Thank you for trying Sticky AMP!!

সুশাসনের জন্য জবাবদিহি দরকার

কার্টুন : তুলি

২০০৭ সালে আর্থিক খাতের সংকট থেকে যে বৈশ্বিক মন্দার সৃষ্টি হয়, তার মূল কারণ হচ্ছে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ হরেক রকম ব্যবস্থা নিয়েছে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রোগ নিরাময়ের লক্ষণ এখনো দৃষ্টির বাইরে। ২০১৫ সালে আমাদের নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। বাংলাদেশের মতো ছোট অর্থনীতির দেশগুলো এই বৈশ্বিক অধোগতি ও বড় অর্থনীতির নীতিসমূহের নেতিবাচক প্রভাবের বাইরে নয়। বাংলাদেশকে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ও শৃঙ্খলার জন্য কর্মোদ্যোগ নিতে হবে, শুধু লক্ষণগুলো (ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি-বিচ্যুতি, বিধিবিধান ও তত্ত্বাবধানের অপর্যাপ্ততা) আমলে নিলে চলবে না; তাকে অন্তর্নিহিত কারণগুলো খতিয়ে দেখতে হবে (আলগা নীতি, ব্যবস্থাপনার দূরদর্শী নীতি মান্য না করা, দুর্বল আর্থিক প্রতিবেদন, তারল্যের লাগামহীন বিস্তৃতি, যা বুদ্বুদ সৃষ্টি করে)।
এই নিবন্ধে দেশের ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ আমলে নেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক কালের হল-মার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের দুর্নীতি, বেসিক ব্যাংকের নজিরবিহীন আর্থিক অনিয়ম থেকে দেখা যায়, এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় ফাটল ধরেছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দুর্নীতি হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে। এসব ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে ব্যবস্থাপনা ও এমনকি নিচের স্তরের কর্মকর্তা পর্যন্ত কোনো ক্ষেত্রেই সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি দেখা যায়নি। আরও উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, এসব অনিয়ম বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকে ভিন্ন কাঠামো দেখা যায়। কিন্তু তারা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনাগত নীতিমালা অনুসরণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত মানদণ্ড যথেষ্ট সুচিন্তিত, তারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে। ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল সেটেলমেন্টসের (বিআইএস) আওতায় সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেলের দি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং সেটেলমেন্টস (বিআইএস) তিনটি প্রধান মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে: ব্যাসেল ১, ব্যাসেল ২ ও ব্যাসেল ৩। ব্যাসেলের তিনটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের বাইরেও ব্যাংকগুলো তাদের নিজেদের দেশের নানা আইন ও বিধিবিধান মেনে চলে।
আমানতকারী ও গ্রাহকের স্বার্থরক্ষায় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আগে যেটা বলেছি, বাংলাদেশে ব্যাংকের আইনি চাহিদা আন্তর্জাতিক মান অনুসারে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি ব্যাংক কোম্পানি আইনেও এসব প্রতিবেদন তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়, নিরীক্ষা প্রতিবেদনসহ। তার ওপর, রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের মতো বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো যে আইনে তৈরি হয়েছে, সেটাও তারা মেনে চলে। আবার রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিরও কোম্পানি আইন ও সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টের অধীনে নিবন্ধিত কোম্পানির ক্ষেত্রে কিছু সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান রয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনেরও আর্থিক প্রতিবেদনবিষয়ক বিধিবিধান রয়েছে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, আমাদের দেশে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান (আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনে পরিচালিত) ও কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনবিষয়ক মানদণ্ড বেশ সন্তোষজনক। কিন্তু উদ্বেগের ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলো এসব শর্ত ঠিকঠাকমতো পূরণ করে না। অর্থাৎ এসব আইন বাস্তবায়নই (প্রয়োগ ও মান্য করা) হয় না, এটাই একমাত্র ‘দুর্বলতা’। বলা যায়, কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই—ব্যাপারটা অনেকটা এ রকম। ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং স্ট্যান্ডার্ড-৩০ (আইএএস-৩০) অনুসারে তৈরি করা হয়। তার জায়গায় এখন ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডস (আইএফআরএস-৭) অনুসরণ করা হয়। প্রয়োজনীয় মানদণ্ড যদি অনুসরণ করা হয়, তাহলে ব্যাংকের আমানতকারী, গ্রাহক ও আমজনতার কোনো ক্ষতি হয় না। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য আইএএস-৩০-এর পাশাপাশি আইএএস-৩২, আইএএস-৩৯ ও আইএফআরএস-৯ অনুসরণের পরামর্শ দেওয়া হয়।
এটাও উল্লেখ করা দরকার যে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা দরকার। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোকে একদম ছেড়ে দেওয়া যাবে না, আবার তাদের অধিক হারে নিয়ন্ত্রণও করা যাবে না। এতে বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ জাঁ তিরোল এই বিষয়টি যথাযথভাবে তুলে ধরেছেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমানতকারী, বিনিয়োগকারী ও আমজনতাকে রক্ষা করা। মোদ্দা কথা, এর কাজ হচ্ছে সামগ্রিকভাবে প্রকৃত অর্থনীতিকে (প্রকৃত পণ্য ও সেবা) রক্ষা করা। নিয়ন্ত্রণের দ্বিতীয় যুক্তি হচ্ছে, আর্থিক খাতের সুশৃঙ্খল ঝুঁকি রোধ করা, যাতে তা এক জায়গায় শুরু হলে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে না পড়া। এটা অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। এর ফলে প্রকৃত উৎপাদন হ্রাস পায়, প্রবৃদ্ধি কমে যায়, বেকারত্ব বাড়ে ও মানবকল্যাণের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়।
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন আমাদের দেশের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়, বিশেষ করে এই খাতে বিরাজমান সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় সরকারি ও বেসরকারি দায়িত্বের পরিপ্রেক্ষিতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বর্তমানে আরও বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতিতে টেকসই রাজস্ব খাতের জন্য সরকারি কার্য পরিচালনায় স্বচ্ছতা খুব জরুরি, রাজস্ব খাতের সামগ্রিক শৃঙ্খলার জন্যও এটি প্রয়োজনীয়। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি পরস্পর সম্পর্কিত, একটি জোরদার হলে আরেকটিও জোরদার হয়। স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে জবাবদিহি বাড়ে, কারণ তাতে নজরদারি বাড়ে। আবার জবাবদিহি থাকলে স্বচ্ছতা বাড়ে, এটা এজেন্টদের জন্য উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করে। তারা নিশ্চিত হয় যে তাদের কাজের লক্ষ্য সম্পর্কে মানুষ সম্যকভাবে অবহিত হয়েছে, আর মানুষ তা বুঝতেও পেরেছে।
সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের ঘটনা হচ্ছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাবের যথার্থ দৃষ্টান্ত, সেখানে ঋণগ্রহীতা ও কর্মকর্তারা গোপন সমঝোতার মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। সেই ঘটনায় যাদের ধরা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বস্তুত তাদের এক রকম ‘বিকৃত প্রণোদনা’ দেওয়া হয়েছে আর সেই দুটি ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকে যেসব সৎ কর্মকর্তা কাজ করছেন, তঁাদের কোনায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
আর আর্থিক বিবরণী জনসমক্ষে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে ব্যবহারকারীদের জন্য বোধগম্য আকারে প্রকাশ করতে হবে, যাতে তারা সহজেই বুঝতে পারে। স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ ও আর্থিক প্রতিবেদনের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য আর্থিক প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত মানদণ্ড গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। ন্যায্য উপস্থাপনার ক্ষেত্রে ভুল তথ্য উদ্ঘাটনের চেয়ে ভালো কিছু নেই। বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে তাদের পক্ষে তা যথেষ্ট পরিমাণে উদ্ঘাটন সম্ভব নয়। আর এখানেই হিসাবরক্ষকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাজারে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা যে গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক তথ্য ব্যবহার করেন, সেগুলো সরবরাহ করে থাকে অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেম। একজন হিসাবরক্ষককে শুধু সংখ্যার ওপর নির্ভর করলে চলবে না, তাঁদের সংখ্যা বিশ্লেষণে যুক্তি ও বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করতে হবে।
ব্যাসেল নীতিমালা ও বাংলাদেশের নানা আইন ছাড়া আরও কিছু ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত মানদণ্ড রয়েছে: ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী ও পরিচালকদের যোগ্যতা, পরিচালনা পর্ষদ গঠন ও তার কার্যাবলির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ। যদিও আমরা সাম্প্রতিক সময়ে দেখেছি, ব্যাংকগুলো এসব ব্যবস্থাপনা মানদণ্ড অনুসরণ করে না। দেশের অনেক বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেই একই পরিবারের একাধিক সদস্য আছেন, এটা করপোরেট সুশাসনের পরিপন্থী। সে কারণে ব্যাংকিং খাতের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে করপোরেট সুশাসন নিশ্চিত
করা, যাতে আমানতকারী, ঋণগ্রহীতা, বিনিয়োগকারীসহ সবাই উপকৃত হন। একই সঙ্গে তাকে বাজার সম্প্রসারণ, মালিকানা বিস্তৃত ও অর্থায়নের বিকল্প সুযোগ তৈরি করতে হবে; প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হবে, কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে ও দেশের দারিদ্র্য হ্রাস করতে হবে।
করপোরেট সুশাসনের লক্ষ্য ও বিধিমালা মান্য করানোর মধ্যে ভারসাম্য আনয়নে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি: ক) শক্তিশালী ও স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার মনোযোগ নিবদ্ধ থাকবে মৌলিক ব্যাংকিং কার্যক্রমে। খ) সুচিন্তিত ও সুবিবেচনাপ্রসূত ব্যবস্থাপনা মানদণ্ড, যা সময় সময় বাহ্যিক ও প্রশাসনিক চাপের কারণে পরিবর্তিত হবে না, গ) সংকট ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তড়িৎ সংশোধনের ব্যবস্থা, সুনির্দিষ্ট ব্যাংকে বা ব্যাংকিং ব্যবস্থায় সংকটের জন্য দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, বর্তমানে ব্র্যাকের স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক।