Thank you for trying Sticky AMP!!

সুদের হারের গতিপ্রকৃতি ও চরিত্র

ব্যাংক সুদের হারের বর্তমানে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক যখন তুঙ্গে, তখন সুদের হার কমানোর দাবি, পরামর্শ ও প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও কাঙ্ক্ষিত ফলোদয় না হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিষয় পর্যালোচনার প্রয়োজন। কারণ, সুদের হারের বিষয়টি উপরিউক্ত কোনোটির ওপরই নির্ভরশীল নয়। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে, ব্যাংকিং খাতে সুদের হার যখন ক্রমাগত কমে আসছিল, ঋণের ওপর এই হার যখন এক অঙ্কে পৌঁছে যায়, যখন বড় শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো কোনোটি দর-কষাকষি করে তাদের নেওয়া ঋণের সুদের হার ৭ থেকে ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করে, তখন আমানতের ওপর সুদের হারও কমতে কমতে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এখন যে রকম ঋণের ওপর উচ্চ সুদের হার নিয়ে অসন্তোষ বিরাজ করছে, সে সময় আবার আমানতের ওপর সুদের স্বল্প হার নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল, সঞ্চয় থেকে প্রাপ্ত সুদ বা লাভ দিয়ে জীবন ধারণ করেন যেসব সাধারণ ও অবসরপ্রাপ্ত মানুষ, তাঁদের আয় কমে গিয়ে জীবনযাত্রা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে সময়ের বাস্তবতায় সুদের হারের অধোগতি কিংবা বর্তমান সময়ের ঊর্ধ্বগতি কারও ইচ্ছায় ঘটেনি।

এ কথা সবারই জানা, সুদের হার প্রধানত নির্ভর করে ঋণের চাহিদা ও সরবরাহের ওপর। অর্থ কিংবা ঋণের জন্য চাহিদা বেশি থাকলে সুদের হার বেড়ে যায়, অন্যদিকে এই চাহিদা কমে গেলে বা না থাকলে সুদের হার কমে যায়। অন্যভাবে দেখলে, বাজারে ঋণ সহজলভ্য হলে সুদের হার কমে যায় এবং ঋণ দুষ্প্রাপ্য হলে সুদের হার বেড়ে যেতে বাধ্য। আমাদের অর্থনীতিতে ঠিক এই পরিস্থিতিই ঘটেছে। ঋণের সহজপ্রাপ্যতার কারণেই ২০১৭ সালের শেষ ভাগে এসে সুদের হার কমতে কমতে ৭ বা ৮-এর ঘরে নেমে এসেছিল। আবার বর্তমান বছরের প্রথম থেকে যা শুরু হয়েছে, সেটি হচ্ছে ঋণের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে সুদের হারের দ্রুত বৃদ্ধি। যেসব ব্যাংক সে সময় ঋণের ওপর এক অঙ্কে সুদ আরোপ করছিল, সেই একই ব্যাংক এখন আমানতের ওপর দুই অঙ্কের হারে সুদ দিচ্ছে।

ঋণের সরবরাহ ও চাহিদা ছাড়াও মুদ্রাস্ফীতিও সুদের হারের ওপর প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলতে পারে। মুদ্রাস্ফীতির হার বেশি হলে সুদের হারও বেশি হবে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে আমানতকারীরা তাঁদের আমানত যখন ফিরে পান, তখন সেই অর্থের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। তাই অর্থের মূল্যের এই ক্ষয়িত ক্রয়ক্ষমতার ক্ষতি পূরণের জন্যই মুদ্রাস্ফীতির হারের চেয়ে সুদের হার বেশি হতে হয়।

অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতির সঙ্গেও সুদের হারের সম্পর্ক রয়েছে। এই গতি দ্রুত হলে মুদ্রাস্ফীতির আশঙ্কায় সরকার সুদের হার বাড়িয়ে দিয়ে ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আবার অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজ করলে সুদের হার কমিয়ে দিয়ে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙা করার উদ্যোগ নিতে পারে। আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকই মুদ্রানীতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে থাকে। নগদ সংরক্ষণ (সিআরআর: ব্যাংকের আমানতের যে অংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ জমা রাখতে হয়) এবং সংবিধিবদ্ধ জমা (এসএলআর: ব্যাংকের আমানতের যে অংশ বন্ড কিংবা অন্যান্য সুদভিত্তিক মাধ্যমে রাখতে হয়), ব্যাংক রেট (কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের নেওয়া ঋণের ওপর সুদের হার) ইত্যাদির মাধ্যমে ঋণ নিয়ন্ত্রণের প্রয়াসের ওপরও সুদের হার নির্ভর করে।

সুদের হার নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে উপরিউক্ত নিয়ামকগুলো সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও প্রবণতা, সুতরাং এগুলোর কোনোটিই নির্দিষ্ট কোনো ব্যাংক কিংবা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির চেষ্টায় ঘটে না। এসবের বাইরে একটি নিয়ামক আছে, যেটি সামষ্টিক অর্থনীতির সুদসংক্রান্ত সূত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, সেটি হচ্ছে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব ঋণঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে বিবেচনা ও মূল্যায়নে সুদের যে হার আরোপ করা হয়, সেটি। ঋণদাতা ব্যাংকগুলো তাদের প্রদত্ত ঋণের ওপর বিভিন্ন মাত্রার ঋণঝুঁকি বহন করে। সেই ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উপায় হিসেবে জামানতবিহীন অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের ওপর ব্যাংক বেশি হারে সুদ আরোপ করতে পারে। সে কারণে আমাদের ব্যাংকিং খাতেও দেখা যায় জামানতবিহীন ভোক্তা ঋণ এবং অরক্ষিত ক্রেডিট কার্ডের ঋণের ওপর সুদের হার সবচেয়ে বেশি।

সুদের হার নির্ধারণে অর্থনীতির ইতিহাসে দুটি তত্ত্ব আছে। ধ্রুপদি অর্থনীতিতে (১৯৩৬ সালে কেইনসের যুগের আগের অর্থনৈতিক মতবাদ) সুদকে দেখা হয়েছে সঞ্চয়ের পুরস্কার হিসেবে। সাধারণ মানুষ যে সঞ্চয় করে, সেই সঞ্চয় থেকেই সরবরাহ হয় পুঁজির। অন্যদিকে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা সেই সঞ্চয় থেকে ঋণ গ্রহণ করে বিনিয়োগ করেন, যার কারণে সৃষ্টি হয় পুঁজির চাহিদা। ধ্রুপদি অর্থনীতিবিদদের মতে, পুঁজির বাজারে বহুসংখ্যক সরবরাহকারী ও ব্যবহারকারীর মধ্যে একটা বাজার প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্ধারিত হয় সুদের হার, অর্থাৎ পুঁজির সরবরাহ বেশি থাকলে কিংবা চাহিদা কম থাকলে সুদের হার থাকবে কম এবং সরবরাহ কম ও চাহিদা বেশি থাকলে এই হার হবে বেশি। এই মতবাদের অনুসারীরা মনে করতেন, সঞ্চয়ের সুফল বর্তমানে ভোগ না করে ভবিষ্যতে ভোগ করা হবে, এই ত্যাগের জন্য সঞ্চয়কারীর পুরস্কারই সুদ। সে কারণেই সুদের হার বেশি হলে আরও বেশিসংখ্যক পুঁজি সরবরাহকারী তথা সঞ্চয়কারী তাঁদের বর্তমান খরচ কমিয়ে বেশি সঞ্চয় করবেন।

কেইনস এসে ধ্রুপদি অর্থনীতির এই মতবাদকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেন। তিনি বলেন, অর্থকে অলস ফেলে না রেখে বিনিয়োগের ধারায় প্রবাহিত করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই সুদ দিতে হয়। কারণ, কেইনসের মতে, সঞ্চয় বিনিয়োগ করে লোকসান বা ধার দিয়ে ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা পাওয়া এবং নগদ অর্থ হাতে রেখে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই মানুষ তাঁদের সঞ্চয় ঘরে রেখে দিতে চান। মানুষের অর্থ নগদ টাকা ধরে রাখার এই প্রবৃত্তিকে কেইনস তুলে ধরেছেন তাঁর নগদপ্রিয়তা (লিকুইডিটি প্রেফারেন্স) তত্ত্বে। নগদ টাকা ধরে রাখার এই প্রবণতা সম্পর্কে কেইনসের ধারণার পেছনে
সম্ভবত এই কারণ ছিল যে তখনকার যুগে ব্যাংক ব্যবস্থা ততটা সংগঠিত ছিল না, সুদৃঢ় ছিল না ব্যাংকগুলোর ভিত্তি, সুলভ ছিল না বিচিত্র ও বিভিন্নমুখী ব্যাংকিং সুবিধা।

সুদকে সঞ্চয়ের পুরস্কার হিসেবে গণ্য করার ধ্রুপদি অর্থনৈতিক মতবাদের বিপরীতে কেইনস এটিকে বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে তুলে ধরেছেন। সে কারণেই বিভিন্ন দেশের সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়নের মাধ্যমে সুদের হার দিয়ে সঞ্চয় ও ঋণপ্রবাহকে প্রভাবিত করে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে থাকে। আজকাল ব্যাংক পরিষেবা বিস্তৃত হওয়ার পাশাপাশি নিরাপত্তার অভাবজনিত কারণেও মানুষ নগদ টাকা ঘরে ফেলে রাখে না। ফলে মানুষের উদ্বৃত্ত অর্থ অলস পড়ে না থেকে ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকালে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। সে কারণেই কেইনসীয় মতবাদের ধারায় একটি অর্থনীতিতে সুদের হারের গুরুত্ব অনেকখানি বেড়ে গেছে।

সুদের হার বিষয়ে ওপরের মৌলিক ধারণা থেকেই আমরা আমাদের বর্তমান সুদের হার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় প্রবেশ করতে পারি। বর্তমান বছরের প্রথম থেকেই সুদের হারের উল্লম্ফনের কারণ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে খুব সংগত যে প্রশ্নটি জাগে সেটি হচ্ছে, আচমকা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা তরল অর্থ কীভাবে বা কোথায় উধাও হয়ে গেল? ব্যাংকগুলো যে ঋণ দান করে, সেটি আগ্রাসী হলেও যদি স্থানীয় মুদ্রায় দেওয়া হয়, তাহলে সেই ঋণ অর্থবাজারেই থাকবে, অন্য কোনো ব্যাংকের সিন্দুকে। কিন্তু সেই ঋণ বা বিনিয়োগ যদি আমদানির কারণে বিদেশি মুদ্রায় হয় এবং বৃহদাকারের সেই অর্থ যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে কিনে নিতে হয়, তাহলে টাকা তহবিল ব্যাংকগুলোর হাত থেকে চলে যাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিন্দুকে।

অন্যদিকে ব্যাংকগুলোতে সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার যখন তলানিতে এসে ঠেকেছিল, তখন সাধারণ সঞ্চয়কারীরা সরকারি সঞ্চয় প্রকল্পগুলোতে বেশি হারে বিনিয়োগ করেন, এভাবেও ব্যাংকের হাত থেকে তরল অর্থ স্থানান্তরিত হয়ে যায় সরকারের ঘরে। বৃহদাকার আমদানি ঋণের পরিশোধকাল দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার কারণে খুব দ্রুত এই অর্থ ব্যাংকের কাছে ফিরে আসে না। এগুলোর একটা বড় অংশ আবার খেলাপি হয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি হয়ে পড়ে আরও নাজুক। মূলত এসব কারণেই বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোতে বড় ধরনের তারল্যসংকট দেখা দেয়। অন্যদিকে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর ঋণদান সীমিত থাকায় তাদের পক্ষে আগ্রাসী ঋণদান করা সম্ভব হয়নি, ফলে এই সংকট তাদের স্পর্শ করতে পারেনি।

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী ঋণদানের পর ঋণ গ্রহীতাদের পরিশোধ-ব্যর্থতার কারণেও বহু ব্যাংকের নির্ধারিত ঋণ-আমানত অনুপাত (৮৫ শতাংশ) লঙ্ঘিত হয়। এই প্রেক্ষাপটে সর্বশেষ মুদ্রানীতিতে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার গতানুগতিক ধারায় স্বল্প সময়ের মধ্যে ঋণ-আমানত অনুপাত
দেড় শতাংশ কমিয়ে আনার ঘোষণায় ব্যাংকগুলো আমানত সংগ্রহে মরিয়া হয়ে উঠলে চাহিদা-সরবরাহের স্বাভাবিক নিয়মে সুদের হার বেড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে এই সময়সীমা দুই দফা বাড়িয়ে আগামী বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে নির্ধারণ করার পরও বাজারে আমানত সংগ্রহের চাহিদা কমিয়ে আনা এখনো সম্ভব হয়নি।

তারল্যসংকট উত্তরণে ব্যাংকগুলোর দাবি এবং সুদের হার কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে নগদ সংরক্ষণ অনুপাত (সিআরআর) ১ শতাংশ কমিয়ে আনার পরও সুদের হার কমার কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়নি। সিআরআর ১ শতাংশ কমানোর ফলে ব্যাংকিং খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার তারল্য বেড়ে গিয়ে ঋণ-আমানত অনুপাতের লঙ্ঘনের হার কিছুটা কমেছে বটে, কিন্তু তাতে ব্যাংকগুলোর ঋণদান সক্ষমতা বাড়েনি। ফলে বাজারে ঋণের সরবরাহ না বাড়ায় সুদের হার দ্রুত কমার কোনো সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। কেবল এই উপসর্গ থেকেই এমন উপলব্ধিতে পৌঁছানো যায় যে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সুদের হার কমানোর দাবি কিংবা প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন একটি মুক্তবাজার অর্থনীতিতে কখনোই কার্যকর করা সম্ভব নয়। ঋণ সরবরাহ বৃদ্ধি করেই কেবল সুদের হার কমানো যায় এবং সেই পন্থাগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টাই এখন করতে হবে সম্মিলিতভাবে।

ফারুক মঈনউদ্দীন লেখক ও ব্যাংকার

fmainuddin@hotmail.com