Thank you for trying Sticky AMP!!

সুধাংশু যাবে না

শাল্লার নোয়াগাঁও ও পাশের কয়েকটি গ্রামে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘরে হামলা হয়

সুধাংশুর কষ্টের কথা শামসুর রাহমান জানতেন। সে জন্যই তিনি লিখেছিলেন:

‘সুধাংশু ভস্মের মাঝে খুঁজে
বেড়ায় দলিল, ভাঙা চুড়ি, সিঁদুরের স্তব্ধ কৌটা, স্মৃতির বিক্ষিপ্ত পুঁতিমালা।’
তবু কবি তাঁকে অনুনয় করেছিলেন দেশ থেকে চলে না যাওয়ার জন্য। বলেছিলেন, ‘তবু তুমি যেও না সুধাংশু।’ শামসুর রাহমান স্বপ্ন দেখতে খুব ভালোবাসতেন। তিনি ভেবেছিলেন নিশ্চয়ই সময় পাল্টাবে। নিশ্চয়ই একদিন নতুন সকাল এসে হাজির হবে দুয়ারে। বলেছিলেন,
‘আকাশের নীলিমা এখনো
হয়নি ফেরারি, শুদ্ধচারী গাছপালা
আজও সবুজের পতাকা ওড়ায়,
ভরা নদী কোমর বাঁকায় তন্বী বেদেনীর মতো।
এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও
পরাজিত সৈনিকের মতো
সুধাংশু যাবে না।’

কিন্তু কবির সে স্বপ্ন পূর্ণ হয়নি। আজও এ দেশে ‘সংখ্যাগুরু’ ও ‘সংখ্যালঘু’ শব্দগুলো জ্বলজ্বল করে। আজও এ দেশে সংখ্যালঘুর ঘর পোড়ে, সম্পদ লুট হয়, নারীর সম্ভ্রমহানি হয়, পুরুষেরা অপদস্থ হয়, মেয়েদের জোর করে বিয়ে করা হয়, জমি-বাড়ি কেড়ে নেওয়া হয়, দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়।

স্বাধীনতার জন্য যে জাতির আন্দোলন সংগ্রাম চালিত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের ভিত্তিতে একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য, যে দেশে একটি মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল দীর্ঘ বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে, যে রাষ্ট্রের জন্য সর্বসম্মতিক্রমে রচিত হয়েছিল এমন একটা সংবিধান, যার মূল সুর ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা আর সমাজবাদ তথা সাম্য, যে রাষ্ট্রটির হওয়ার কথা ছিল সবার জন্য সমান একটি আশ্রয়, সেই দেশ আজ যেন আজ উল্টো পথ চলছে।

বাঙালি এমন একটি রাষ্ট্র চেয়েছিল যেখানে সবাই নিজে স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম পালন করতে পারবে, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকবে না। বাঙালি চেয়েছিল এমন একটি সমাজ, যেখানে সব ধর্মের মানুষ মিলেমিশে থাকবে। থাকবে বাঙালি, পাহাড়ি, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান-বাঁচবে একে অপরের সহযোগিতায়, সহমর্মিতায়।

স্বাধীনতা লাভের কিছুকাল পরই সেই রাষ্ট্রেরই সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর একটা বিরাট অংশের চিন্তায়, কর্মে, আচরণে সাম্প্রদায়িকতার উপাদান কীভাবে ঢুকল এবং এদের একটা অংশ সংখ্যালঘুর ওপর কেন নিপীড়নমুখী হয়ে উঠল, আর এই জনগোষ্ঠীর বাকিরা এই নিপীড়নের প্রতি কেন এতটা উদাসীন হয়ে গেল, তা এক গভীর গবেষণার বিষয় হতে পারে।

একটা সেক্যুলার রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়, যদি সমাজ সেক্যুলার না হয় এবং একটা সেক্যুলার সমাজ গঠনের আগে তৈরি করতে হয় জনগণের মধ্যে সেক্যুলার মানস। কিন্তু আমাদের দেশে ঘটেছে উল্টোটা। ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর চাপে পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রগতিপন্থী লেখা বাদ দেওয়া হয়েছে, নারী ও বিধর্মীদের প্রতি ধর্মগুরুদের ফতোয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে জনগণের মধ্যে সেক্যুলার মানস গড়ার পরিবর্তে গড়ে উঠেছে এমন একটা মানস, যা বিজ্ঞান ও যুক্তির পরিপন্থী এবং অনাধুনিক।

লেখক, ব্লগার, প্রকাশক হত্যার পরপরই হত্যাকাণ্ডের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করার ও এর বিচারের আশ্বাসের পরিবর্তে যখন দেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখে ‘কোনো কটূক্তি সহ্য করা হবে না’ জাতীয় মন্তব্য শোনা যায় তখন জনগণ যে বার্তাটি পায় তা সেক্যুলার রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে যায় না। বিভিন্ন অজুহাত তুলে সংখ্যালঘুদের ওপর ধারাবাহিকভাবে হামলা ও নির্যাতনের ঘটনার পরও যখন এসবের বিচার হয় না তখন তখন অপরাধীরা আশ্বস্ত হয়। অপরাধীদের কাছে সরকারের অবস্থানটি পরিষ্কার হয়। একটা দেশের মানুষ কী রকম আচরণ করবে, তাদের দৃষ্টিভঙ্গি কী রকম হবে, তা নির্ভর করে সে রাষ্ট্রের ও সমাজের প্রিডমিন্যান্ট স্পিরিট তথা প্রধান চেতনাটা কী, তার ওপর। এই প্রধান চেতনাটা গড়ে ওঠে দেশের রাজনৈতিক দল, প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা ইত্যাদির প্রভাবে।

সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান সংখ্যাগুরুর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া অসম্ভব। এখন প্রশ্ন হলো, সংখ্যাগুরু কেন সংখ্যালঘু সমস্যা নিরসনে সক্রিয় হবেন? একটা দেশের প্রত্যেক নাগরিকই চান তাঁর দেশ একটা উন্নত, আধুনিক রাষ্ট্রে উন্নীত হোক। কারণ, তিনি যখন একটা উন্নত রাষ্ট্রের দিকে তাকান, তখন সেই দেশের পরিপাটি সুশৃঙ্খল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সমাজ ও পরিবেশ, উন্নত জীবনমান, চিকিৎসা শিক্ষার সুব্যবস্থা তাঁকে নিশ্চয়ই আকৃষ্ট করে এবং তখন তিনি ভাবেন, ‘আহা আমার দেশটাও যদি ওই রকম হতো!’

তাহলে এখন বুঝতে হবে, দেশ উন্নত কীভাবে হয়। উন্নয়নের অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত হলো যে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় দেশের সব মানুষকে শামিল করতে হবে এবং উন্নয়নের ফলাফলও সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে। না হলে উন্নয়ন অর্জন করা অসম্ভব, তা যতই চেষ্টা করা হোক না কেন। এই যে উন্নয়ন তত্ত্বের কথা বললাম, এটা অনেকটা বৈজ্ঞানিক সত্যের মতো। যদি আপনি শুধু নিজের জন্যও উন্নতি চান, আপনাকে এ সত্য মানতে হবে। কারণ, সামগ্রিক উন্নয়ন তথা সমাজের ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন ছাড়া ব্যক্তির উন্নয়ন হয় না।

ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা মানে তাদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা, দেশ গড়ায় তাদের মেধা ও শ্রম প্রয়োগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা—অতএব, উন্নয়ন ব্যাহত হতে বাধ্য। তা ছাড়া সংখ্যালঘু সমস্যার মতো একটা বার্নিং ইস্যু চলমান থাকলে দেশ, দেশের অর্থনীতি সুস্থ ধারায় চালিত হতে পারে না। তার মানে হলো, আপনি যদি নিজে সংখ্যালঘু বিদ্বেষীও হন, সমষ্টিগত জীবনের তথা আপনার নিজের উন্নতির স্বার্থে, আপনার নিজের জন্য একটা শান্তিপূর্ণ জীবনের স্বার্থে, আপনার সন্তানের জন্য একটা সুস্থ, সুন্দর, সভ্য সমাজে রেখে যাওয়ার স্বার্থেই আপনার উচিত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে কোনো অন্যায় ও অবিচারের প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়ানো।

দেশকে একটা উন্নত আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য ব্যক্তির চিন্তার, কর্মের, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অপরিহার্য, সমাজে সব মতের, সব ধর্মের, সব গোত্রের মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান অপরিহার্য—এই উপলব্ধি জনগণের মধ্যে জাগাতে হবে। এই উপলব্ধি সৃষ্টি করতে হবে যে ব্যক্তির চিন্তার, কর্মের, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও যুক্তি-বুদ্ধির প্রসার ঘটে না, আর জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও যুক্তি-বুদ্ধির প্রসার ছাড়া উন্নত, আধুনিক জীবন লাভ করা যায় না। এই উপলব্ধি সৃষ্টির জন্য দরকার ব্যাপক আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার, মতবিনিময়, লেখালেখি, আলোচনা, সংগঠন, বিতর্ক, আলোচনা, পথসভা, মিছিল ইত্যাদি সব মাধ্যম, ব্যাপক হারে, ব্যাপকসংখ্যক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের অংশগ্রহণ।

ড. এন এন তরুণ রাশিয়ার সাইবেরিয়ান ফেডারেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির ভিজিটিং প্রফেসর ও সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। nntarun@gmail.com