Thank you for trying Sticky AMP!!

স্বাধীনতার অর্থ ও মানবিক মর্যাদা

বাংলাদেশে এখন যাঁদের বয়স ৪৫ অথবা তার কম, তাঁরা জন্মগ্রহণ করেছেন স্বাধীন দেশের নাগরিকের সৌভাগ্য নিয়ে। তার ওপরে যাঁদের বয়স কিন্তু ৭০-এর নিচে, তাঁরা ছিলেন প্রথমে পাকিস্তানের নাগরিক, তারপর স্বাধীন বাংলাদেশের। ৭০-এর বেশি যাঁদের বয়স, তাঁরা জন্মেছিলেন পরাধীন ভারতবর্ষে। তাঁরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করেছেন, তাঁদের সময় আইনের শাসনও ছিল, কোর্ট-কাছারি ছিল, দারোগা-পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছিল লেখাপড়ার জন্য, সরকারি হাসপাতাল ছিল রোগবালাই হলে চিকিৎসা নেওয়ার, রেলগাড়ি-স্টিমার ছিল যাতায়াতের জন্য। কিন্তু তাঁরা স্বশাসিত ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন পরাধীন। তাঁদের শাসক ছিলেন বিদেশি। তাঁরা দেখতে ছিলেন সুন্দর। লম্বা-চওড়া, গোলাপি-ফরসা। তাঁদের ভাষা ছিল ইংরেজি। পাকিস্তানের প্রধান শাসকেরাও উর্দুতে বাতচিত করতেন, বাংলায় নয়। ১৯৭২ থেকে বাঙালি স্বশাসিত। সেটা কম গৌরবের কথা নয়।

৪৫ বছর বয়স্করা আজ নিজেদের জিজ্ঞেস করতে পারেন তাঁরা কেমন রাষ্ট্রে বাস করছেন। বাংলাদেশের সংবিধান—দেশের সর্বোচ্চ আইন—যে অঙ্গীকার করেছে, রাষ্ট্রটি সেই রকম কি না। সংবিধান নাগরিকদের যেসব অধিকার দিয়েছে, সেসব অধিকার তাঁরা ভোগ করছেন কি না। সংবিধান যে রকম শাসনব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছে, ঠিক সেই রকম শাসনব্যবস্থায় দেশ পরিচালিত হচ্ছে কি না। এসব প্রশ্নের হ্যাঁ–বাচক বা না-বাচক উত্তর থেকে বলা যাবে তাঁরা কেমন রাষ্ট্রের নাগরিক।
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ’৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের যে সংবিধান ছিল তা একটি যথেষ্ট ভালো সংবিধান। তা ছিল যাকে বলে ওয়ার্কেবল—কার্যকর বা কাজ চালানোর জন্য উপযুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের নাগরিকদের দুর্ভাগ্য, যাঁরা সেই সংবিধানের রচয়িতা, তাঁরাই সেটাকে পরিবর্তন করেন। পরে স্বনিয়োজিত শাসকেরা ’৭২-এর সংবিধানের চেতনাকে নস্যাৎ করেন। কোনো জিনিস একবার বরবাদ হয়ে গেলে সেটাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া কঠিন।
ষোলো বার সংশোধনের পরেও বর্তমানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান যে অবস্থায় আছে তাতেও বলা হয়েছে: ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে। এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।’ [অনুচ্ছেদ-১১]
খুবই স্পষ্ট ঘোষণা। এই দুই বাক্যেই বহু কথা বলা হয়েছে। এই কথা কয়টির অর্থ দাঁড়ায় এই যে রাষ্ট্রযন্ত্র যত ক্ষমতাবানই হোক তার ওপরে একজন ব্যক্তি বা নাগরিকের স্থান। রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনো অধিকারই নেই কোনো নাগরিকের ‘মানবসত্তার মর্যাদা’ ক্ষুণ্ন করে—সে নাগরিক যে-ই হোক। হতে পারে সে একজন পকেটমার, ছিঁচকে চোর বা গ্রাম্য বাটপার, অথবা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মী কিংবা কোনো পত্রিকার উপসম্পাদকীয় লেখক।
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে বলা আছে: ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ আইনের আশ্রয় লাভ সব নাগরিক যাতে সমানভাবে পেতে পারে তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। এই অধিকারটি আইনের শাসনের প্রাথমিক শর্ত।
সংবিধানের ৩০, ৩১ এবং ৩২ অনুচ্ছেদেও আইনের আশ্রয় লাভের নিরঙ্কুশ অধিকার, জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার অধিকার রক্ষণ এবং গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির রক্ষাকবচ সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দেওয়া আছে। এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ কিংবা গুম সম্পর্কে কোনো অনুমোদনমূলক কথা তো দূরের কথা, ওই শব্দগুলোই সংবিধানে নেই।
মৌলিক অধিকারের অর্থ অবশ্য এই নয় যে একজন নাগরিক যা খুশি তা-ই করবে। মানুষ অপরাধপ্রবণ প্রাণী। ব্যক্তিস্বাধীনতা নাগরিকের একটি মৌলিক অধিকার। সেই সঙ্গে নাগরিককে হতে হবে আইন মান্যকারী ও সুশৃঙ্খল মানুষ। আইনে নিষিদ্ধ কোনো কাজ করলে তার শাস্তি প্রাপ্য। তবে সুবিচারের যে নীতি বা দর্শন তা হলো এমন শাস্তি একজন অপরাধীকে দেওয়া যাবে না, যাতে কারাগার থেকে বেরিয়ে সে আরও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। এবং এমন লঘু দণ্ড দেওয়া যাবে না, যার ফলে বারবার সে একই অপরাধ করার সাহস পায়। একটি সভ্য সমাজে কারাগারে এমন পরিবেশ থাকা বাঞ্ছনীয়, যেখানে গিয়ে অপরাধী আত্মসংশোধনের সুযোগ পায় এবং কারাগারেও যেন তার মানবাধিকার ও মানবিক মর্যাদা ক্ষুণ্ন না হয়।
অপরাধীর বিচার ও শাস্তি সম্পর্কিত মৌলিক অধিকারের কথাও সংবিধানে বলা হয়েছে। কোনো গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকেও ভয়ভীতি দেখিয়ে তার নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করা যাবে না। তা করা গর্হিত অপরাধ। অভিযুক্ত ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী আইনজীবীর পরামর্শ ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। পরাধীন ভারতবর্ষেও তা ছিল।
আমাদের দেশে এমন সব অপরাধের প্রবণতা দেখা দিয়েছে, যা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। ওই জাতীয় অপরাধীদের কঠোরভাবে দমন করাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব। শত্রুতাবশত ব্যক্তিগত খুনখারাবিও অপরাধ। সেখানে কেউ আসামি কেউ ফরিয়াদি। কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য যে সন্ত্রাস তা অন্য জিনিস, সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা অপরাধীর শত্রু নয়। যারা আহত বা নিহত হয়, তারা সম্পূর্ণ নির্দোষ। ভারতের উচ্চ আদালতের রায়ের খবরও কাগজে দেখেছি। তাতে বলা হয়েছে, সন্ত্রাসীদের অপরাধের জবাবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনবহির্ভূত তৎপরতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়, বরং তা আরও বেশি হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড উসকে দেবে। সুতরাং হিংস্র অপরাধ নির্মূলে অস্ত্র নয়, বিকল্প একাধিক ব্যবস্থা রাখাই সংগত। সে ব্যবস্থা নরমও হতে পারে, কঠোরও হতে পারে।
সংবিধানে পরিষ্কার ঘোষণা করা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র’। এর ওপরে কোনো কথা নেই। দেশ স্বাধীন হবে কিন্তু সেখানে কোনো গণতন্ত্র থাকবে না—এমন ধারণা নিয়ে কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরাই জীবন বাজি রেখে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেন না। শুধু ভোটাভুটি বা ভোটারবিহীন নির্বাচন মেনে নেওয়াই গণতন্ত্র নয়।
কোনো ধরনের সরকারই একা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য উচ্চতর আদালতসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলো যদি যথাযথ ভূমিকা পালন না করতে
পারে তাহলে গণতন্ত্র কার্যকর হয় না। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক, সরকারি কর্মকমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন প্রভৃতি যে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করছে—সে ব্যাপারে জনগণের সন্দেহ রয়েছে। ওই সব প্রতিষ্ঠান থেকে যদি জনগণ উপকৃত না হয় তাহলে ওগুলোর কোনো দাম থাকে না। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কেউ হস্তক্ষেপ যদি না–ও করে, কিন্তু দক্ষতা নেই। সাক্ষীগোপালের মতো কিছু থাকা না-থাকা একই কথা। মিডিয়ার ব্যাপকতার কারণে বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা প্রচারমুখী হয়ে পড়েছেন। একটি প্রতিষ্ঠানের জুনিয়র এক কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, চ্যানেল ও পত্রিকায় প্রচারের ব্যবস্থা না থাকলে এসি-কামরায় বসে কাজ না করে প্রতিদিন তাঁর বস সভা-সমাবেশে ছুটতেন না। তাঁরা অব্যাহত উপদেশমূলক, হুঁশিয়ারিমূলক এবং আত্মপ্রশংসামূলক বক্তৃতা দিচ্ছেন। তাতে প্রকাশ পাচ্ছে তাঁদের বাক্সর্বস্বতা, কিন্তু জাতির কোনো উপকার হচ্ছে না।
দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। আমাদের সংবাদপত্রের প্রতিবাদী ভূমিকা পালনের ঐতিহ্য আছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর বেসামরিক ও সামরিক-আধা সামরিক সরকারগুলো থেকে বিচিত্রভাবে সংবাদমাধ্যম আক্রান্ত হচ্ছে। বস্তুত, ওই আক্রমণ ও চাপ গণতন্ত্রের ওপর।
আজ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নতির কথা বলে অহংকার করা হচ্ছে। তার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতের। বেসরকারি উদ্যোগ গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রায়ত্ত করায় পাটকলসহ শিল্প-কারখানা ধ্বংস হয়ে যায়। সত্তরের দশকের শেষ দিক থেকে ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্প-কারখানা-ব্যবসা গড়ে উঠতে থাকে। দুর্নীতি না থাকলে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দক্ষতা অপেক্ষাকৃত বেশি থাকলে বেসরকারি উদ্যোগ আরও বিকশিত হতো।
নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সংগঠন ও নারী সংগঠনগুলোকে প্রলোভন দিয়ে অথবা ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে রাখলে গণতন্ত্রের চরম ক্ষতি হয়। একাত্তরে ছিল ভয়—মৃত্যুর ভয়, নির্যাতনের ভয়, অপমানের ভয়। স্বাধীন দেশে ভয় থাকবে কেন?
লাখো মানুষের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা কয়েক লাখ মানুষকে এত বেশি দিয়েছে যে তা তাঁদের পূর্বপুরুষেরা স্বপ্নেও দেখেননি। সেটা হতে পেরেছে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দর্শন থেকে শাসকশ্রেণি বিচ্যুত হওয়ায়। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির বাস্তবায়ন ছাড়া সমাজে মানুষে–মানুষে বৈষম্য দূর সম্ভব নয়। অতীতের কোনো গাথাতেই—তা নির্যাতনের কাহিনিই হোক বা বীরত্বের কথাই হোক—বর্তমানের অধিকারহীন মানুষের মন ভিজবে না। স্বাধীনতার সঙ্গে ডিগনিটি অব লাইফ—জীবনের মর্যাদা ও অধিকার জড়িত।
যে দেশে ‘পুত্রহীনা আর বিধবার কাঁদনে’ ‘মর্মের বত্রিশ বাঁধন’ ছিঁড়ে যায়, সেই দেশেরই একশ্রেণির মানুষ আমেরিকা ও মালয়েশিয়ায় বাড়ি করে আর সুইস ব্যাংকে টাকার হাঁড়ি গচ্ছিত রাখে, সে দেশে স্বাধীনতার অর্থ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবার কাছে সমান অর্থ বহন করে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হওয়ার কিছুদিন পর ড. আতিউর রহমান আমাকে নিয়ে শেরপুর গিয়েছিলেন। সেখানকার বিধবাপল্লির মানুষদের জন্য এবং আরও একাত্তরের শহীদ ও নির্যাতিত পরিবারগুলোর জন্য তিনি কিছু করতে চেয়েছিলেন। মলিন বস্ত্র পরা বিধবাপল্লির নারীরা হাঁটু গুঁজে মাথা নিচু করে মাটিতে বসে ছিলেন নির্বাক। স্বাধীনতা প্রাপ্তিতে তাঁদের যে বিশাল অবদান রয়েছে, তা তাঁরা জানেন না। কিন্তু শাসকশ্রেণি ও আমরাই কি জানি? তা জানলে ৪৬ বছরে বাংলাদেশের অবস্থা হতো অন্য রকম।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।