Thank you for trying Sticky AMP!!

সৎ মানুষের খোঁজে শেখ হাসিনা

বেশ কয়েক বছর হলো ‘তৃণমূল’ শব্দটি বেশ চাউর হয়েছে। শুনতে ভালো লাগে। মনে হয়, এ যেন শিকড়ে ফিরে যাওয়া, মাটির সোঁদা গন্ধ আর কাদামাখা শরীর নিয়ে হাজার বছর ধরে বহমান প্রান্তজনের জীবনধারার ছোঁয়া অনুভব করা।
তৃণমূলের একটি আবহ পাওয়া যায়
রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায়। এ দেশের রাজনীতিতে একজন বা কয়েকজন নেতা সবাইকে ছাপিয়ে ওপরে উঠে যান। একই সঙ্গে চলে ‘কাল্ট ওয়ারশিপ’ বা বীরপূজা। নেতা ভাবতে থাকেন, তিনি অপরিহার্য, অভ্রান্ত। দলের সদস্য-অনুগামীদের তিনি ‘আহ্বান’ জানান না, ‘নির্দেশ’ দেন। এভাবেই রাজনীতির অন্দরমহলে তৈরি হয় ব্যক্তিবাদ, গোষ্ঠীতন্ত্র বা ‘অলিগার্কি’।
রাজনৈতিক দলে ‘গণতন্ত্রের’ কত যে চর্চা হয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় গাঁও-গেরামের ছোট নেতারাও যে কত সম্পৃক্ত হন, তার একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আমরা পাই ‘বর্ধিত সভায়’। এখানে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড অর্থাৎ দলের সব শাখা-প্রশাখার প্রতিনিধিরা বৈঠকে বসেন, মতামত দেন। বর্ধিত সভা মানেই বড়সড় এক সম্মিলন, যা দলের কাউন্সিল সভা ছাড়া আর দেখা যায় না বা আয়োজন করা সম্ভব হয় না। বর্ধিত সভায় ‘তৃণমূলের’ উপস্থিতি লক্ষ করার মতো।
৬৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের একটি বর্ধিত সভা হয়ে গেল ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে। প্রধানমন্ত্রী একাধারে দলেরও সভাপতি। সভায় দলের কেন্দ্রীয় নেতারা ছাড়াও সারা দেশ থেকে ছয় হাজারের বেশি নেতা ও জনপ্রতিনিধিকে ডাকা হয়েছিল। সামনে অনুষ্ঠেয় কয়েকটি সিটি করপোরেশন এবং জাতীয় সংসদের নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে এই সভা ছিল কাম্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে, আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই আওয়ামী লীগ ঘর সাজানোর কাজে এগিয়ে থাকতে চাচ্ছে। এই বর্ধিত সভায় দলের সভাপতির বক্তব্যে তা স্পষ্টভাবেই উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন, ‘সামনে নির্বাচন। এই কথাটা সব সময় মনে রাখতে হবে, নির্বাচন মানেই এটা চ্যালেঞ্জিং হবে। এটা কিন্তু আমাদের একটানা তৃতীয়বার। এই তৃতীয়বারের নির্বাচনে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।’ (প্রথম আলো, ২৪ জুন ২০১৮)।
আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয়বার সরকার গঠনের জন্য উদ্‌গ্রীব। তাদের সামনে দুটো বড় উপলক্ষ আছে। এক. দলের প্রয়াত নেতা ও স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপন করা হবে ২০২০ সালে। দুই. বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সুবর্ণজয়ন্তীর বছর হতে যাচ্ছে ২০২১ সাল। আওয়ামী লীগ চালকের আসনে থেকেই গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি উৎসবের আয়োজন করতে চায়। সে জন্য আগামী নির্বাচনে জয়ের জন্য দলটি মরিয়া।
আওয়ামী লীগের দাবি, এই দল সরকারে থাকলে দেশের উন্নয়ন হয়, তারা না থাকলে বা তাদের প্রতিপক্ষ সরকারে থাকলে দেশ রসাতলে যায়। এই উন্নয়নের জোয়ারে নাগরিকেরা আওয়ামী লীগকে ভোট না দিয়ে অন্য কাউকে ভোট দিয়ে কেন সরকারে পাঠাবে? দলের সভাপতি বর্ধিত সভায় আশঙ্কা জানিয়ে বলেছেন, ‘আমরা যে উন্নয়ন করেছি, তাতে মানুষ নৌকায় ভোট দেবে না, এটা হতে পারে না। যদি ভোট না দেয়, সে জন্য আপনারাই দায়ী থাকবেন। কারণ, আপনারা সঠিকভাবে মানুষের কাছে যেতে পারেননি, তাদের কাছে সরকারের উন্নয়নের কথা বলতে পারেননি। তাদের বোঝাতে পারেননি।’ তাঁর প্রশ্ন, ‘আমরা যে কাজ করেছি, তা অন্য দল করেনি। তাহলে কেন তারা ভোট পাবে?’
সভাপতি শেখ হাসিনা হয়তো বুঝতে পারছেন, দলে ক্ষয়রোগ বাসা বেঁধেছে। দীর্ঘদিন দল সরকারে থাকলে এ রকম হতে পারে। দলের অনেকেরই হয়তো গা-ছাড়া ভাব। যেন দলকে জেতানোর দায়িত্ব সরকারের তথা শেখ হাসিনার। এ জন্য দলের মধ্যে একটি ব্যাপারে ঐকমত্য আছে, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে।’ অর্থাৎ শেখ হাসিনাই হচ্ছেন তুরুপের তাস। তিনি না থাকলে দল অনাথ। দলের জন্য শেখ হাসিনা নিঃসন্দেহে একটি বড় সম্পদ। এ কথাও সত্য যে তাঁকে ছাড়া দল অচল। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের
ভাষায় এটি কিসের ‘সিনড্রোম’, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
ওপরে ওপরে আওয়ামী লীগকে যত জোরদার ও গোছালো মনে হোক না কেন, ভেতরে ভেতরে সংহতির বুননটি কি আলগা হয়ে যাচ্ছে? যেকোনো নির্বাচনেই দেখা যায় দলের একাধিক প্রার্থী। যিনি দলের মনোনয়ন পান, অন্যরা তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান। না দাঁড়ালেও তলে তলে প্রতিপক্ষের হয়ে কাজ করেন। তৃণমূলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণে দলের প্রার্থীর জয় ছিনতাই হয়ে যায়। এটাও সত্য যে তৃণমূলে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও দলের কোনো কোনো কেন্দ্রীয় নেতার আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে অনেক সময় ‘ভুল’ প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। ‘মনোনয়ন-বাণিজ্য’ নিয়েও অনেক কথাবার্তা আছে। সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কেউ দলের মনোনয়ন পাবেন কি পাবেন না, সেটা নির্ভর করে এলাকায় কতটুকু জনপ্রিয়তা অর্জন
করতে পেরেছেন, দলের নেতা-কর্মীদের কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন, তার ওপর।’ বোঝা যাচ্ছে,
তৃণমূলে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় নেতারাই মনোনয়ন পাওয়ার দাবিদার বলে মনে করেন শেখ হাসিনা। এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই তাঁর নিজস্ব জরিপ আছে—কে কোথায় জনপ্রিয় এবং যোগ্যতার বিচারে কারা উত্তীর্ণ হতে পারবেন।
শেখ হাসিনার ২৩ জুনের বক্তব্যের কিছু অংশের সঙ্গে কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় ৪৩ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া একটি ভাষণের। ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে বাকশালের চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আমি একটা হাই অফিশিয়াল, আমি একটা পলিটিশিয়ান, আমি একটা পলিটিক্যাল ওয়ার্কার, আমি একটা এমপি, আমি দেশের একটা কর্মচারী, আমি একটা পুলিশ অফিসার। আই হ্যাভ হাই রেসপনসিবিলিটি। এখানে চুরি হচ্ছে, এখানে অন্যায় হচ্ছে, এখানে খারাপ হচ্ছে—এটা বলার অধিকার আমার থাকবে।...আমার যে সার আমি দিয়েছি, তার কমপক্ষে থার্টি পারসেন্ট ব্ল্যাক মার্কেটিংয়ে চুরি হয়ে গেছে। আমি যে ফুড দিই, তার কুড়ি পারসেন্ট চুরি হয়ে যায়। আমি যে মাল পাঠাই গ্রামে গ্রামে, তার ২০-২৫ পারসেন্ট চুরি হয়ে যায়। সব চুরি হয়ে যায়।’
বর্ধিত সভায় শেখ হাসিনা একটি সাধারণ সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের যাঁরা সাংসদ আছেন, তাঁদেরও আমি বলব, একটা কথা মনে রাখবেন। জনগণ কিন্তু খুব হিসাবি। কেউ দুর্নীতি করলে জনগণ কিন্তু সেটা ঠিকই মাথায় রাখবে। সেটা কিন্তু তারা ভুলে যায় না। কাজ করতে গিয়ে টাকা নিলে পরে ভোট চাইতে গেলে তারা বলবে, টাকা দিয়ে কাজ নিয়েছি, ভোট দেব কেন?’
দলের কে কোথায় কী করে বেড়াচ্ছেন, তার একটা ফিরিস্তি দলের সভাপতির কাছে নিশ্চয়ই আছে। তিনি যদি তাঁর কথায় অটল থাকেন, তাহলে ধরে নেওয়া যায়, সৎ মানুষেরাই আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাবেন। সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে আমরা দেখেছি, ব্যক্তিগত ‘সক্ষমতার’ নিরিখেই নির্বাচনে প্রার্থী ঠিক করা হয়। সক্ষমতা বলতে এখানে বোঝায় টাকা ও পেশির জোর। আগামী নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে আওয়ামী লীগ এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে কি?
বঙ্গবন্ধু দলের ওপর আস্থা হারিয়েছিলেন। সবাইকে নিয়ে একদল তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পুরোনো মুখ বাদ দেননি। দলের মধ্যে এ ধরনের একটি অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি অনেক। ভালো কিছু পেতে হলে ঝুঁকি তো নিতেই হবে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকাই বলে দেবে, শেখ হাসিনা যা বলেছেন, তার কতটুকু করে দেখাবেন। তিনি তো ভালো করেই জানেন, প্রার্থী ভালো মানুষ হলে, গ্রহণযোগ্য হলে, জনসমর্থন থাকলে ভোট চুরির দরকার পড়ে না।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
mohi2005@gmail.com