হামলা-মামলাও যখন শিক্ষার মাধ্যম
পুরো বিষয়টা অন্য রকম হতে পারত। তাহলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে (এখন পর্যন্ত) মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে আমরণ অনশনে বসতে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হককে ৫৭ ধারার দাবড়ানি খেতে হতো না। কিন্তু সব রকমের বিরোধিতা বিনাশের নেশা পেয়ে বসেছে সব রকমের ‘কর্তৃপক্ষ’কে। প্রতিপক্ষের বিনাশ ছাড়া মীমাংসার আর কোনো পথে তাঁরা হাঁটবেনই না। এই পোড়ার দেশে যা হওয়া উচিত তা হয় না।
ঢাকা-আরিচা মরণসড়কের পাশেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ক্যাম্পাস। এ সড়কেই প্রাণ হারিয়েছেন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাওছার হোসেইনসহ অগণিত মানুষ। প্রায় প্রতিবছরই এই সড়ক কেড়ে নেয় কোনো না কোনো জাবি শিক্ষার্থীর প্রাণ। এ মুহূর্তে মনে না-পড়া আরও অনেকের জীবনলীলা সাঙ্গ হয়েছে এই মহসড়কেই।
গত ২৬ মের ঘটনা। ওই দিন ভোরে জাবির দুই শিক্ষার্থী বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারান। তাঁদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার গাফিলতি নিয়েও অভিযোগ আছে। সহপাঠীদের জন্য এটা ছিল বিরাট ধাক্কা। যাঁরা নিয়মিতভাবে ঝুঁকি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়ক পার হন, নিয়মিতভাবে পরিবহনশ্রমিকদের ঘাড়ধাক্কা খান, ঢাকা-জাহাঙ্গীরনগর পথের সেসব ভুক্তভোগী ছাত্রছাত্রীর জমাট ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। তাঁরা যথারীতি সড়ক অবরোধ করেন। অবরোধের পক্ষে বলার কিছু নেই। এ দেশে সব জায়গায় মার খাওয়া ছাত্র, শ্রমিক, গ্রামবাসীর শেষ আশ্রয় হয় রাজপথ। যাঁদের ক্ষমতা আছে, তাঁরা ক্ষমতাটা দেখিয়ে ফেলেন, উপাচার্যকে ঘেরাও করেন কিংবা হামলা চালান প্রতিপক্ষের ওপর। এসব না-পারা বোকা শিক্ষার্থীরা গেছেন রাজপথে। স্বাভাবিক অবস্থায় এ ধরনের অবরোধ সমর্থন করা যদিও যায় না, আর তা-ই তাঁদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে ফেরত আনাও অসম্ভব ছিল না।
শিক্ষার্থীরা চেয়েছিলেন সত্যিকার আশ্বাস, চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়ক নিরাপদ হোক, প্রশাসন সহপাঠী হারানোর শোক বুঝুক। বিষয়টি রাজনৈতিকও ছিল না, প্রশাসনবিরোধীও ছিল না। অভিজ্ঞরা জানেন, গোঁয়ার ক্ষমতার দাপট দেখাতে না চাইলে এসব ঘটনা সামাল দেওয়া প্রশাসনের পক্ষে কঠিন নয় এবং সেটাই হতে যাচ্ছিল। উচিত ছিল শোকে-প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার একজোট হয়ে সরকারের দিকে যাওয়ার। শিক্ষার্থী বনাম প্রশাসনের দ্বন্দ্ব তো এটা নয়। কিন্তু ওই যে যা হওয়ার তা হয় না। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও নিশ্চয়ই হঠকারী কেউ কেউ ছিলেন। তারপরও উপাচার্যের আশ্বাসে ১৫ মিনিটের মধ্যে অবরোধ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েও সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হলো না। কুচক্রীদের ইন্ধনে ছাত্রলীগের একাংশ সমঝোতার দুই মিনিটের মাথায় ছাত্রনেতাদের ওপর হামলা চালায়। সঙ্গে যোগ হয় পুলিশের লাঠি-টিয়ার ইত্যাদি। ঘটনা ঘুরে যায়, মার খাওয়া মনের রাগ নিয়ে তাঁরা আবার উপাচার্য ভবনে জড়ো হন। সেখানে কিছু ভাঙচুর হয়, প্রশাসনের পক্ষে দাপট দেখানো শিক্ষকদের সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত বাক্যবিনিময় হয়।
এরই জেরে সুনির্দিষ্ট ৪২ জনসহ অজ্ঞাতসংখ্যক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তার চলে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষিত হয়। শুরু হয় মামলার আসামিদের বিভিন্ন প্রকারের হয়রানি। ক্যাম্পাসেও তাঁদের শান্তি নেই, পরিবারেও ঘুম নেই। এ রকম অস্থিরতায় পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। উপায় না পেয়ে তাই কয়েকজন শিক্ষার্থী আমরণ অনশনে বসে গেলেন। দিন যাচ্ছে, আর অনশনকারীর সংখ্যা বাড়ছে। কীভাবে সমাধানযোগ্য সমস্যাকে জটিল ও কঠিন করে তোলা যায়, আমরা দেখলাম!
প্রায় ১৭ বছর আগে জাবির একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারান। সেবারও বিক্ষোভ-আন্দোলন হয়েছিল, এবারও হয়েছে। সেবার এই লেখকসহ সাতজন তরুণকে আন্দোলন করবার ‘অপরাধে’ জননিরাপত্তা আইনের মামলায় কিছুদিন জেলবাস করতে হয়েছিল। এবার মামলা হয়েছে অনেকের বিরুদ্ধে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনেকের দাবি সত্ত্বেও ‘মামলা প্রত্যাহার সম্ভব নয়’ বলেছেন উপাচার্য। জানা যায়, উপাচার্য নমনীয় হতে চাইলেও সিন্ডিকেটের ক্ষমতাশালী শিক্ষকেরা প্রতিবাদীদের কঠিন শিক্ষা দিতে বদ্ধপরিকর। উপাচার্য বদলায়, এমন কঠিন শিক্ষকেরা থেকে যান, যাঁদের শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হলো ক্ষমতার দাপট।
২.
কথায় বলে, ‘মরারে মারো ক্যা? কয়, লড়েচড়ে ক্যা?’ অতএব নো নড়নচড়ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক ফাহমিদুল হক বিশ্লেষণী লেখালেখি করতেন, প্রশাসনের খারাপ কাজের সমালোচনা করে থাকেন, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও তিনি জনপ্রিয়। কিছুদিন আগে শিক্ষকদের আবাসন বরাদ্দে অনিয়মের বিরুদ্ধে লিখেছিলেন পত্রিকায়। সম্ভবত, মওকামতো তাঁকে ‘সাইজ’ করার পরিকল্পনা কারও থেকে থাকতে পারে। সম্প্রতি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ফল প্রকাশে বিলম্ব ইত্যাদি নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে রেষারেষি হয়। একজন প্রখ্যাত নারী শিক্ষককে হেনস্তার আয়োজনও দেখা যায়। এই বিতর্কে ফেসবুক গ্রুপে ফাহমিদুল হক অন্য এক শিক্ষকের ভূমিকার মৃদু সমালোচনা করেন। আর যাবে কোথায়? সাংবাদিকতার শিক্ষক হিসেবে যাঁদের নাকি মতপ্রকাশের জন্য হুমকিজনক আইনের সমালোচনা করার কথা, সে রকম একজন শিক্ষক সাংবাদিকতা শিক্ষার চেতনা বিসর্জন দিয়ে ৫৭ ধারায় মামলা দিয়ে বসলেন সহকর্মী ফাহমিদুল হকের বিরুদ্ধে।
এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম নিয়ে সোচ্চার অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রুশাদ ফরিদীকে সহকর্মীদের অভিযোগের ভিত্তিতে বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া হয়। ক্ষমতা নিম্নগামী। ক্ষমতার উচ্চ নম্বরের সিঁড়িতে যাঁদের পা, তাঁরা প্রতিবাদ-সমালোচনা সইতে পারেন না। পারলে হামলা করান, নইলে নিপীড়নমূলক আইনের ‘সদ্ব্যবহারের’ সুযোগ তাঁদের জন্য খোলা। এসব দেখে আমরা বুঝতে পারি উচ্চশিক্ষা–ব্যবস্থার ভেতরে কী পরিমাণ হিংসা বাসা বেঁধেছে। বিরোধী মত বিনাশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে তোড়জোড়, তা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও পিছিয়ে নেই। দীর্ঘদিন ভয়ের শাসন জারি থাকলে সমাজের সব স্তরে তা শাখা-প্রশাখা মেলে বসে; এসব ঘটনা তার উদাহরণ।
ইটভাটার সব ইট একই ছাঁচে একই চুল্লির উত্তাপে পুড়িয়ে তৈরি করা হয়। সরকার থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভবত ইটভাটার মডেলই গ্রহণ করেছে। সবাইকে আনুগত্যের ছাঁচে তৈরি হতে হবে। যদি তুমি ‘আলাদা’ হতে চাও, যদি তোমার বিবেককে লেখা-বলা-কাজে প্রকাশ করতে চাও, যদি তুমি প্রশ্ন করো, তবে তোমার জন্য আছে হামলা-মামলার ধোলাই পদ্ধতি।
দেশ সত্যিই এগিয়ে যাচ্ছে। বড় বড় ধোলাই মেশিন হয়ে উঠছে একেকটি প্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয় এ থেকে বাদ যাবে কেন? সবকিছু ধোলাই হয়ে গেলে দেশটা কী সুন্দর ফকফকা হয়ে উঠবে, তাই না? কিন্তু সেই দেশ এবং সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কাদের জন্য অভয়ারণ্য হয়ে উঠবে, তা ভাবতেই আতঙ্ক লাগছে।
পুনশ্চ : শেষ খবর অনুযায়ী ফাহমিদুল হক চাপের মুখে দুঃখপ্রকাশ করতে রাজি হয়েছেন, তাতে মামলা প্রত্যাহার হতে পারে। আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে বৈঠকে বসেছে। সবারই শুভবুদ্ধির উদয় আশা করি।
ফারুক ওয়াসিফ : লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothom-alo.info