Thank you for trying Sticky AMP!!

সার্জিক্যাল স্ট্রাইক সমাধান সূত্র নয়

ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে কিছু বোমা ফেলেছে

অবিতর্কিত বিষয়টি হলো, ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে কিছু বোমা ফেলেছে। শুধু এইটুকু অবিতর্কিত, কারণ, পুলওয়ামা–কাণ্ডের ঠিক ১২ দিনের মাথায় ভারতীয় বিমান সেনার নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘনের বিষয়টি পাকিস্তানের সেনা ও সরকার সঙ্গে সঙ্গেই স্বীকার করেছে। দুই বছর আগে কাশ্মীরের উরি সেক্টরে প্রথম সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সময় পাকিস্তান যা করেনি। বিপুল ক্ষয়ক্ষতির ভারতীয় দাবিকে তারা আজগুবি বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। এবার স্বীকার তো করেইছে, এ কথাও জানিয়েছে, এর জবাবও তারা ঠিক সময়ে দেবে।

যে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয় তা হলো, বালাকোটে জইশ-ই-মুহাম্মদের ঘাঁটিতে ভারতীয় বিমান সেনারা ঠিকঠাক আঘাত হানতে পেরেছে কি না, সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলো গুঁড়িয়ে দিতে পেরেছে কি না, জঙ্গিদের নিকেশ করা গেছে কি না। নিশ্চিত নয় কারণ, ২৪ ঘণ্টা কেটে গেলেও ক্ষয়ক্ষতির কোনো প্রমাণ ভারত দিতে পারেনি। পাকিস্তানে যে ছবি প্রকাশিত, তা গাছগাছালিতে ঘেরা একটা ফাঁকা জায়গা। বিবিসির প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ বলছে, এই হামলায় আহত মাত্র একজন।

ভারতের কেউ অবশ্য প্রমাণের দাবিতে সরব নয়। প্রথম সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পর সেই দাবি তোলায় বিরোধীদের বেশ চাপে পড়তে হয়েছিল। এবার বরং খবর আসামাত্র সবাই ভারতীয় বিমানবাহিনীকে শাবাশ জানিয়েছে। স্যালুট করেছে। পুলওয়ামার ঘা এখনো টাটকা। সেটা একটা কারণ অবশ্যই। কিন্তু এই আচরণের বড় কারণ, ঘাড়ের কাছে এসে পড়া লোকসভার ভোট। ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণ দাবি করে কেইবা বাড়া ভাতে ছাই ফেলতে চাইবে?

গোটা দেশ এখন আত্মগরিমায় টগবগ করে ফুটছে। মনে হচ্ছে, এতদিনকার সব গ্লানি যেন এক লহমায় ঘুচে গেল। শাসক দলের উল্লাস সবচেয়ে বেশি। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পরেই রাজস্থানের চুরু জেলায় এক দলীয় সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘আপনাদের একটি ভোটের শক্তি ২০১৪ সালে দিল্লিতে মজবুত সরকার গড়েছে। আপনাদের মজবুত ভোটের দম গোটা দুনিয়া দেখছে। আপনাদের ভোট মজবুর ও দুর্বল সরকারের স্বপ্ন দেখা লোকেদের জবাব দেবে। আমার বিশ্বাস, আমাকে আর বিজেপিকে আগের চেয়ে বেশি শক্তি দেবে।’ বোঝাই যাচ্ছে, পুলওয়ামা–কাণ্ড ও তার জুতসই জবাব ভোট-বাজারে শাসক দলের বড় হাতিয়ার হতে চলেছে। না-ই যদি হবে, প্রধানমন্ত্রীর মঞ্চ কেন পুলওয়ামার শহীদদের ছবি দিয়ে সাজানো হবে? এতে লাভের লাভ কতটা হবে, সেই বিতর্কে এখনই না ঢোকা ভালো। এটুকু বলা যায়, এই ধরনের আবেগ ও গরিমা ভোট জিততে কাজে আসে। হাতে গরম উদাহরণ ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ। অনাস্থা ভোটে অটল বিহারি বাজপেয়ির সরকার পড়ে গেল। শুরু হলো কারগিলের যুদ্ধ। ভোট পেছাল চার মাস। ফের জিতে সরকারে এল বিজেপি। সেই প্রথম পুরো পাঁচ বছরের সরকার।

উরি প্রত্যাঘাতের পর পাকিস্তানের মাটিতে সন্ত্রাসীদের রমরমা বিন্দুমাত্র কমেনি। গত দুই বছরে কাশ্মীরে অগুনতি হামলা তার প্রমাণ। সবচেয়ে বড় প্রমাণ পুলওয়ামা। এবারের অভিযানও সীমান্তপারের জঙ্গি তৎপরতা কমাতে পারবে না। ভারতের দাবিমতো জইশ-ই-মুহাম্মদের ঘাঁটি সত্যিই যদি গুঁড়িয়ে গিয়ে থাকে, মাসুদ আজহারের শ্যালকের মৃত্যু সত্যিই যদি হয়, ৩০০–এর বেশি সন্ত্রাসী যদি নিকেশ হয়, জঙ্গিপনায় সাময়িক একটা ধাক্কা তা হলে লাগতে পারে। তবে, এই প্রত্যাঘাতে সন্ত্রাসীদের দাপাদাপি বন্ধ হবে না।

এই সত্যের মতো এটাও সত্যি, সমস্যার সমাধান যুদ্ধ নয়। কিন্তু না হলেও যুদ্ধ যুদ্ধ একটা ভাব রীতিমতো চাগিয়ে উঠেছে। দুই দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘিত হচ্ছে। গুলি করে যুদ্ধবিমান নামিয়ে দেওয়ার দাবি করা হচ্ছে। বিশ্বের বড় শক্তিগুলো দুই দেশকে সামাল দিতে সক্রিয়। না হয়ে উপায়ও নেই। দুই দেশই যে পরমাণু শক্তিধর।

যুদ্ধ সমাধান সূত্র হতে পারে না। কারণ, যুদ্ধ কোনো সমস্যারই সুরাহা করে না, বরং জটিলতর করে তোলে। শান্তি, সুস্থিতি ও রাজনৈতিক স্থিরতার কারণে ভারত আজ বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। অশান্তি, অস্থিরতা ও রাজনৈতিক ডামাডোলের জন্য একই সঙ্গে স্বাধীন হওয়া পাকিস্তান ৪৪তম। আবার, পাকিস্তানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়া বাংলাদেশ ওই শান্তি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যই আগুয়ান। বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তির তালিকায় তার স্থান ৪১তম। যুদ্ধে গেলে পাকিস্তানের তুলনায় ভারতের ক্ষতি হবে বেশি।

কিন্তু সেই ক্ষয়ক্ষতির চেয়েও বড় কথা, দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর। ১৯৯৮ সালে দুই দেশ নিজেদের সেই শক্তি জাহির করলেও পরের বছর কারগিল যুদ্ধ হয়েছিল দখলীকৃত জমি উদ্ধার ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে। সেই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ন্যায়–অন্যায়ের প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুদ্ধ–পরবর্তী এক সাক্ষাৎকারে সেই সময়কার পাকিস্তানি জেনারেল পারভেজ মোশাররফ স্বীকার করেছিলেন, যুদ্ধ চলাকালীন পরমাণু বোমা ফেলার একটা চিন্তা ক্ষণিকের জন্য হলেও তাঁর মাথায় খেলে গিয়েছিল। আশঙ্কিত পশ্চিমা দুনিয়া দুই দেশকেই সংযত করেছিল। এবারও সেই চেষ্টা শুরু হয়েছে। হওয়াই উচিত। কেননা, সেই সময়ের তুলনায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসীদের রমরমা আজ বহু গুণ বেশি। রাষ্ট্রীয় মদদে পালিত ও বিকশিত সন্ত্রাসীরা ইসলামকে ‘সুরক্ষিত’ করতে পৃথিবীর একমাত্র ‘ইসলামি বোমা’র নিয়ন্ত্রণ পেলে ‘চিরশত্রু’ ভারতের ওপর যে তা ব্যবহার করবে না, সেই গ্যারান্টি কারও কাছে নেই। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে টেনশন বাড়লে বাকি বিশ্ব তাই এত ত্রস্ত হয়ে ওঠে।

যুদ্ধ অতএব সমাধান নয়। তা হলে প্রশ্ন, অতঃকিম? পাকিস্তান রাশ টানলে সন্ত্রাসীদের মাজা ভেঙে দেওয়া কোনো ব্যাপারই নয়। সন্ত্রাস দমনে সরকার সদিচ্ছা দেখালে কী হতে পারে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ তার বড় উদাহরণ। সেই উদাহরণ স্থাপনে পাকিস্তান অনিচ্ছুক বলেই ভবিষ্যতেও পাঠানকোট, কালুচক, উরি বা পুলওয়ামার জন্য ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হবে। পাকিস্তানকেও সইতে হবে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নম্বর ওয়ান, টু, থ্রি, ফোরের ঝাপটা। নব্বইয়ের দশক থেকে কাশ্মীরে নিরন্তর যে চোর-পুলিশ খেলা চলছে, আগামী দিনেও সেই খেলা চলবে যদি না সন্ত্রাসীরা বৈষ্ণব হয়ে যায় অথবা পাকিস্তান তার রাষ্ট্রনীতির বদল ঘটায়। সেই চোর-পুলিশ খেলায় কখনো চোর ধরা পড়বে, কখনো রক্তাক্ত হবে পুলিশ।

ভোটের মুখে চটজলদি যা করার, ভারতীয় বিমান সেনা তা করেছে। কিন্তু কাশ্মীরের জনতার সঙ্গ ছাড়া উপত্যকায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই কখনো কার্যকর হতে পারে না। নানা কারণে কাশ্মীরের মানুষ ক্রমেই মুখ ফেরাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ দমনে ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’–এর বহু খেসারতও ভারতকে দিতে হচ্ছে। দমন নীতিতে কাজ হয়নি। হয়ও না। জনতাকে ভরসা দিয়ে, আস্থা অর্জন করে সঙ্গে নেওয়ার উদ্যোগ তাই বন্ধ করা যাবে না।

পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়ানোর চেষ্টায় ভারতের খামতি নেই। চীন ও সৌদি আরবের সাহচর্য এ ক্ষেত্রে জরুরি। সেই নিশ্চয়তা ভারত আজও পায়নি। নিকট ভবিষ্যতে পাবে, এমন ইঙ্গিতও নেই। যদিও বালাকোট হামলার পর চীনের প্রতিক্রিয়া সংযত। নিন্দাসূচক কোনো শব্দ চীন ব্যবহার করেনি।

পাকিস্তানও সন্ত্রাসবাদের বলি। অথচ অভ্যন্তরীণ কারণে সন্ত্রাসীদের মোকাবিলায় শক্তিহীন। পাকিস্তানের নির্বাচিত সরকারকে অবজ্ঞা, উপেক্ষা ও ব্রাত্য রেখে লাভ নেই। দুই দেশের আনুষ্ঠানিক বাক্যালাপ তিন বছর বন্ধ। তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি বরং অবনতি হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকারকে সঙ্গে নিয়ে আন্তর্জাতিক সহায়তা কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাসীদের মোকাবিলার রাস্তায় ভারতের হাঁটা দরকার। কাজটা কঠিন। কিন্তু এর বিকল্পও নেই।

পাকিস্তানকে ভাতে মারতে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় করা ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানি চুক্তি রদ করার একটা আবছা ভাবনা ভারতে ঘুরঘুর করে। দিনকয়েক আগে জলসম্পদমন্ত্রী নিতিন গড়কড়ি তেমন একটা ‘আধা ইঙ্গিত’ দিয়েও রেখেছেন। কিন্তু সেই রাস্তায় ভারতের না হাঁটাই ভালো। মনে রাখা দরকার, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্তের বন্ধু পাকিস্তানকে বাঁচাতে চীন ওই এক ওষুধ প্রয়োগ করলে ভারতেও ত্রাহি ত্রাহি রব উঠবে। তা ছাড়া, ওই সিদ্ধান্ত
ভারতের পূর্ব প্রান্তের প্রতিবেশীর অনুমোদনও পেতে পারে না। একটি–দুটি নয়, মোট ৫৪টি নদী যে ভারতের মাটি পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে! ব্রহ্মপুত্রের উৎসও তো চীন!

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় : প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি