, সেই দলকে সম্প্রীতির সমাবেশ করতে পাঁচ দিন অপেক্ষা করতে হলো। ঘটনার পরপরই এ রকম সমাবেশ করতে পারলে, প্রশাসন ত্বরিত ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি আগেই নিয়ন্ত্রণে আনা যেত, ক্ষয়ক্ষতি কমানো যেত।

২.

কুমিল্লায় সংখ্যালঘুদের মন্দির ও পূজামণ্ডপে হামলার পাঁচ দিন পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়ে সারা দেশে ‘সম্প্রীতির সমাবেশ ও শান্তির শোভাযাত্রা’ করেছে। ঢাকায় আয়োজিত সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িক শক্তির বিষদাঁত ভেঙে না দেওয়া পর্যন্ত তাঁরা রাজপথে থাকবেন।’ আওয়ামী লীগ একটানা ১২ বছর ক্ষমতায়। তারপরও সাম্প্রদায়িক শক্তি বিষদাঁত দেখানোর সাহস কীভাবে পায়? তাহলে কি শর্ষের ভেতরেই ভূত আছে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার আওয়াজ কি শুধুই লোকদেখানো?

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে যেসব কথা বলেছেন, তাতে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ক্ষোভ, বেদনা ও বঞ্চনার কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তিনি বলেছেন, রাজনীতি ও রাজনীতিকদের প্রতি সংখ্যালঘুদের আস্থা নেই। তাঁরা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। নির্বাচনের আগে রাজনীতিকেরা বড় বড় কথা বলেন, কিন্তু নির্বাচনের পর মনে রাখেন না। এই রাজনীতিক বলতে নিশ্চয়ই রানা দাশগুপ্ত কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে বোঝাননি; বুঝিয়েছেন যাঁরা সংখ্যালঘুদের নিজেদের ভোটব্যাংক মনে করেন। আওয়ামী লীগ সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য কিছুই করেননি, সে কথাও আমরা বলছি না। প্রশাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে সংখ্যালঘুরা আছেন; যা অতীতে কল্পনাও করা যেত না। কিন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়া সরকারের আমলে সংখ্যালঘুদের যে বিচ্ছেদ তৈরি হয়েছিল, তা কমবেশি এখনো আছে। যেকোনো জাতীয় দুর্যোগে সংখ্যালঘুরা প্রথম আক্রমণের শিকার হয়।

আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দল, সারা দেশে যার বিপুলসংখ্যক নেতা-কর্মী আছেন, নানা নামে ও ব্যানারে সমর্থক গোষ্ঠী আছে, সেই দলকে সম্প্রীতির সমাবেশ করতে পাঁচ দিন অপেক্ষা করতে হলো। ঘটনার পরপরই এ রকম সমাবেশ করতে পারলে, প্রশাসন ত্বরিত ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি আগেই নিয়ন্ত্রণে আনা যেত, ক্ষয়ক্ষতি কমানো যেত। বিশেষ করে কুমিল্লার ঘটনা যে বিপজ্জনক মোড় নিল, তার পেছনে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নিষ্ক্রিয়তাই মূলত দায়ী। তাঁরা প্রতিটি মণ্ডপে পুলিশ পাঠিয়েছেন আক্রমণ হওয়ার পর। নোয়াখালীতে তিন ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চলেছে, অথচ সেখানকার প্রশাসন কিংবা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ঘটনাস্থলে যাননি। আওয়ামী লীগের নেতাদের দাবি অনুযায়ী, বিরোধী দল ও সাম্প্রদায়িক শক্তি ষড়যন্ত্র করছে, সেই খবর নাকি তাদের কাছে আগেই ছিল। সে ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় সরকার কী আগাম পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানার অধিকার নিশ্চয়ই জনগণের আছে।

আরেকটি বিষয় হলো শান্তি বা সম্প্রীতি বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। এটি হলো শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। একটি সমাজ কীভাবে গড়ে তোলা হবে, সম্প্রীতি না সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হবে, তা অনেকটা নির্ভর করে ক্ষমতাচর্চার ওপর। অনেকে ধর্মীয় নেতাদের হেট স্পিচ বা বিদ্বেষমূলক প্রচারণা বন্ধ করার দাবি করেছেন। তাঁদের এই দাবি যৌক্তিক। সেই সঙ্গে রাজনীতির মাঠে হররোজ কারা কী ধরনের বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি কী ভাষা ব্যবহার করছেন, সেটাও আমলে নেওয়া প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আকাশ থেকে পড়ে না। মাটি থেকেও জন্মায় না। সম্প্রীতি হলো দীর্ঘ অনুশীলনের বিষয়। রাজনীতির মাঠে হিংসা জিইয়ে রেখে দেশে শান্তি ও সহিষ্ণুতা আশা করা যায় না।

৩.

বিভিন্ন স্থানে যখন একের পর এক সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছিল, তখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রায় নিশ্চুপ ছিল। নাগরিক সমাজকেও তেমন উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায়নি। কিন্তু ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর এখন বিভিন্ন স্থানে প্রতিবাদ-সমাবেশ হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে নেমেছে। নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো সরব হয়ে উঠেছে। সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে, ওয়েবিনারে অনেকে জ্বালাময়ী বক্তব্য দিচ্ছেন। কিন্তু এতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আদৌ অভয় পাবে কি? ভবিষ্যতে আর হামলা হবে না, এই নিশ্চয়তা রাষ্ট্র দিতে পারবে কি? ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমরা সবাই কথা বলছি, লিখছি। এসব হচ্ছে প্রতারক মানসিকতার প্রকাশ।

ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা প্রায়ই বলেন, একাত্তরের চেতনায় দেশ গড়ে তুলতে হবে। একাত্তরের চেতনা কী ছিল? একাত্তরের চেতনা ছিল মানবিক মর্যাদাশীল একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যেখানে গণতন্ত্র থাকবে, ন্যায়বিচার থাকবে, পরমতসহিষ্ণুতা থাকবে। একাত্তরের চেতনা ছিল মানুষে মানুষে বৈষম্যের বিলোপ। কিন্তু আজ সমাজ ও রাজনীতির প্রতিটি ক্ষেত্রে এর বিপরীত অবস্থা দেখতে পাচ্ছি। সংবিধানে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলা হচ্ছে, অথচ আজ সেই জনগণ সবচেয়ে উপেক্ষিত। এখন রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে জনগণের কোনো ভূমিকা নেই। বরং ক্ষমতা ঠিক করে দেয় জনগণ কী বলতে পারবে, কী বলতে পারবে না; কী করতে পারবে, কী করতে পারবে না।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com