Thank you for trying Sticky AMP!!

সিটি নির্বাচন: মাঠটা থাকবে তো?

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচারকাজ শুরু হয়েছে শুক্রবার। এর আগেও প্রার্থীরা ঘরে চুপচাপ বসে ছিলেন না। তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন ব্যক্তিগত গণসংযোগে আর ঘরোয়া বৈঠকে। এখন পুরোদমে মাঠে নেমে গেছেন। নগরবাসীর প্রতিশ্রুতির বন্যায় ভাসিয়ে নিচ্ছেন। নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা যেসব মধুর কথা বলেন, নির্বাচনের পর তা ভুলে যান।

এই অবস্থাই আমরা দেখে আসছি বহু বছর ধরে। একসময় রীতি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে আওয়ামী লীগের মেয়র হবেন। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপির মেয়র। ঢাকা ও চট্টগ্রামে এই ঐতিহ্যটি দীর্ঘদিন চলছিল। এরপর ঢাকাকে দুই ভাগ করা হলো। প্রশাসক নিয়োগ করা হলো। উদ্দেশ্য ছিল বিরোধী দলের মেয়র যেন আর আসতে না পারেন।


সিটি করপোরেশন নির্বাচন হবে ৩০ জানুয়ারি। ওই দিন হিন্দু সম্প্রদায়ের সরস্বতী পূজা। নির্বাচন কমিশন কেন এ রকম একটি দিন বেছে নিল, বোধগম্য নয়। সরস্বতী পূজা হয়ে থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আবার সেখানেই ভোটের আয়োজন চলে।

সিটি নির্বাচনের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনের মাঠ সমতল নেই বলে অভিযোগ করা হয়েছে। সাধারণত বিরোধী দলই মাঠ অসমতলের অভিযোগ আনে। এবার সরকারি দল থেকেও এসেছে। প্রথম অভিযোগটি এনেছেন দক্ষিণের বিএনপির প্রার্থী ইশরাক হোসেন। তিনি বলেছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। একজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, তাঁর বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা আছে। অতএব জননিরাপত্তার স্বার্থেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগে এই কাউন্সিলর প্রার্থী জামিন পেয়েছেন। তিনি যদি জননিরাপত্তার জন্য এতটাই বিপজ্জনক হয়ে থাকেন, তাহলে আদালত থেকে জামিন পেলেন কীভাবে?

তাই কারও বিরুদ্ধে মামলা দিলেই যদি গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগের কোনো নেতা-কর্মী নির্বাচন করতে পারতেন না। অতীতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলার এন্তার নজির আছে। তবে গায়েবি মামলার নজির সাম্প্রতিক।

সিটি করপোরেশন নির্বাচন প্রচার শুরু হওয়ার আগেই মাঠ সমতল থাকা না–থাকার বিতর্কটি সামনে এনেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার কাছে লেখা এক চিঠিতে বলেছেন, মন্ত্রী-সাংসদেরা সিটি নির্বাচনের প্রচারে অংশ নিলে মাঠ সমতল থাকবে না। ২০১৬ সালের আইনে সিটি নির্বাচনে তাঁদের অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে।

সিইসি কী জবাব দিয়েছেন কিংবা আদৌ জবাব দিয়েছেন কি না, আমাদের জানা নেই। তবে মাহবুব তালুকদারের চিঠির পর উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম দাবি করেছেন, মন্ত্রী–সাংসদদের নির্বাচনী প্রচারকাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সাংসদেরা নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে না পারায় মাঠ অসমতল হয়েছে। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন নির্বাচনী প্রচারে বিএনপির মহাসচিব অংশ নিতে পারলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কেন পারবেন না? কেন আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমদ পারবেন না?

ওবায়দুল কাদেরের প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। এক দলের মহাসচিব নির্বাচনী প্রচারে নামতে পারলে অন্য দলের মহাসচিবকেও নামতে দেওয়া উচিত। এটি যুক্তির কথা।

কিন্তু কেন এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা বা বিধি নিষেধ জারি করা হলো, তা নিশ্চয়ই তাঁর অজানা নয়। মন্ত্রী-সাংসদেরা স্থানীয় সরকারের নির্বাচনী কাজে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে থাকেন। নিষেধাজ্ঞা জারির পরও তাঁরা নিবৃত্ত হয়েছেন বলে সব ক্ষেত্রে দেখা যায় না। বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পরই সেখানে মন্ত্রী ও সাংসদদের উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধনের হিড়িক পড়ে। এ কারণে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে মন্ত্রী-এমপিদের ওপর বিধিনিষেধ জারি হয়। তাঁরা নিজ নিজ এলাকায় ভোট দিতে পারবেন, কিন্তু নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সম্ভবত খেয়াল করেননি যে এখন নির্বাচনী মাঠ সমতল না অসমতল সেই প্রশ্ন কেউ করে না। তাঁরা উদ্বিগ্ন নির্বাচনী মাঠটি নিয়ে। নির্বাচনী মাঠ মানে শুধু প্রচার নয়। নির্বাচনী মাঠ মানে সুষ্ঠু ও অবাধ ভোটাধিকার। বাংলাদেশের মানুষ সুষ্ঠু ভোটের কথা ভুলে যেতে বসেছে। এই সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের তরফে বড় অভিযোগ একটাই, ভোটের অধিকার নেই। প্রধান দাবিও একটাই, ভোটের অধিকার ফেরত চাই। ওবায়দুল কাদের নির্বাচনী মাঠ সমতল রাখার কথা বলেছেন। সেটি শুধু নির্বাচনী প্রচারে কেন, সব ক্ষেত্রেই হওয়া উচিত। আবার বিএনপির নেতারা নির্বাচন এলেই ইভিএম নিয়ে বিতর্ক তোলেন। তাঁদের অভিযোগ, সরকার ইভিএম ব্যবহার করে ভোট কারচুপি করবে। যেখানে ভোটটাই নেই, সেখানে কারচুপির প্রশ্ন আসে কেন? আগে ভোট দেওয়ার পরিবেশটি তৈরি করুন। ভেটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করুন। তারপর দেখা যাবে ভোটটি হাতে হবে না ইভিএমে। ইভিএম চালায় মানুষ। তাই আগে মানুষ ঠিক করুন। ইভিএম কোনো সমস্যা নয়। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনেও দেখা গেছে, যেসব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে, সেখানে ভোটের পার্থক্য হয়েছে কম। সে ক্ষেত্রে জিএম বিএনপির রক্ষাকবচ হতে পারে।

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের মাঠ সমতল না থাকার উদ্বেগের সঙ্গে আমরাও একমত। কিন্তু নির্বাচনী প্রচারের মাঠ সমতল হলেই তো হবে না। নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়ায় মাঠ সমতল রাখতে হবে। কেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরেও মাঠ সমতল রাখতে হবে। কোনো প্রার্থী কিংবা তাঁর সমর্থকেরা পুলিশের ভয়ে যদি বাড়িতেই থাকতে না পারেন, তাহলে কীভাবে মাঠ সমতল হবে? দেশের মানুষ গাজীপুর, খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশনের চিত্র দেখেছে। ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনের চেহারাও দেখেছে। মাহবুব তালুকদার বলেছেন, তিন সিটি করপোরেশনে যা ঘটেছে, তার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।

এর অর্থ তিনি একটি ভালো নির্বাচন চান। কীভাবে সেটি সম্ভব? ওবায়দুল কাদেরের যুক্তি মেনে নিয়ে নির্বাচন কমিশন যদি দুই দলের দুই সাধারণ সম্পাদককে নির্বাচনী প্রচারের সুযোগ দেয় কিংবা দুজনকেই বিরত রাখে, তাহলেই কি মাঠ সমতল হবে? স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে আসলে মন্ত্রী-সাংসদদের কোনো ভূমিকা রাখার কথা নয়। যাঁরা নির্বাচিত হবেন, তাঁরা তাঁদের হয়ে কাজ করবেন। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা স্থানীয় সরকারকে এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছেন যে এখন স্থানীয় সরকার সংস্থা ও দলের স্থানীয় কমিটির মধ্যে কোনো ফারাক থাকছে না।

নির্বাচনী মাঠ তখনই সমতল হবে যখন ভোটাররা নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবেন। কেউ তাঁদের ভোটদানে বাধা দেবে না। কোনো বিশেষ দলের ক্যাডাররা বলবে না, কষ্ট করে আপনার ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ভোট আমরা পেয়ে গেছি। আর ভোটকেন্দ্রে গিয়েও ভোটারকে শুনতে হবে না, ‘আপনার ভোট তো দেওয়া হয়ে গেছে।’

সোহরাব হাসান, প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com