Thank you for trying Sticky AMP!!

সিপিএম-বিজেপির লড়াই

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে টানা ২৫ বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে কমিউনিস্ট পরিচালিত বাম সরকার। বাঙালি অধ্যুষিত রাজ্যটিতে টানা ২০ বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন মানিক সরকার। তবে এবার বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে বিজেপি। ত্রিপুরার কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটাতে খোদ নরেন্দ্র মোদি স্লোগান দিয়েছেন, ‘চলো পাল্টাই’। 

পরিবর্তনের ডাককে প্রতিহত করতে সমূলে বিজেপিকে উৎখাত করারই পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে সিপিএম। ত্রিপুরায় এবার বিজেপি প্রচারবৈভবে অতীতের সব দলের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। অর্থবল থেকে গ্ল্যামার প্রদর্শনী, হাইটেক প্রচার, আকাশজুড়ে হেলিকপ্টার থেকে ভাড়া করা বিমান-সবকিছুতে তারাই এগিয়ে। আর এটাকে পাল্টা আঘাত হানতে তাই সিপিএমও তাদের সুসংহত কর্মিবলকে কাজে লাগাচ্ছে বিজেপিবিরোধী প্রচারে। জনসভায়ও লোকসমাগমে বিজেপিকে টক্কর দিচ্ছে সিপিএম। সঙ্গে এবার সিপিএমের তরফে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি আক্রমণ করা হচ্ছে বিজেপিশাসিত আসাম সরকারকেও।
সিপিএমের দাবি, আসামে বিজেপি সরকারের জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ (এনআরসি) ইস্যুতে বাঙালিদের মধ্যে বিজেপির জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছে। সেখানে চলছে বাংলাদেশি সন্দেহে সংখ্যালঘুদের ওপর জুলুমবাজি। অভিযোগ, আসাম সরকার ভারতীয় নাগরিকদের গায়েও এমন তকমা লাগাচ্ছে। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ দাবি করেছেন, আসামে একজনও বিদেশি নেই। তবু চলছে বিদেশি সন্দেহে মানুষকে জেলে পোরা। এহেন আসাম সরকারের অর্থমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বিজেপির হয়ে ত্রিপুরায় ভোটের ভারপ্রাপ্ত। সঙ্গে রয়েছে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাসের স্পষ্ট ইঙ্গিত। তাই সিপিএমেরও স্লোগান, ‘চলো ওল্টাই, চলো পাল্টাই’! আসাম ও দিল্লির ভারত সরকারকেই পাল্টানোর ডাক দিয়েছেন খোদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার।
প্রসঙ্গত, ত্রিপুরার জনসংখ্যার সিংহভাগই বাংলাদেশ থেকে আসা। ২০১১ সালের জনগণসমীক্ষা অনুযায়ী হিন্দু রয়েছে ৮৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। মুসলিম আছে ৮ দশমিক ৬০, খ্রিষ্টান ৪ দশমিক ৩৫ এবং বৌদ্ধ ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। জাতপাতের ভিত্তিতে ভোটের রীতি ত্রিপুরায় নেই। তবু মুসলিম বা খ্রিষ্টানদের বড় অংশই বিজেপির প্রতি বিমুখ। তবে তাদের মান ভাঙাতে বিজেপি এবার একজন মুসলিমকে প্রার্থী করেছে।
১৮ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরা বিধানসভার ৫৯ আসনের ভোট। একটি কেন্দ্রে প্রার্থীর মৃত্যুতে ভোট স্থগিত রয়েছে। বিজেপি এবার ছোট্ট রাজ্যটি জয়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে তাবড় নেতারা সব ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার ছোট্ট রাজ্যটিতে ২৫ লাখ ভোটারের মন জয়ে লাগাতার সভা করে চলেছেন। বিজেপি লড়ছে ৫০টি কেন্দ্রে এবং ৯টি কেন্দ্রে তাদের সঙ্গী আঞ্চলিক দল, আইপিএফটি। এই দলের ঘোষিত কর্মসূচিই হলো ‘ত্রিপুরা ভাগ’। অর্থাৎ, ত্রিপুরার উপজাতিদের জন্য চাই পৃথক তিপ্রাল্যান্ড। মিশ্র বসতিপূর্ণ রাজ্যটিতে বিজেপি অবশ্য প্রকাশ্যে রাজ্যভাগের বিরোধিতা করে ৭০ শতাংশ বাঙালি ভোটারের মন জয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আইপিএফটি অবশ্য রাজ্যভাগের ইস্যুতে নাছোড়।
অন্যদিকে বামেরা এটাকেই বড় ইস্যু করেছে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিজন ধরের দাবি, শান্তি, সম্প্রীতি, উন্নয়ন ও অখণ্ডতার প্রশ্নেই মানুষ তাঁদের ভোট দিয়ে দিল্লির সরকারকে পাল্টানোর বার্তা দেবেন। রাজ্যভাগ কিছুতেই ত্রিপুরার মানুষ মানবে না, দাবি বিজনের। ডাক দেন কেন্দ্রের সরকার ওল্টানোর। মোদি সরকার পাল্টানোর দাবি নিয়ে ত্রিপুরায় শেষ বাজারে প্রচারে নেমেছে তৃণমূলও। বিজেপির অভিনেত্রী সাংসদ হেমা মালিনীর বিপরীতে তারাও প্রচারে নামিয়েছে অভিনেতা সাংসদ দেবকে। আসল উদ্দেশ্য, সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপিকে ত্রিপুরায় রুখে দিয়ে ২০১৯ সালে চলো পাল্টাইয়ের ডাককে এখন থেকেই সুসংহত করা। সাফ জানালেন তৃণমূল নেতা ফিরহাদ হাকিম।
একই লক্ষ্য কংগ্রেসেরও। দলের দুই বিধায়ককে জিতিয়ে আনতে পারলেই তারা খুশি। বাকিটা হলো বিজেপিকে ত্রিপুরায় রুখে দিয়ে সেই কেন্দ্রের পরিবর্তনের পথই মসৃণ করা। এই ডাককে আরও মজবুত করতে প্রচারের শেষ লগ্নে আসছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। তিনিও বদলেরই ডাক দেবেন বলে কংগ্রেস সূত্রে খবর। ফলে বিজেপির রাজ্যে পরিবর্তনের ডাক বুমেরাং হয়ে দিল্লির পরিবর্তনের ডাক হয়ে উঠেছে।
‘চলো পাল্টাই’-এ যুক্ত হয়েছে মোদি বনাম মানিক লড়াই। ত্রিপুরা তথা গোটা দেশে মানিক সরকার তাঁর স্বচ্ছ ইমেজের জন্য পরিচিত। ছিমছাম জীবনযাত্রা। দুর্নীতির অভিযোগ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্তু বিজেপির বহিরাগত নেতারা ভোট প্রচারে তাঁকেই চাঁদমারি করেন। বহিরাগত নেতাদের মুখে ‘ভূমিপুত্র’ মানিক সরকারের নিন্দা শুনতে নারাজ ত্রিপুরাবাসীর একটা বড় অংশ। এটাও বিজেপি নেতাদের ভাবাচ্ছে। জানা গেছে, বিজেপির নিযুক্ত বেসরকারি পেশাদার সংস্থার সমীক্ষায় মানিক সরকারের ইমেজই তাদের বড় প্রতিপক্ষ। তাই মোদি-ম্যাজিককে জিইয়ে রাখতে গিয়ে মানিক সরকারকেই তারা এখনো গালি দিয়ে চলেছে।
রোববার ত্রিপুরায় বিধানসভার নির্বাচন। ভোট অবাধ ও শান্তিপূর্ণ রাখতে ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তে বাড়ানো হয়েছে টহলদারি। ভোটের আগেই সীমান্ত ‘সিল’ করার কথা। মোতায়েন করা হয়েছে প্রচুর আধা সেনা। বিক্ষিপ্ত কিছু গোলমাল হলেও বড় ধরনের কোনো সহিংসতার খবর নেই। তবে ভিনরাজ্যের বহু বিজেপি-সমর্থক ত্রিপুরায় আসায় চাপা উত্তেজনাও রয়েছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছেন বহিরাগতদের ওপর নজর রাখতে। নির্বাচন নির্বিঘ্নে করাটাও বড় চ্যালেঞ্জ এবার।
এত লড়াইয়ের পরও সিপিএমও জয়ের বিষয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসী। পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা কমিটির সম্পাদক তথা বিধানসভার উপাধ্যক্ষ পবিত্র করের দাবি, ‘আরও বেশি ভোটে, আরও বেশি আসনে আমরাই জিতব।’
তরুণ চক্রবর্তী প্রথম আলোর ত্রিপুরা প্রতিনিধি